খোলা বাজার২৪, মঙ্গলবার, ৫ জানুয়ারি ২০১৬: দেশলাইয়ের বাক্সে পোরা মসলিনের পুরো একটা শাড়ি। কখনো গুটিপোকা থেকে তৈরি রাজশাহীর পেলব রেশম। কারও কাছে মায়ের ট্রাঙ্কে তোলা বিয়ের সেই বেনারসিখানা। দেশি পোশাকের ঐতিহ্য শব্দটি বলতে এখনো আমরা এভাবে আবেগময় হয়ে উঠি। সেই পরিচিত দেশি কাপড় এখন অনেক আধুনিক। জমিন, তাতে ফোটানো মোটিফ, এক একটা সুতোর ফোঁড়ে তোলা সেলাই রয়ে গেছে আগের রূপ, রং, গন্ধ নিয়ে। শুধু পাল্টে গেছে রঙের শেড, ছাঁট আর পরার ধরন। দেশি পোশাক এখন বিশ্বজনীন হওয়ার পথে।
.আজরা মাহমুদ। ফ্যাশন আর মডেলিংয়ে জড়িত সেই কবে থেকে। বিয়ে করেছেন বছর খানেক হলো। বিয়ের দিন সেজেছিলেন জামদানিতে। শুধু শখ করে বা দেশি ফ্যাশনের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে নয়। আজরা বলেন, ‘মডেলিংয়ের খাতিরে কত পোশাকই তো পরি। প্রাচ্যের, পাশ্চাত্যের। কিন্তু আমাদের জামদানির মোটিফের মতো কিছু নয়। খুব আপন একটা অনুভব জন্ম দেয়, একই সঙ্গে ফুটিয়ে তোলে আভিজাত্য।’
আজরার মতো আরও অনেকেই দেশি শাড়িকে এখন আধুনিকতার রং দিতে সচেষ্ট। এবং তা জীবনের সঙ্গে মিলিয়েই। শুধু পরনের জন্য নয়। দেশি শাড়িকে অন্য মাত্রা দেওয়ার এই চেষ্টা স্পষ্ট হয়েছে গত বছর, ২০১৫ সালে। ফ্যাশন ডিজাইনার লিপি খন্দকার বলেন, ‘বছরের শুরুতে এফডিসিবি (ফ্যাশন ডিজাইনারস কাউন্সিল অব বাংলাদেশ) আয়োজন করেছিল টাঙ্গাইলের বয়ন শিল্পের কাব্যকথা। শাড়ি পরা তো কমে গেছে ব্যস্ততার কারণে। তাই ওই প্রদর্শনীতে আমরা দেখিয়েছি টাঙ্গাইলের কাপড় থেকে কীভাবে আধুনিক ডিজাইন ফোটানো যায়।’ সে বছরই লিপি খন্দকার নিজের হাউস বিবি আনা থেকে আয়োজন করেছিলেন ঐতিহ্যবাহী সূচিশিল্প নিয়ে একক প্রদর্শনীর। বছরের শেষটা মাতিয়েছে খাদি উৎসব। খাদি কাপড়েই তৈরি হয়েছে শাড়ি, টপ, কুর্তি, ট্রাউজার এমনকি স্যুট, ট্রেঞ্চকোট।
নতুন বছরে নজর ফেরাই। গত বছরের শুরু হওয়া প্রচেষ্টাগুলো কি এ বছর নতুন কোনো সিঁড়ি পাবে? হাউসগুলোর প্রদর্শন দেখলে আশা জাগে মনে। অরণ্য, প্রবর্তনা, যাত্রা, রঙের মতো হাউসগুলো শাড়িতে দেশি মোটিফ আর রং নিয়ে কাজ করছে সেই কবে থেকে। অরণ্যর ভেজিটেবল টাইডাইয়ের কাজ আরও নিখুঁত হয়েছে, সুতি ছাড়াও সিল্কের শাড়িতে কাঁথা ফোঁড়ের সূক্ষ্ম টান টান আমাদের আশাবাদী করে।
যাত্রার অগ্রযাত্রা এখনো বিরাজমান। অ্যান্ডি শাড়িতে সুই সুতার পাড়, গামছা প্রিন্টের টানা কাপড় কিংবা দেশি জামদানি দিয়ে আধুনিক ছাঁটের টপ, সুতার টানে বেল্ট লাইন আর ভিন্ন ছাঁটের ট্রাউজার দারুণ মানানসই হয়ে ওঠে আমাদের ফ্যাশনধারাতে।
এ নিয়ে কথা হচ্ছিল ফ্যাশন ডিজাইনার ও বাংলাদেশ জাতীয় কারুশিল্প পরিষদের সদস্য শাহিদ হোসেন শামীমের সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘শাড়িতে টাইডাই, ব্লকপ্রিন্ট আর শিবোরি চলবে আরও অনেক অনেক দিন। এই কৌশলগুলো দৃষ্টিনন্দন, মার্জিত ও মানানসই। এ বছর ভেজিটেবল ডাইয়ের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়বে আরও, সিল্কের পাশাপাশি সুতির শাড়িতেও দেখা যাবে প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার। রঙের মাঝে একটা বৈশ্বিক প্রভাব পড়বে। বাইরের দেশে ২০১৮ সাল পর্যন্ত কালার প্রেডিকশন (কোন রং চলবে তার ধারণা দেওয়া) করে রাখা আছে। যত দিন না আমরা নিজেদের বুননের মাপ, মান আর রং ঠিক না করতে পারব, তত দিন আমাদের ওই মান অনুযায়ী চলতে হবে।’
