খোলা বাজার২৪, শনিবার ,২৩ জানুয়ারি ২০১৬ : ‘খুনোখুনির জনপদ’ পরিচিতি কাটিয়ে উঠতে পারছে না নারায়ণগঞ্জ। শিশু, ছাত্র, শিক্ষক, সাংবাদিক, আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধিÑ কেউই রেহাই পাচ্ছেন না খুন থেকে। প্রায় প্রতিদিনই এখানে খুনোখুনি ঘটছে, লাশ মিলছে সড়কের পাশ বা নদী থেকে হাত-পা বাধা-বস্তাবন্দি নয়তো খোলাবস্থায়।
অতি সম্প্রতি একই পরিবারের পাঁচজনকে জবাই করে হত্যা ছাড়াও ২০১৪ সালে কাউন্সিলর-আইনজীবিসহ সাত খুন দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচিত ঘটনা ছিল। ১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে ভয়াবহ বন্দুকযুদ্ধের ঘটনায় নারায়ণগঞ্জে ফেব্রুয়ারি মাসেই ২২ জনের প্রাণহানি ঘটে। ২২ দিনের আন্দোলনে এই ২২ লাশ পড়ার পর থেকেই সন্ত্রাসের জনপদ হিসেবে দেশব্যাপী চিহ্নিত হয় নারায়ণগঞ্জ। ২০০১ সালের ১৬ জুন চাষাঢ়ায় আওয়ামী লীগ অফিসে সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের পূর্ব নির্ধারিত গণসংযোগ কর্মসূচিতে শক্তিশালী বোমা হামলায় ২০ জন নিহত হয়েছিলেন। ২০১৩ সালের ১৯ এপ্রিল সোনারগাঁয়ের ঝাউগড়া এলাকায় পিরোজপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলামের স্ত্রী, শ্যালক ও বাড়ির দুই গৃহপরিচারিকা হত্যা ও একই বছরের ১৩ জুন ফতুল্লার দুর্গম চরাঞ্চলে স্কুলছাত্র ইমনকে হত্যা করে মরদেহ নয় টুকরো করে ফসলের মাঠে লুকিয়ে রাখা, ২০১৫ সালে ডাকাত সন্দেহে ৮জনকে গণপিটুনি দিয়ে হত্যাও দেশজুড়ে আলোচনার শীর্ষে ছিল।
জেলা পুলিশ, দেশের ছয়টি শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্র, তিনটি অনলাইন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ীÑ গত ৩ বছরে এখানে খুন করা হয়েছে ৪০০ জনেরও বেশিজনকে। খুনের পর নদী থেকে লাশ (নৌ-যান থেকে পড়ে নিখোঁজদের লাশ বাদে) উদ্ধার করা হয়েছে প্রায় ৫০০ জনের। এর মধ্যে কিছু রয়েছে, যা নারায়ণঞ্জে সংঘটিত হত্যা নয় বা নারায়ণগঞ্জের কেউ নন। অন্যদিকে, মুক্তিপণের দাবি ও পূর্ব শত্রট্টতার জেরে হত্যার শিকার ৫০ জনের বেশি শিশু। যৌতুক, পারিবারিক কলহেও প্রাণ গেছে অনেক নারীর।
নারায়ণগঞ্জ পুলিশ থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ীÑ এখানের খুনিরা স্কুলছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, গণমাধ্যমকর্মী, গৃহবধূ, দিনমজুর টার্গেট করে খুনোখুনিতে লিপ্ত হচ্ছে। এখানে প্রায় সব শিশু খুনের ঘটনা ঘটেছে সেই শিশুর পরিবার বা গোষ্ঠীর কারও উপর ঝাল মেটাতে। ৯৫ ভাগ খুনই ঘটছে পারিবারিক, গোষ্ঠী, সামাজিক কলহ, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব নিয়ে।
মানবাধিকার কর্মীদের মতে, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর নারায়ণগঞ্জের অবস্থা খুবই বেহাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের মতেÑ মাদক ব্যবসা, ভূমি দখল, জোরজুলুম ও নারীদের হয়রানির কারণে এই ধরনের খুনের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন নতুন নতুন সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের আওতায় উঠতি বয়সের সন্ত্রাসীরাই লাগামহীন অপরাধ ঘটিয়ে চলছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুক্তিপণ হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতেই তারা অপহরণ, গুম, খুনের পথ বেছে নিচ্ছে।
২১ মাস ধরে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন এ প্রতিবেদককে বলেন, খুন অনেক কমেছে। ২০১৪ সালে ১৪৮টি খুনের মামলা রেকর্ড হলেও গত বছর ছিল ১২৩টি। তিনি বলেন, ২১ মাসে দেখেছি, এখানের খুন হয় পারিবারিক, সামাজিক, ব্যবসায়িক কারণে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান মনে করেনÑ ভৌগলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অবস্থার জন্য নারায়ণগঞ্জ দেশের অন্যতম একটি অপরাধপ্রবণ এলাকা। এখানে প্রচুর গার্মেন্টস, শিল্পকারখানার পাশপাশি পরিবহন ব্যবসায়, নদীবন্দর, রেলস্টেশন রয়েছে। এসব কারণে প্রচুর অর্থ লেনদেন হচ্ছে, মানুষের বসবাস-পদচারণাসংখ্যা বেশি, তৈরি হচ্ছে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব।
