খোলা বাজার২৪,বুধবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৫: বাংলাদেশের ২৩৪ পৌরসভায় নতুন জনপ্রতিনিধি বেছে নিতে ব্যাপক নিরাপত্তার মধ্যে ভোট শুরু হয়েছে, যাতে প্রথমবারের মতো মেয়র পদের লড়াই হচ্ছে দলীয় প্রতীকে।
এসব নির্বাচনী এলাকায় ভোটার রয়েছে ৭১ লাখ, যা দেশের মোট ভোটারের মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ। তবে ৭ বছর পর নৌকা-ধানের শীষের লড়াইয়ের আভাসে এই ভোট ইতোমধ্যে রাজনৈতিক ‘মর্যাদার’ লড়াইয়ে পরিণত হয়েছে।
শীতের কুয়াশার মধ্যে বুধবার সকাল ৮টায় এসব পৌর এলাকায় কেন্দ্রে কেন্দ্রে ভোট শুরু হয়েছে, যা চলবে বিকাল ৪টা পর্যন্ত।
নির্বাচন কমিশনের উপ সচিব মো. সামসুল আলম বলেন, “ভোটের শুরুতে কোথাও বড় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাইনি। প্রথমবারের মতো দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন হওয়ায় কোথাও কোথাও উত্তেজনা হতে পারে, তবে তা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দেখভাল করেছে। নির্বাচনের সার্বিক বিষয়ে কমিশনের মনিটরিং সেল তথ্য সংগ্রহ করছে।”
মেয়র, সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদের তিন সহস্রাধিক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন ১২ হাজারেরও বেশি প্রার্থী।
ঢাকার সাভার পৌরসভায় পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ কেন্দ্রের সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা খন্দকার শওকত আলী জানান, তার কেন্দ্রে নির্ধারিত সময়েই ভোট শুরু হয়েছে। সব শান্তিপূর্ণভাবেই চলছে।
সকালে কুয়াশা আর শীতের মধ্যে এই কেন্দ্রের বাইরে খুব বেশি ভোটারকে লাইনে দাঁড়ানো দেখা না গেলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটার বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেন এই নির্বাচনী কর্মকর্তা।
আগের রাতে ঢাকার সাভার পৌরসভার রাজাসন এলাকার আল-হেরা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্র দখল করে ব্যালটে সিল মারার চেষ্টা করে একদল সন্ত্রাসী।
সকালে ভোট শুরুর আগেই অবৈধভাবে ব্যালটে সিল দেওয়ার ঘটনায় কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার লতিফপুর এবং মাদারীপুরের কালকিনি উপজেলার কাষ্ঠগড় ও দক্ষিণ জোনারদণ্ডি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
ভোট শুরুর আগে ব্যালটে সিল দেওয়ায় কুমিল্লা ও মাদারীপুরে তিনটি কেন্দ্রের ভোট স্থগিত করা হয়েছে।
ভোটের প্রচারে অন্তত অর্ধশতাধিক পৌরসভায় হামলা-সংঘর্ষের পর দলভিত্তিক পৌর নির্বাচন হওয়ায় উৎসবের এ ভোটে শঙ্কাও করছে অনেকে।
দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি বলছে, নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনের অংশ হিসেবে পৌর ভোটে তাদের অংশগ্রহণ।
অর্থাৎ এই ভোটে তাদের জয় হলে সেটা নির্দলীয় সরকারের প্রতি মানুষের সমর্থন হিসেবে তুলে ধরবে তারা।
অন্যদিকে এই ভোটে হারলে ‘আকাশ ভেঙে পড়বে না’ বলে মন্তব্য করলেও আওয়ামী লীগ নেতারা আশা করছেন, সরকারের উন্নয়নের প্রতি সমর্থনের প্রকাশ ঘটবে নৌকার জয়ের মাধ্যমে।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা জানিপপ’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহও মনে করেন, এবার দলীয় প্রতীকে হওয়ায় স্থানীয় সরকারের এ ভোট ভিন্ন আমেজ এনেছে।
“দলগুলোর মধ্যেও বিরাজ করছে অনেকটা মর্যাদার লড়াইয়ের মতো অবস্থা,” বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন তিনি।
২০১১ সালে চার ধাপে আড়াই শতাধিক পৌরসভায় ভোটে প্রার্থীরা দলের সমর্থন নিয়ে ভোট করেছিল। তাতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিজয়ী মেয়র প্রার্থী ছিলেন প্রায় সমান-সমান।
গত ২৪ নভেম্বর দশম পৌর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি বক্তব্য শুরু হয়; বিভিন্ন স্থানে সংঘাত ও সংঘর্ষেও গড়ায় তা।
