Sat. Jun 21st, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements
tmpphpmFk74iখোলা বাজার২৪,শনিবার, ১৬ জানুয়ারি ২০১৬:রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল-কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের বেতন অস্বাভাবিকহারে বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয়েছে চরম নৈরাজ্য। কোন কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বেতন দ্বিগুন পর্যন্ত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের এই বেতনের হার অস্বাভাবিকহারে  বৃিদ্ধ করায় ক্ষুদ্ধ হয়েছেন অভিভাবকরা। এর প্রতিবাদে তারা নেমেছেন রাস্তায়। পালন করছেন কর্মসূচি। ফলে সৃষ্টি হয়েছে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির। সঙ্কট সমাধানে সরকারের তরফেও তেমন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছেনা। গত দুই সপ্তাহে তারা বিভিন্ন স্কুলের সামনে মানববন্ধন, শিক্ষামন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেওয়া ও অবস্থান ধর্মঘটের মতো কর্মসূচি পালন করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ না দেখে অভিভাবকরা প্রকাশ করেছেন ক্ষোভ।
নতুন পে-স্কেল কার্যকর হয়েছে এ অজুহাতে স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের বেতন-ফি বাড়ানোর কারণেই সৃষ্টি হয়েছে এই  নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির। এছাড়া বছরের প্রথম মাস থেকে স্কুলে ভর্তিতে গলাকাটা ফি আদায় করছে রাজধানীর নামিদামি স্কুলগুলো। পে-স্কেলে বেতন বেড়েছে প্রায় শতভাগ। তাই শিক্ষকদের বেতন বাড়াতে হবে। এজন্য বাড়ছে স্কুলের বেতন। এমন সব নোটিশ ঝুলিয়ে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ, আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজ, উইলস লিট্ল ফ্লাওয়ার স্কুলসহ বিভিন্ন স্কুল এবং কলেজে বাড়তি বেতন ও ফি আদায় করা হচ্ছে। বেতন-ফি বাড়ানো স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, রাজধানীর নামিদামি বেশির ভাগ বেসরকারি স্কুলে প্রায় ৭০ ভাগের বেশি শিক্ষক চুক্তিভিত্তিক। অর্থাৎ তারা সরকারি কোনো অনুদান পান না। স্কুলের নিজস্ব ফান্ড থেকে তাদের বেতনভাতা দিতে হয়। এই শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সমান বেতন ভাতা দিতে হয়। কখনও বেশি দিতে হয়। এজন্য স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন ভাতা বাবদ খরচ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। এসব টাকা প্রধান উৎস শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন, উন্নয়ন ফি ইত্যাদি। এসব কারণে বেতন বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
তবে স্কুল কর্তৃপক্ষের এমন খোঁড়া দাবি মানতে নারাজ অভিভাবকরা। তারা বলছেন, কজন শিক্ষার্থীর অভিভাবক সরকারি চাকুরে? পে স্কেলে বেতন বাড়লেও অধিকাংশ অবিভাবকরাই সরকারের বেতনভোগী কর্মচারি নন। তাই পে স্কেলে বেতন বাড়ার কোন সুফলই তারা পাচ্ছেন না । সুতরাং শিক্ষার্থীদের বেতন বাড়ানোতে চরম অস্বস্থিতে পড়েছেন তারা। বাধ্য হয়েই নেমেছেন আন্দোলনে। তারা বলছেন, পে-স্কেল ইস্যুতে ৭০ থেকে ১০০% বেতনসহ অন্যান্য ভাতা বাড়িয়েছে স্কুলগুলো। নন এমপিও শিক্ষকদের বেতন দ্বিগুণ করা হলে শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন ১৫  থেকে ২০ ভাগ বৃদ্ধি করলেই সম্ভব। উদাহরণ টেনে রাজধানীর অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা স্কুলের অভিভাবক মেহেদী হাসান বলেন, ভিকারুননিসা নূন স্কুলে প্রায় ৭০০ শিক্ষকের মধ্যে ১৪৫ জন এমপিওভুক্ত। বাকি শিক্ষকদের বেতন দ্বিগুণ করলেও প্রতিষ্ঠানের অধ্যয়নরত প্রায় ২৪ হাজার শিক্ষার্থীর সর্বোচ্চ ২০০ টাকা বাড়ালেই হয়। শুধু বেতন দ্বিগুণ করলে প্রতিষ্ঠানটি অতিরিক্ত আয় হবে ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকা। শিক্ষকদের বেতন দ্বিগুণ করলেও এই টাকার প্রয়োজন হবে না। এ ছাড়া যাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয় তাদের বেতন খুবই কম। এটা সবাই জানে। তিনি বলেন, স্কুলগুলো পে-স্কেলের অজুহাতে লুটপাটের দোকান খুলেছে। শুধু ভিকারুননিসা নয়, প্রায় প্রত্যেকটি স্কুলে এই দ্বিগুণ ফি আদায় করা হচ্ছে।