.এই বৈশ্বিক প্রভাব কতটুকু পাল্টে দিচ্ছে আমাদের পোশাক? এটি কী আসলেই ভালো হচ্ছে আমাদের জন্য? তরুণ ডিজাইনার আফসানা ফেরদৌসীর মতে, পরিবর্তন যা-ই হচ্ছে, শুধুই রঙে, ডিজাইনে আর অলংকরণে সীমাবদ্ধ থাকুক। মূল উপকরণ, মানে কাপড়খানা হোক দেশি। তিনি বললেন, ‘কিছুদিন আগে খাদিতে শীতলপাটির মোটিফ নিয়ে কাজ করেছি। সেই কাজটি করতে গিয়েই দেখেছি, আমাদের সাদামাটা শীতলপাটির নকশার ভান্ডার কত সমৃদ্ধ। দেশের লোকজ ঐতিহ্যকেই চাইলে আধুনিক ছাঁটে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব। তবে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন ট্রেন্ড অনুসরণ করাকে আমি নেতিবাচক চোখে দেখি না। সময়ের সঙ্গে এগোলেই সম্ভব দেশি বুননকে সামনে নিয়ে যাওয়া। যেমন এ বছর রং বলতে প্যাস্টেল শেডের রংগুলোর প্রচলন বাড়বে বেশি। জ্যামিতিক নকশা, বড় বড় ফুল বেশি চলবে। সেগুলোই শাড়িতে ফুটিয়ে তোলা যায় এবং দেশি কৌশলেই।
সিল্কের জমিনজুড়ে সূক্ষ্ম কাঁথা ফোঁড়, আঁচলে নজরকাড়া কাজঅনলাইনে যাঁরা কেনাকাটা করেন, তাঁদের অনেকের কাছে পোশাকের খাঁটি দেশি ভাবটাই পছন্দ। সাবিহা আকন্দের অনলাইন শপ মেনকা সম্পূর্ণ দেশি শাড়ি নিয়ে কাজ করছে বেশ কিছুদিন হলো। তাঁর বেশির ভাগ ক্রেতাই থাকেন দেশের বাইরে। দেশি তাঁত, সুতির কাজ আর সর্বোপরি সুতির শাড়ির জন্য তাদের চাহিদা সব সময় আকাশচুম্বী থাকে। তাঁদের জন্য মাঝেমধ্যে পঞ্চগড়, বগুড়া, যশোর থেকেও শাড়ি এনে দিতে হয়। ‘গত বছর একরঙা, একপেড়ে শাড়ির চাহিদা ছিল প্রবল। এখন সুতির শাড়িতে বালুচরি আর কাতানের কাজ বেশি পছন্দ করছেন ক্রেতারা। হাতের কাজের মাঝে নকশি কাঁথার কাজের জন্য আগ্রহ বাড়বে। সেটি শাড়িতেই হোক বা অন্য পোশাকে।’ বললেন সাবিহা।
সিল্কের জমিনজুড়ে সূক্ষ্ম কাঁথা ফোঁড়, আঁচলে নজরকাড়া কাজতবে দেশি মোটিফের জন্য এই আগ্রহ কি ধরে রাখতে পারব আমরা? অঞ্জনসের প্রধান নির্বাহী শাহীন আহমেদ বললেন, ‘গত বছর বাইরের সস্তা কাঁচামালের সঙ্গে টিকে থাকতে প্রচুর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছে দেশি কাঁচামালকে। ফলে দাম হয়ে গেছে চড়া। কিন্তু ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতা তো আমরা বাড়াতে পারি না। তার ওপর গত বছরই সরকার বিদেশি পোশাকের ওপর করের হার কমিয়েছে, প্রবেশ করেছে সহজ। এরপরও দেশি শাড়ি কিন্তু টিকে ছিল শুধুই আমাদের ক্রেতাদের ভালোবাসা আর আগ্রহের জোরে। এই বছরও যদি বিদেশি শাড়ি ও পোশাকের বাজার নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, মধ্যবিত্তের এই দেশে দেশি শাড়ির ক্রেতাদের কতটুকু ধরে রাখা যাবে, তা নিয়ে শঙ্কা রয়েই যায়।’
বিদেশি শাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে আমাদের শাড়িকেই তাই আধুনিক করার প্রতি জোর দিলেন সবাই। কেননা সেটি দেশি কাপড়, মোটিফ আর অলংকরণেই সম্ভব। নইলে হয়তো সত্যিই কোনো দিন এ দেশের মেয়েদের বিয়ের পোশাকে জবরজং লেহেঙ্গা ছাড়া আর কিছু দেখা যাবে না।
আমরা কি তা হতে দেব