খোলা বাজার২৪, বুধবার, ৯ ডিসেম্বর ২০১৫: রফিক-সাহানা (ছদ্মনাম) দম্পতির একমাত্র ছেলে তনয়ের বয়স ১৮ পার হয়েছে কিছুদিন আগে। ওর যখন সাত বছর বয়স, তখন তাঁরা ছেলের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ছেলের নামে কিছু জমি কিনে রেখেছিলেন। এর মধ্যে তনয়ের বাবার কিছু টাকা প্রয়োজন পড়ল হঠাৎ করে। কিন্তু হাতে অত টাকাপয়সা নেই। ভাবলেন তনয়ের নামে যে জমিটা কিনেছিলেন তার কিছু অংশ বিক্রি করে দেবেন। কিন্তু তনয় তো এখন প্রাপ্তবয়স্ক। আইন অনুযায়ী জমির মালিক তো তিনি। ছেলের নামে কেনা জমি কি তিনি এখন বিক্রি করতে পারেন?
২.
দুই ভাইবোনের মধ্যে মিতু (ছদ্মনাম) বড়। মিতু স্নাতক হয়েছেন একটি নামকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মা-বাবা মিতুর বিয়ের জন্য পাত্র ঠিক করেছেন। কিন্তু মিতু এখনই বিয়ে করতে চান না। তাঁর ইচ্ছা একটা ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করবেন। নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে নিজের পছন্দমতো বিয়ে করবেন। কিন্তু মিতুর মা-বাবা, আত্মীয়স্বজনেরা জোরাজুরি করছেন বিয়ের জন্য। মিতুকে কি তাঁর অমতে জোর করে বিয়ে দিতে পারবেন তাঁর মা-বাবা?
সন্তানের মতামতের গুরুত্ব
সন্তান যখন সাবালক হন তখন তাঁর নিজের অধিকার নিজেই বুঝে নিতে পারেন। জীবনের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারেন। বিয়ে, চাকরি, পড়াশোনা ইত্যাদি বিষয়ে নিজে আইন অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিলে তা বৈধ বলে বিবেচিত হবে। তাই প্রাপ্ত বয়স্ক সন্তানের মতামতের গুরুত্ব মা-বাবাকেও অনুধাবন করতে হয়। সন্তান যখন প্রাপ্তবয়স্ক হন, তখন সন্তানের আইনগত সত্তার জন্ম হয়। অর্থাৎ সন্তানের নিজের চিন্তাভাবনা, নিজের মত প্রকাশ এবং নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেওয়ার আইনগত অধিকার জন্মে। আইনের চোখে তখন সন্তান একজন বৈধ নীতিনির্ধারকও বটে। আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী সন্তানের বয়স ১৮ পূর্ণ হলেই তাঁকে সাবালক বা প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে গণ্য করা হয়। এ বয়স পার হলে একজন মানুষ রাষ্ট্রের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকও বটে। তখন থেকে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের যা যা অধিকার রয়েছে, এ অধিকার তিনিও ভোগ করার অধিকারী। তাঁকে তাঁর অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।
সম্পত্তি এবং বিয়ের অধিকার
আইন অনুযায়ী মা-বাবা যদি সন্তানের নামে জমি কেনেন এবং সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে এ জমি সন্তানের কাছেই হস্তান্তর করতে হয়। আইন অনুযায়ী সন্তানই তখন এ জমির মালিক। এ সম্পত্তি নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত সাবালক সন্তান নিজেই নিতে পারেন। সন্তানকে ত্যাজ্যপুত্র করার বিধানও আইনে নেই।
ওপরের ঘটনা দুটোর প্রথমটির ক্ষেত্রে বলা যায়, তনয়ের অনুমতি ছাড়া এবং তনয় নিজে বিক্রি না করলে এ সম্পত্তি তাঁর মা-বাবা বিক্রি করতে পারবেন না।
আবার বিয়ের ক্ষেত্রেও সন্তানের মতামতের গুরুত্ব আছে। দ্বিতীয় ঘটনাটির ক্ষেত্রে মিতু তাঁর নিজের বিয়ে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে পারেন। অনেক সময় দেখা যায়, দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নিজেরা আইন অনুযায়ী পরিবারের অমতে বিয়ে করলে মেয়ে পক্ষের লোকজন অপহরণের মামলা ঠুকে দেয়। এতে করে সন্তানের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়ে। আইন অনুযায়ী সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলে এবং নিজেরা বিয়ে করলে মিথ্যা মামলা দিয়ে কোনো ফল পাওয়া যায় না।
মা-বাবার সিদ্ধান্তের মূল্য নেই?
সন্তান প্রাপ্তবয়স্ক হলেও তার নিজের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে মা-বাবার সিদ্ধান্তকে একদম উড়িয়ে দিলে চলবে না। যদিও এ সিদ্ধান্ত মানার বিষয়টি নৈতিক বিষয়ের সঙ্গে জড়িত। প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেলে নিজের সিদ্ধান্তগ্রহণে মা-বাবার মতামতকে গুরুত্ব দিতে শিখতে হবে। কোনো কারণে মা-বাবার সঙ্গে অমত হলে মা-বাবার সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনায় বসে সমাধান করতে হবে। বাবা-মায়ের নিজের নামে সম্পত্তি থাকলে তা প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানেরা চাইলেই ভোগদখল করতে পারবেন না। মা-বাবার নামে থাকা সম্পত্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানেরা নিতে পারবেন না। বাবা কিংবা মা যে কারও অবর্তমানে বাবা বা মা যিনি বেঁচে আছেন, তাঁর প্রাপ্য সম্পত্তি দেওয়ার পরই নিজেরা সম্পত্তির ভাগ নিতে পারবেন। মনে রাখতে হবে, সন্তান কর্মক্ষম হলে মা-বাবার ভরণপোষণ দিতে সন্তানেরা বাধ্য। দেশে ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন, ২০১৩’ নামের একটি আইন বলবৎ রয়েছে। এই আইনে প্রত্যেক কর্মক্ষম সন্তানকে তাঁর মা-বাবার ভরণপোষণের নিশ্চয়তা দিতে হবে, এই বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী পিতামাতা তাঁর কর্মক্ষম সন্তানের কাছে ভরণপোষণ না পেলে আইনের আশ্রয় নিতে পারেন।
লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট