Sun. May 4th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

4খোলা বাজার২৪, শনিবার, ৫ ডিসেম্বর ২০১৫ : বাংলাদেশ রেলওয়ের ৪ হাজার ৩৯১ একর জমি এখন বেদখলে। প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এসব জমি দখল করে কোথাও মার্কেট, কোথাও বাজার আবার কোথাও বস্তি করে কোটি কোটি টাকা আয় করছে। অনেক জায়গায় আবার রাজনৈতিক কার্যালয়ও আছে। বছরের পর বছর চলে গেলেও এসব জমি উদ্ধার করতে পারছে না রেলওয়ে।
রেলওয়ে সূত্র বলেছে, সারা দেশে বর্তমানে রেলওয়ের মোট জমি ৩১ হাজার ৮৬০ একর। এর মধ্যে পূর্বাঞ্চলে ১ হাজার ৪ একর এবং পশ্চিমাঞ্চলে ৩ হাজার ৩৮৭ একর জমি বেদখল হয়ে আছে। পূর্বাঞ্চলের দখল হওয়া জমির মধ্যে ৭৮০ একর জমি ঢাকা বিভাগে এবং ২২৩ একর জমি চট্টগ্রাম বিভাগে। পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে ৯১৭ একর জমি লালমনিরহাট অঞ্চলে এবং ২ হাজার ৪৭০ একর জমি পাকশী অঞ্চলে। অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি জমি বেদখল হয়েছে পাকশী অঞ্চলে।
রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা বলছেন, দখলকারীদের বেশির ভাগের সঙ্গেই রাজনৈতিক দলের সম্পর্ক আছে। এ কারণেই অধিকাংশ সময় দখলমুক্ত করা যায় না।
তবে রেলওয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর যোগসাজশেও জমি দখলের অভিযোগ আছে। বিশেষ করে রেলের শ্রমিকনেতাদের কারণে অনেক জায়গাই দখলমুক্ত করা যায় না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, ‘রেলের উন্নয়নে মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ জন্য রেলের বেদখল হয়ে যাওয়া জমি উদ্ধার করা হবে। যারা এসব জমি দখল করে রেখেছে, সেই তালিকা হচ্ছে। যে করেই হোক এসব জমি উদ্ধার করা হবে।’
সরেজমিন চিত্র: ঢাকার খুব কাছের নারায়ণগঞ্জের জিমখানায় রেলের ১৩ একর জমি দখল হয়ে আছে। সেখানে একসময় রেলের আবাসিক কলোনি ছিল। কিন্তু সেগুলো দখল করে বস্তি বানিয়ে লোকজন বসবাস করছে। সেখানে একটি খালও দখল করে ভবন বানানো হয়েছে। তোলা হয়েছে অসংখ্য বস্তিঘর। বস্তিবাসীরা বললেন, মোহাম্মদ সোলায়মান নামে একজন এই জমির মালিক দাবি করে এসব ঘর তুলে তাঁদের থাকতে দিয়েছেন।
জানতে চাইলে মোহাম্মদ সোলায়মান বলেন, ‘এখানে ৪ একর ৮৫ শতাংশ জমির মালিক আমি। সেখানে ২ হাজার ঘর তুলে ভাড়া দিয়েছি।’ রেলের জায়গার মালিক আপনি কীভাবে হলেন—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি এই জমি কিনেছি রতন কুমারের কাছ থেকে।’ আর রেলের ভবনের মালিক কীভাবে হলেন—জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই জায়গা তো রেল পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছে।’
নারায়ণগঞ্জ থেকে আসার পথে রাজধানীর জুরাইন রেলগেটে রেললাইনের কাছে এক পাশে জুরাইন নিউ সুপার মার্কেট। সেখানে এক শর মতো দোকান আছে। আর জুরাইন রেলওয়ে বাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির আছে অন্তত ৩০০ দোকান। রেলওয়ে বলছে, এই জায়গা তাদের। তবে কয়েকবার চেষ্টা করেও তারা জায়গা দখলমুক্ত করতে পারেনি। জুরাইনে রেললাইনের দুই পাশই প্রায় দখল হয়ে গেছে। সায়েবাবাদ পর্যন্ত একই অবস্থা। সায়েদাবাদ থেকে জুরাইন রেলগেট পর্যন্ত একবার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হলেও জায়গাগুলো দখলে কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় সেগুলোর বেশির ভাগই আবার বেদখল হয়ে স্থাপনা উঠেছে।
জুরাইন নিউ সুপার মার্কেট ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি সোলায়মান মিয়া বলেন, ‘এই জায়গা একসময় জলাভূমি ছিল। ১৯৮১ সালে রেল থেকে আমরা এই জায়গা ইজারা নিই। আমরা নিয়মিত ফি পরিশোধ করছি। কিন্তু তারপরও একটি মহলের চক্রান্তে এই জায়গায় উচ্ছেদ করতে এসেছিল রেল। আমরা স্থানীয় সাংসদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। পরে রেল কর্তৃপক্ষ চলে যায়। আমরা বলেছি, রেললাইন সম্প্রসারণ বা অন্য কিছু করা হলে এই জায়গা আমরা ছাড়ব। নয়তো রেললাইন থেকে ২০ ফুট দূরের এই জায়গা ভাঙার কোনো মানে নেই।’
