খোলা বাজার২৪,মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারি ২০১৬: রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর স্বৈরশাসক এইচ এম এরশাদ আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ আরও কয়েকটি দল থেকে নেতাদের বাগিয়ে গঠন করেছিলেন জাতীয় পার্টি (জাপা)। সেই জাতীয় পার্টি এখন পাঁচ ভাগে বিভক্ত। এ অবস্থার মধ্যেই এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি এখন সবচেয়ে বড় ধরনের ভাঙনের মুখে পড়েছে।
জাতীয় পার্টি নামে এখন মাঠে সক্রিয় দল আছে পাঁচটি দল। এর মধ্যে চারটির নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন আছে। স্বৈরশাসক এরশাদের পতনের পর থেকে বেশ কয়েকবার ভাঙন ধরে দলে। এর মধ্যে তিনটি ভাঙন ছিল বড় ধরনের, তাঁরা দল থেকে বেরিয়ে একই নামে আবার দল করেছেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে দলটির আরও কিছু নেতা দলছুট হয়েছেন, একাধিকবার ছোট ছোট ভাঙনের মুখে পড়েছিল দলটি। বড় ভাঙনগুলো হয়েছিল মূলত বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে। কখনো আওয়ামী লীগ-বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে আবার কখনো ভেঙেছে মন্ত্রী হওয়া নিয়ে।
এখন এরশাদ ও তার স্ত্রী রওশনের দ্বন্দ্বে পার্টি আবার ভাঙনের মুখে পড়েছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে জাপায় এরশাদ ও রওশনকে কেন্দ্র করে দলে দুটি বলয় তৈরি হয়। সে দুটি বলয় এখন প্রকাশ্য দুই শিবিরে বিভক্ত। গত রোববার রংপুরে এরশাদ তাঁর ভাই জি এম কাদেরকে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা করেন। এর একদিনের মাথায় গতকাল সোমবার রওশনপন্থীরা এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদকে পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় এরশাদ বলেছেন, রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা অবৈধ। এখনো অবশ্য এ দুটি অংশের কেউ আলাদা হওয়ার ঘোষণা দেয়নি।
রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করায় আলাদা জাতীয় পার্টি হলো কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, এরশাদ দলের চেয়ারম্যান আছেন। রওশন এরশাদ ভারপ্রাপ্ত হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। অবশ্য এইচ এম এরশাদ বলেছেন, রওশনকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করা সম্পূর্ণ অবৈধ। এ ব্যাপারে শিগগিরই তিনি ব্যবস্থা নেবেন।
এরশাদের নেতৃত্বাধীন এই অংশটি মূল জাতীয় পার্টি হিসেবে পরিচিত। নির্বাচন কমিশনে এ দলটি নিবন্ধিত লাঙল প্রতীক নিয়ে। এ ছাড়া আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি) নিবন্ধিত বাই সাইকেল প্রতীক নিয়ে, নাজিউর রহমান মঞ্জুর জাতীয় পার্টি (বিজেপি) নিবন্ধিত গরুর গাড়ি প্রতীক নিয়ে। আর গত নির্বাচনের আগে এরশাদের দলে আরেক দফা ভাঙন ধরিয়ে নতুন জাতীয় পার্টি করেন কাজী জাফর আহমদ। এর বাইরে কাঁঠাল প্রতীকে তাসমিনা মতিনের নামেও জাতীয় পার্টির নিবন্ধন আছে। জাতীয় পার্টির নেতা এম এ মতিনের নেতৃত্বে এই অংশটি আলাদা হয়েছিল।
জাতীয় পার্টির জন্ম:
মওদুদ আহমদের ‘গণতন্ত্র ও উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের রাজনীতি এবং সামরিক শাসন’ বই থেকে জানা যায়, ১৯৮৪ সালে এরশাদ প্রথমে ‘জনদল’ নামে একটি রাজনৈতিক দলের গোড়াপত্তন ঘটান। ৮৫ সালের প্রথম দিকে এরশাদ দুটি প্রধান বিরোধী জোটে ভাঙন ধরাতে সক্ষম হন। আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা কোরবান আলী ও বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতা আবদুল হালিম চৌধুরীকে তিনি মন্ত্রিত্ব দেন। পনেরো দলীয় জোটের শরিক দল মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের একাংশ, পাঁচদলীয় জোটের শরিক ইউপি পির কাজী জাফর আহমেদ ও সিরাজুল হোসেন খানের গণতন্ত্রী দল জোট ছেড়ে এরশাদের সঙ্গে যোগ দেয়। বিএনপির একটি অংশের নেতা শামসুল হুদা চৌধুরী ও ড. এম এ মতিন এবং আওয়ামী লীগের সাবেক চিফ হুইল শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এরশাদের সঙ্গে হাত মেলান। এ ছাড়া বিএনপির জিয়াউদ্দিন আহমেদ, আনিসুল ইসলাম মাহমুদের মতো কিছু নেতা, মুসলিম লীগের একাংশের নেতা সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরী, দলবিহীন বিশেষ ব্যক্তিত্ব আনোয়ার হোসেন মঞ্জুও এরশাদের সঙ্গে হাত মেলান। ১৯৮৫ সালের শেষ দিকে এরশাদ তাঁর জনদল, বিএনপির একাংশ, ইউপি পি, গণতান্ত্রিক পার্টি এবং মুসলিম লীগের সমন্বয়ে গঠন করেন জাতীয় ফ্রন্ট। একপর্যায়ে কাজী জাফর স্বেচ্ছায় ইউপি পি ভেঙে দিয়ে এরশাদের দলে যোগ দেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি ‘সরকারি রাজনৈতিক দল’ জাতীয় পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে।
জিয়াউর রহমান সরকারের মন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির বর্তমান সদস্য মওদুদ আহমদও সে সময় জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে উপ রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন।
আর জাতীয় পার্টির নিজস্ব পরিচিতিতে বলা আছে, ১৯৮৬ সালের পয়লা জানুয়ারি জাতীয় ফ্রন্টের ৫টি শরিক দল একত্র হয়ে জাতীয় পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে। নবগঠিত পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হন এইচ এম এরশাদ এবং মহাসচিব নিযুক্ত হন এম এ মতিন।
পার্টিতে ভাঙন: এরশাদের জাতীয় পার্টিতে প্রথম বড় ধরনের ভাঙন ধরে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বের হয়ে আলাদা জাতীয় পার্টি ঘোষণা করলে। ১৯৯৬ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে সরকার গঠনের সময় জাতীয় পার্টি প্রথমে তাদের সমর্থন দিলেও পরে চারদলীয় জোটে চলে যায়। সেসময়ের যোগাযোগ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এরশাদের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে জাতীয় পার্টি নামে নতুন দল গঠন করেন।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে আরেক দফা ভাঙন ধরে। নাজিউর রহমান মঞ্জু জাতীয় পার্টি নামে আরেকটি দল গঠন করে এবং বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের অংশ হয়ে নির্বাচনে যায়। বর্তমানে এই অংশের নেতৃত্বে আছেন আন্দালিব রহমান।
এই অংশটির ভেতরও আরেকটি ভাঙন আছে। মন্ত্রিত্ব নিয়ে ঝামেলার একপর্যায়ে এম এ মতিন আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করেন।
এক এগারোর সময়ও জাতীয় পার্টি দুটি অংশে বিভক্ত হয়েছিল, পরে অবশ্য এ দুটি অংশই এরশাদের নেতৃত্বে এক হয়ে যায়।
সর্বশেষ এরশাদের জাতীয় পার্টিতে ভাঙন ধরান তাঁর পুরোনো রাজনৈতিক সহকর্মী কাজী জাফর আহমেদ। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে কাজী জাফর এরশাদকে ছেড়ে আলাদা জাতীয় পার্টি গঠন করে যোগ দেন বিএনপি-জোটে। ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে দলের বিশেষ কাউন্সিলের মাধ্যমে নতুন জাতীয় পার্টির ঘোষণা দেন কাজী জাফর। একই সঙ্গে তিনি এরশাদকে বহিষ্কারেরও ঘোষণা দেন।