একজন অভিভাবক জানান, তার মেয়ের তৃতীয় শ্রেণিতে গত বছর মাসিক বেতন ছিল ৮০০ টাকা। এবার সেটি দ্বিগুণ করে ১৫৫০ টাকা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, সেশন ফি, উন্নয়ন ফিসহ অন্যান্য ভাতাও বেড়েছে দ্বিগুণ। বছর শেষে মেয়ের পেছনে অতিরিক্ত খরচ বাড়বে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা। তিনি বলেন, আমি তো সরকারি চাকরি করি না। আমার বেতন তো বাড়েনি। আমি কেন বর্ধিত বেতন দিবো। এটা কোনোভাবে মেনে নেয়া যায় না। গত দুদিন এর প্রতিবাদ করেছি। আগামী রোববার চূড়ান্ত নোটিশে যদি বেতন এভাবে বাড়ানো হয় তবে আন্দোলন করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।
আরেকজন অভিভাবক অভিযোগ করেন, মিরপুর এলাকার একটি স্কুলের প্রথম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর মাসিক বেতন ধরা হয়েছে ১৮২৫ টাকা। গত বছরের তুলনায় বৃদ্ধির হার দ্বিগুণের চেয়ে বেশি। ওই অভিভাবক বিভিন্ন ফির বৃদ্ধির খাতওয়ারি দেখিয়ে বলেন, এর ফলে প্রথম শ্রেণির একজন শিক্ষার্থীর বার্ষিক খরচ বেড়ে যাবে ৩৩ হাজার ৯০০ টাকা। এটা কোনো অবস্থায় যুক্তিযুক্ত হতে পারে না।
অভিভাবকদের অভিযোগ, রাজধানীতে অধ্যয়নরত বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থীদের এলাকা অনুসারে ৩ থেকে ৫ ভাগ অভিভাবক সরকারি চাকরি করেন। বাকিরা ব্যবসা, বেসরকারি চাকরি করেন। অনেক অভিভাবক আছেন নিম্ন মধ্যবিত্ত। তাদের বেতন তো বাড়েনি। এ ছাড়া সরকারি চাকরিজীবীরা এখনও বর্ধিত বেতন ভাতা পায়নি। এই অবস্থায় বছরের শুরুতেই অতিরিক্তি আড়াই থেকে ৭ হাজার টাকা জোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে অধিকাংশ অভিভাবকদের। এ বিষয়ে রাজধানীরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অভিভাবকদের সংগঠন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, অনেক স্কুলে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি একলাফে দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে মগের মুল্লুক অবস্থা চলছে। কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়া এ বেতন ভাতা বৃদ্ধি কোনো ভাবে মানা হবে না। বেসরকারি স্কুলের উপর সরকারের কোনো খবরদারি নেই এই বেতন বৃদ্ধিতে । তার মতে, স্কুল ভর্তিতে এক সময়  ছিল। একটি নীতিমালার মাধ্যমে এটাকে বাগে আনা হয়েছে। এবার ভর্তি, উন্নয়ন ফিসহ অন্যান্য ভাতা নির্ধারণের জন্য নীতিমালা করা জরুরি। কিন্তু এ দিকে মনোনিবেশ নেই সরকারের। তিনি বলেন, কয়েকটি স্কুলের অভিভাবকরা আন্দোলন শুরু করেছেন।স্কুলগুলো পে-স্কেলের অজুহাতে লুটপাটের দোকান খুলেছে। প্রায় প্রত্যেকটি স্কুলে দ্বিগুণ ফি আদায় করা হচ্ছে,বলেন অভিভাবক ঐক্য ফোরামের এই নেতা।
ভিকারুননিসা নূন স্কুলে অধ্যক্ষ সুফিয়া খাতুন এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, আমার স্কুলে ৭০% বেশি নন-এমপিভুক্ত শিক্ষক। তাদের বেতনভাতা এমপিভুক্ত শিক্ষকদের মতো দিতে হয় এবং এটা পুরোটাই স্কুলের নিজস্ব আয় থেকে। স্কুলের নিজস্ব আয় বলতে শিক্ষার্থীদের বেতন, উন্নয়ন ফি, ভর্তির ফি বাড়ানো ছাড়া শিক্ষকদের বেতন বাড়ানো সম্ভব না। তবে সেটি কী পরিমাণ বাড়বে সেটি এখনও নির্ধারণ হয়নি বলে জানান তিনি।
মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বলেন, বেতনসহ অন্যান্য ফি দ্বিগুণ করা হয়েছে তা মিডিয়ার মাধ্যমে শুনেছি। কিন্তু কোনো অভিভাবক আমাদের কাছে অভিযোগ করেননি। অভিযোগ পেলে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেন তিনি। ভর্তি ফি নিয়ন্ত্রণে একটি কমিটি গঠন করা হতে পারে বলে জানান তিনি।