পুলিশ অপরাধী ধরে, মামলা করে, মৃত্যুদ- দিয়ে এখানের খুনখারাবি বন্ধ করা যাবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সমাজে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি পুলিশকেও অধিকতর সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। পাড়ায়-মহল্লায় কমিউনিটি পুলিশি ব্যবস্থা জোরদারে মনোযোগ দেয়া উচিৎ। তাছাড়া পারিবারিকভাবে ভবিষ্যৎ প্রজš§কে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের আরেকজন শিক্ষক নাম না প্রকাশের অনুরোধ জানিয়ে বলেন, এখানে খুনোখুনির অন্যতম একটি কারণ পারিবারিক কব্জায় রাজনৈতিক ক্ষমতা বন্দি এবং রাজনৈতিকভাবে প্রাপ্ত ক্ষমতার অপচর্চা। এই সংস্কৃতি চলে আসছে ১৯৯৬ সাল থেকেই। খুনে হয় তারা ম“ দিচ্ছেন, খুনিদের রক্ষা করছেন, লালন-পালন করছেন নিজ স্বার্থ হাসিলে নয়তো উস্কে দিচ্ছেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, ২০১৬ সাল শুরু হতে না হতেই খুন করা হয় ৭ জনকে।
২০১৫ সালের ৪ ডিসেম্বর সকালে রূপগঞ্জের গন্ধর্বপুর এলাকার রাস্তার উপর থেকে সুমন মিয়ার গলাকাটা মৃতদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। স্বামীর পরকিয়ার জের ধরে ১৩ নভেম্বর রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইল নতুন বাজারে আড়াই বছরের শিশু কন্যাকে গলাটিপে হত্যা অভিযোগ উঠে শিশুটির মা লিপি আক্তারের বিরুদ্ধে। ১৩ নভেম্বর রাতে রূপগঞ্জের গোলাকান্দাইল ইউনিয়নের টেংরারটেকে উপজেলায় মহিলা লীগ কর্মী হালিমা বেগম জরিনাকে (৩৫) কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
২৩ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় নিখোঁজের পরদিন সুমনের (৪) লাশ ফতুল্লা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। তাকে চোখ উপড়ানোর পাশাপাশি জবাই করা হয়েছিল। ৪ জানুয়ারি তারাব পৌরসভার কর্ণগোপ থেকে অজ্ঞাতপরিচয় (৩৫) যুবকের মৃতদেহ উদ্ধার করে। যুবকের গলায় জখমের চিহ্ন ছিল।
২০১৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ফতুল্লার পিঠালিপুলের স্কুলছাত্র মোস্তফা মিয়াকে (১২) সামান্য মোবাইল ফোনের জন্য খুন করে বখাটেরা। ২৮ মার্চ সোনারগাঁওয়ে সাংবাদিক দেলোয়ার হোসেনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। রাজধানী থেকে নিখোঁজ সাংবাদিক আব্দুর রবের কঙ্কাল ২২ ডিসেম্বর নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের একটি ডোবা থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। পকেটে থাকা পরিচয়পত্র অনুযায়ী অপরাধ চিত্র পত্রিকার মিরপুর প্রতিনিধি ছিলেন তিনি।
২০১৩ সালের ৮ মার্চ স্কুলছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে হত্যার পর মরদেহ ভাসিয়ে দেয়া হয় শীতলক্ষ্যা নদীতে। এ বছরই শহরের মাসদাইর আদর্শ স্কুলের ছাত্র সিয়াম, সালমান, রমজান, ফতুল্লার স্কুল ছাত্র নাজমুল, কলেজ শিক্ষার্থী মৌসুমিকে খুন করা হয়। এ বছরের মাঝামাঝি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণের পর নিখোঁজ রয়েছেন যুবলীগ নেতা পারভেজ ও ব্যবসায়ী কালাম শিকদার।
৩০ লাখের অধিক জনবসতির জেলা নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকার খুব কাছে এর অবস্থান উল্লেখ করে পুলিশ সুপার খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, এখানে নৌ বন্দর, রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল রয়েছে। অন্য জায়গায় হত্যা শেষেও লাশ এখানে ফেলা হয়। নারায়ণগঞ্জ একটি বড় ও জনবহুল এলাকা বলে ঘটনাও হয়তো বেশি ঘটে।