প্রচার শেষে ভোটের আগের দিন মঙ্গলবারও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তাদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি পাল্টাপাল্টি নালিশ নিয়ে ইসিতে গিয়েছিল।
বিধিভঙ্গের বিরুদ্ধে শুরু থেকে কঠোর হতে না পারার সমালোচনায় বিদ্ধ নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ দাবি করেছেন, পক্ষপাতমুক্ত ভাবেই কাজ করছেন তারা।
মঙ্গলবার রাতে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা’ ছাড়া সবাই আচরণবিধি মেনেই প্রচারণা চালিয়েছেন।
“ইতোমধ্যে উৎসবমুখর পরিবেশে প্রচার শেষ হয়েছে, আরও সুন্দরভাবে সবার অংশগ্রহণে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ভোটাররা নির্ভয়ে এসে যাকে পছন্দ তাকে ভোট দেবেন।”
১০০ কোটি টাকা ব্যয়ের এই পৌর নির্বাচনে নির্বিঘেœ ভোট দেওয়ার সব পরিবেশই নিশ্চিত করা হয়েছে বলে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দাবি।
নির্বাচনী বিধি লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোতে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব রিটার্নিং কর্মকর্তাদের উপর ছেড়ে দেওয়ার মধ্য দিয়ে ইসির দায় এড়ানোর চেষ্টার প্রতিফলন দেখতে পেয়েছেন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অনেকে।
এই সমালোচনার মধ্যে ভোটের আগের দিন কঠোর হওয়ার হুঁশিয়ারি দিলেও মূল দায়িত্ব মাঠ কর্মকর্তাদের হাতেই ছেড়ে দিয়েছেন সিইসি।
“নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যদের ওপর রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিরপেক্ষভাবে আইন মোতাবেক পালন করতে আমি নির্দেশ দিচ্ছি। নির্বাচন কমিশন এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের শৈথিল্য, অনিয়ম বা পক্ষপাতিত্ব বরদাশত করবে না, এ কথা স্মরণ করে দিচ্ছি।”
১২ হাজারের বেশি প্রার্থীর মধ্য থেকে তিন সহস্রাধিক জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে সাড়ে ৩ হাজার কেন্দ্রে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোট দেবেন ৭০ লাখ ৯৯ হাজার ১৪৪ পৌরবাসী।
মেয়র পদে ভোট দলীয় প্রতীকে হলেও সাধারণ ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ভোট হবে আগের মতোই নির্দলীয়ভাবে, যদিও তাতেও রয়েছে রাজনৈতিক আবহ।
ভোটের প্রচারে অর্ধ শতাধিক পৌরসভায় হামলা-সংঘর্ষের পর ভোটের দিন অনেকের মধ্যে শঙ্কা কাজ করলেও সিইসি বলছেন, নির্বিঘেœ ভোট দেওয়ার সব ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে।
সেনা মোতায়েনে বিএনপির দাবি প্রত্যাখ্যান করেই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর লক্ষাধিক সদস্যকে নিরাপত্তার কাজে রেখেছে ইসি; যে সংখ্যাকে পর্যাপ্ত মনে করছেন কাজী রকিব।
ইসির উপ-সচিব সামসুল আলম জানান, পুলিশের প্রায় ৪৫ হাজার সদস্য, বিজিবির ৯ হাজার ৪১৫ সদস্য, র্যা বের ৮ হাজার ৪২৪ সদস্য, কোস্টগার্ডের ২২৫ সদস্য, আনসার-ভিডিপির ৪৯ হাজার ৭২৮ সদস্য এবং ব্যাটালিয়ন-আনসার ৪ হাজার ৫১২ সদস্য চার দিনের জন্য মাঠে রয়েছে।
ভোটের দিন ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রে ২০ জন ও সাধারণ কেন্দ্রে ১৯ জন নিরাপত্তা সদস্য নিয়োজিত রয়েছেন। এসব পৌরসভায় মোট ভোটকেন্দ্রের এক-তৃতীয়াংশ ভোটকেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ।
এছাড়া সোমবার থেকে মাঠে রয়েছেন ১ হাজার ২০৪ জন নির্বাহী ও বিচারিক হাকিম। বিধি লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা ঘটলে তাৎক্ষণিক বিচার করার দায়িত্ব তাদের।
আ. লীগের ৭ মেয়র বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়
এবার ২৩৪ পৌরসভায় একজন করে মেয়র, সংরক্ষিত ৭৩১টি ও সাধারণ কাউন্সিলর কাউন্সিলরের ২ হাজার ১৯৩টি পদ রয়েছে।