রাজধানীর বিভিন্ন বড় স্কুলের অভিভাবকরা জানিয়েছেন, বিয়াম স্কুল, উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুল, ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ, আইডিয়াল স্কুল, উদয়ন উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ, মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, মিরপুরের শহীদ পুলিশ স্মৃতি স্কুল, শহীদ লে. আনোয়ার গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ, বাংলাদেশ ব্যাংক আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি স্কুলে ৭০ থেকে ১০০ শতাংশ ফি বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া রেসিডেনশিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, সেন্ট জোসেফ উচ্চ বিদ্যালয়, ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল, সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়, জুনিয়র ল্যাবরেটরি স্কুলসহ বেশ কয়েকটি স্কুলে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ফি বাড়ানোর প্রক্রিয়া চলছে। অভিভাবকরা বলছেন, সব স্কুলে এখনও চূড়ান্ত ফির নোটিশ দেয়নি। এভাবে বেতন বাড়ালে আন্দোলন ছাড়া উপায় থাকবে না।
কাকরাইলের উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে গত দুই সপ্তাহ ধরে আন্দোলন করছেন অভিভাবকরা। ওই স্কুলের অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি রেবেকা আক্তার অভিযোগ করেন, প্রথম শ্রেণির মাসিক বেতন ১৩০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২২৫০ টাকা করা হয়েছে। পঞ্চম শ্রেণিতে ১৫০০ টাকার ফি  ২৫৫০ টাকা করা হয়েছে। ঢাকা জেলা শিক্ষা অফিস এ বিষয়ে তদন্ত করে এর সত্যতাও পেয়েছে। কিন্তু স্কুল কর্তৃপক্ষ এখনো ফি কমানোর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। উল্টো আমরা যারা আন্দোলন করছি তাদের সন্তানদের বহিষ্কারসহ পুলিশ দিয়ে নানা হয়রানি করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আবুল হোসেন বলেন, মাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষক সরকারি বেতন পায়। বাকিদের বেতন না  বাড়াতে পারলে তাদের চাকরিতে রাখা যাবে না। এরপর স্কুলের পড়াশুনার মান কমে যাবে। তখন অভিভাবকরা উল্টো দোষারোপ করবেন। এ জন্যই শিক্ষার্থীদের মাসিক ফি বাড়ানো হয়েছে।
গত বুধ ও বৃহস্পতিবার রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিভাবকরা মূল ক্যাম্পাসের সামনে বৃহস্পতিবার ফি বাড়ানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন। অভিভাবকরা জানান, প্রথম শ্রেণির ফি ৮০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৫০০ টাকা করা হয়েছে, যা ইতিমধ্যেই কার্যকরও হয়েছে। এ ছাড়া দ্বিতীয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত ৮০০ টাকার ফি বাড়িয়ে এক হাজার ৬০০ টাকা করা হয়েছে। সপ্তম থেকে দশম শ্রেণির ৯০০ টাকার ফি দুই হাজার ২০০ টাকা করা হয়েছে।
মাউশির পরিচালক (মাধ্যমিক) অধ্যাপক এলিয়াছ হোসেন বলেন,ফি বাড়ানোরে ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতিমালা আছে, যা গত বছর থেকে চালু আছে। সেই নীতিমালার বাইরে গিয়ে যারা ফি বাড়িয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।
গত বছরের ২৯ অক্টোবর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা ভর্তি নীতিমালার ১০ (ক)-তে বলা হয়েছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় অবস্থিত আংশিক এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন এবং এমপিওবহির্ভূত শিক্ষকদের বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য শিক্ষার্থী ভর্তির সময় মাসিক বেতন, সেশন চার্জ ও উন্নয়ন ফিসহ বাংলা মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা এবং ইংরেজি ভার্সনে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা গ্রহণ করতে পারবে।
এদিকে চট্টগ্রামেও সিটি করপোরেশন পরিচালিত ৪৬টি স্কুলে এবং ইপিজেডে নৌবাহিনী স্কুল অ্যান্ড কলেজের বেতন বাড়ানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভে রয়েছেন অভিভাবকরা। কয়েকদিন আগে কর্মসূচি চলার সময় তাদের উপর পুলিশের লাঞ্ছনার ঘটনাও ঘটে।