রেলওয়ে সূত্র বলছে, নারায়ণগঞ্জ থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার রেললাইনের দুই পাশের ১৭২ একর জমি দখল করে নিয়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এ পথে ছোট-বড় বাজারের সংখ্যা অর্ধশতাধিক। জাল দলিল ও কাগজপত্র তৈরি করে আবাসন কোম্পানি ভবনও তুলছে। বিমানবন্দর ও তেজগাঁও রেলস্টেশন এলাকায় ১৯ একর, নারায়ণগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনের বাইরে ২৯ একর জমি দখল হয়ে গেছে। তেজগাঁও রেলওয়ে বস্তিতে প্রায় আড়াই হাজার ঝুপড়ি ঘর রয়েছে। এসব ঘরের ভাড়া তুলছে কিছু ব্যক্তি। খিলগাঁও রেলওয়ে ক্রসিংয়ের দুই পাশে অবৈধ দোকানপাট রয়েছে তিন শতাধিক। সাবেক রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সময়ে ওই সব দোকানের অধিকাংশ উচ্ছেদ করলেও পরে আবার বেদখল হয়। একইভাবে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেললাইনের দুই পাশের অনেক জায়গা বেদখলে। সিলেটের শায়েস্তাগঞ্জ, জামালপুরসহ বিভিন্ন স্থানেও একই অবস্থা।
কোথাও মার্কেট, কোথাও বাড়ি, কোথাও আবার বস্তি, লাখো–কোটি টাকার জমি উদ্ধার করতে ব্যর্থ রেল, বছরে ক্ষতি হাজার কোটি টাকা
ঢাকা বিভাগের রেলওয়ে ভূসম্পদ কর্মকর্তা নুরুন্নবী কবির বলেন, ‘টঙ্গী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত অনেক জায়গা দখল হয়ে আছে। আমরা অনেক সময়ই উচ্ছেদ অভিযান চালাই। কিন্তু পরে আবার দখল হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, আগে সরকারি জায়গা দখল করার এত প্রবণতা ছিল না। কিন্তু এখন সেই প্রবণতা বেড়েই চলছে।
ঢাকা ছাড়া চট্টগ্রামে রেলের ২২৩ একর জায়গা দখল হয়ে আছে। এর মধ্যে অবশ্য ১৫০ একরই বিভিন্ন সরকারি-আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের দখলে। আর বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দখলে আছে ৭৩ একর জমি। পাকশীতে দখল করা জমির মধ্যে ২ হাজার ৫৮ একরই বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের দখলে। লালমনিরহাটে রেলের ৮৪১ একর জমি বিভিন্ন ব্যক্তির দখলে আছে। আমাদের স্থানীয় প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, এসব এলাকায় রেলের জায়গা দখল করে মার্কেট, এমনকি রিসোর্টও বানানো হয়েছে।
জমি উদ্ধারে ব্যবস্থা নেয় না রেল: বর্তমানে রেলওয়ের ১৩ হাজার ২৩ একর জমি ইজারা দেওয়া আছে। আর ১২ হাজার একর জমি অব্যবহৃত পড়ে আছে। অভিযোগ আছে, রেল কর্তৃপক্ষই তাদের জমি উদ্ধারে কোনো ব্যবস্থা নেয় না। বিশেষ করে জমি উদ্ধার কার্যক্রম চালানোর জন্য যে পরিমাণ বরাদ্দ দরকার, তা দেওয়া হয় না। ১৯৭৬ সালে রেলওয়েতে পৃথকভাবে পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলে প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তার কার্যালয় করে যে জনবলকাঠামো করা হয়, সেই জনবলও নেই। বিশেষ করে পশ্চিমাঞ্চলে জনবলের অভাবে ৯২ থেকে ৯৩ শতাংশ সম্পদের ওপরই রেলওয়ের নিয়ন্ত্রণ নেই।
পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা আবদুল মান্নান বলেন, ‘রেলের কোটি কোটি টাকার সম্পদ বেদখল হয়ে যাচ্ছে। অথচ শুধু সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা থেকেই শত শত কোটি টাকা আয় করতে পারত রেল। কিন্তু আমাদের সম্পদ রক্ষার জন্য জনবল নেই। উচ্ছেদ অভিযান চালানোর জন্য বছরে মাত্র দুই লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। এই টাকা দিয়ে কয়টা অভিযান চালানো সম্ভব? সমস্যাগুলোর সমাধান করা গেলে আমরাই বছরে অন্তত ৫০০ কোটি টাকা আয় করতে পারতাম।’
পশ্চিমাঞ্চলে কোথায় কোথায় রেলের সম্পদ দখল হয়ে আছে জানতে চাইলে আবদুল মান্নান বলেন, ‘সৈয়দপুর শহরে আমাদের ১২ আনা জমিই দখলে। শুধু পৌরসভাই শহরের কেন্দ্রে ২৫ একর জমি দখল করে রেখেছে। লালমনিরহাট, বগুড়া, রংপুর, কুষ্টিয়ায় অনেক জায়গা দখল হয়ে আছে। যে যেভাবে পারছে দখল করে রেখেছে। আমার মনে হয়, রেলের ভূ-সম্পত্তি শাখার চেয়ে অসহায় কেউ নেই।’
রেলের পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা কামরুল আমিন বলেন, ‘রেলের অনেক জায়গাই দখল হয়ে আছে। আমরা সাধ্যমতো উচ্ছেদ অভিযান চালানোর চেষ্টা করি। কিন্তু জনবল ও অর্থের সংকট। তবু আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি।’