ইসির নির্বাচন পরিচালনা শাখার উপ সচিব সামসুল আলম জানান, ২৩৪ পৌরসভা নির্বাচনে ২০টি রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র মিলিয়ে মেয়র পদে ৯৪৫ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী রয়েছেন।
এরমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের সাতজন মেয়র প্রার্থী নির্বাচিত হয়েছেন।
২৩৪ পৌরসভার মধ্যে আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রার্থী মুখোমুখি রয়েছেন ২২২টিতে।
সাধারণ কাউন্সিলর পদে ৮ হাজার ৭৪৬ জন ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ২ হাজার ৪৮০ জন প্রার্থী।
এদের মধ্যে কাউন্সিলর পদে ৯৪ জন ও নারী কাউন্সিলর পদে ৪০ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন।
৭ ওসি, ২ রিটার্নিং কর্মকর্তা প্রত্যাহার
প্রচারের সময় বিধি লঙ্ঘন-হামলার অভিযোগে ১১৪টি বিষয় খতিয়ে দেখার জন্যে রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিল ইসি, যার অধিকাংশের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে মাঠ পর্যায় থেকে প্রতিবেদন আসে।
ইসির এই পদক্ষেপটি নিয়ে শুরু থেকেই সমালোচনা আসে। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা প্রভাবমুক্তভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে সাহসী হতে পারেন না মন্তব্য করে সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেছিলেন, রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিয়ে ইসি দায় এড়াচ্ছে।
বিএনপি শুরু থেকেই অভিযোগ করে আসছিল, মন্ত্রী-এমপিরা বিধি ভঙ্গ করে প্রচার চালালেও ইসি কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। সেই কথায় সায় আসে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের কাছে থেকও।
শেষ দিকে এসে আওয়ামী লীগ পাল্টা অভিযোগ তুলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দাবি করে, বিএনপির মিথ্যাচারে ‘বিভ্রান্ত’ হয়ে ইসি তাদের ‘বাড়তি সুবিধা’ দিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দল থেকে ইসির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেও এসব বক্তব্য নিছক ‘রাজনৈতিক’ বক্তব্য হিসেবেই নেন সিইসি।
তিনি বলেন, “রাজনৈতিক দল তাদের বক্তব্য দিয়েছেন, আপনারাও শুনেছেন। আমরা কিন্তু বিএনপি, আওয়ামী লীগ, স্বতন্ত্র হিসেবে বাছ-বিচার করছি না, আমরা করবও না। যেখান অভিযোগ পাচ্ছি ক্রসচেক করছি, খবর নিচ্ছি, তারপর অ্যাকশন নিচ্ছি।”
অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় ইসি ইতোমধ্যে দুজন রিটার্নিং কর্মকর্তা, অন্তত সাতটি থানার ওসির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে বলে জানান সিইসি। সাতজন সংসদ সদস্যকে সতর্ক করার কথাও বলেন তিনি।
ভোটে দায়িত্বরত নির্বাহী হাকিমরা মঙ্গলবার পর্যন্ত ১৯১ জনকে ১০ লাখ ২৬ হাজার ৩০০ টাকা জরিমানা এবং চারজনকে কারাদণ্ড দিয়েছে বলেও তুলে ধরা হয় সাংবাদিকদের সামনে।
পর্যবেক্ষণে ১০ সহস্রাধিক
ইসির জনসংযোগ শাখার সহকারী পরিচালক আরাফাত আরা জানান, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ১০টি করে সংস্থার বিরুদ্ধে পর্যবেক্ষণে আপত্তি জানালেও শেষ পর্যন্ত তাতে সাড়া দেয়নি ইসি।
“এসব সংস্থার ভোট পর্যবেক্ষণে কোনো বাধা নেই। কাউকে বিরত রাখার বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি,” বলেন তিনি।
পৌর ভোটে ২৯টি সংস্থার চার সহস্রাধিক পর্যবেক্ষককে অনুমোদন দিয়েছে ইসি। সেই সঙ্গে ঢাকার গণমাধ্যমের জন্য দুই হাজার সাংবাদিককে পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছে।
ইসির জনসংযোগ শাখা জানায়, স্থানীয় পর্যায়ের অন্তত চার হাজার সাংবাদিককে ভোটের সংবাদ সংগ্রহে কার্ড সরবরাহ করা হয়েছে।
পৌর নির্বাচনে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে কোনো বাধা সৃষ্টি হবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন কাজী রকিব। সেই সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণে সাংবাদিকদের সহায়তাও চেয়েছেন তিনি।