খোলা বাজার২৪, সোমবার, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ : আদালত চত্বরে রীতিমতো ফুঁসে উঠল বছর পনেরোর ললিতা খাতুন। ঘাড়টা ঈষৎ কাত করে কঠিন গলায় সে জানিয়ে দিল, ‘‘বাবার চরম শাস্তি চাই। আমার ‘জান’-কে যে মেরেছে তাকে আমি কিছুতেই ক্ষমা করব না।’’
শনিবার রাতে নাকাশিপাড়ার তেঘড়ি গ্রামের বাসিন্দা, একাদশ শ্রেণির ছাত্র সাজু শেখকে গুলি করে খুন করা হয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ললিতা এ দিনই নাকাশিপাড়া থানায় গিয়ে পুলিশকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, ‘‘আমার আব্বাই সাজুকে গুলি করে মেরেছে। দেখবেন, আব্বার যেন সাজা হয়।
’’রফিকুলের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে খুনের মামলা দায়ের করেছেন সাজুর বাবা ইয়াজউদ্দিন শেখ। রবিবার দুপুরে পুলিশ রফিকুলকে গ্রেফতারও করেছে। জেলার পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ললিতা আমাদের পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে, ওর বাবা গুলি করে খুন করেছে সাজুকে। রফিকুলের চরম শাস্তিও দাবি করছে ললিতা।’’খবর-আনন্দবাজার
পুলিশ জানিয়েছে, ললিতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল নিহত ওই ছাত্রের। সেই সম্পর্ক রফিকুল মেনে নিতে পারেনি। মেয়েকে সে একাধিক বার নিষেধও করেছিল। কিন্তু রফিকুলের রাঙা চোখ সে সম্পর্কে ফাটল ধরাতে পারেনি। শনিবার রাতে সাজু ললিতার ঘরের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। বিষয়টি জানতে পেরেই রফিকুল ছুটে গিয়ে সাজুকে গুলি করে খুন করে বলে অভিযোগ।
তবে নদিয়ায় এমন ঘটনা এই প্রথম নয়। ২০১২ সালে ভিন্ জাতের ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক মেনে নিতে না পারেনি নাকাশিপাড়ারই কড়কড়িয়া গ্রামের এক অভিভাবক। মেয়েকে বার বার নিষেধ করেও কোনও কাজ হয়নি। শেষতক বাড়ির সামনে প্রকাশ্যে রাস্তায় নিজের মেয়েকেই হাঁসুয়া দিয়ে খুনের অভিযোগ উঠেছিল ওই তরুণীর বাবার বিরুদ্ধে। সেই ঘটনাতেও পুলিশ ওই তরুণীর বাবাকে গ্রেফতার করেছিল।
রবিবার ললিতা কৃষ্ণনগর জেলা আদালতে এসেছিল বিচারকের কাছে গোপন জবানবন্দি দিতে। কী হয়েছিল শনিবার রাতে? ললিতা জানায়, সে ঘরের ভিতরেই ছিল। সাজু এসেছিল তার পরীক্ষা কেমন হয়েছে তা জানতে। সাজু জানালার নিচে দাঁড়িয়েছিল। তারা দু’জনে খুব নিচু স্বরে কথা বলছিল।
কিন্তু শত সাবধানতার পরেও রফিকুল তাদের কথা শুনতে পায়। ললিতার কথায়, ‘‘আব্বা চিৎকার করতে শুরু করে। ‘তোকে খুন করেই ফেলব’ বলে আব্বা ছুটে যায়। আব্বার রাগ জানি। ভয় পেয়ে গিয়ে আমি ছুটে যাই। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই আব্বা সাজুকে লক্ষ্য করে পিছন থেকে গুলি চালিয়ে দিল।’’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানাচ্ছেন, গুলির শব্দ শুনেই তাঁরা ছুটে আসেন। ললিতা ঝাঁপিয়ে পড়ে তার বাবার উপরে। কোনও রকমে মেয়ের হাত ছাড়িয়ে চম্পট দেয় রফিকুল। সংজ্ঞা হারিয়ে হয়ে পড়ে ললিতা। জ্ঞান ফিরতেই রক্তাক্ত সাজুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। প্রতিবেশীরা সাজুকে হাসপাতালে নিয়ে আসার জন্য গাড়ি নিয়ে আসে। সকলের নিষেধ অমান্য করে ললিতাও উঠে পড়ে সেই গাড়িতে। সাজুকে বেথুয়াডহরি হাসপাতালে নিয়ে আসা হলে চিকিৎসকেরা তাকে মৃত বলে জানান।
নাকাশিপাড়ার একেবারে প্রত্যন্ত গ্রাম তেঘড়ি।
কৃষ্ণনগরের সাংসদ তাপস পালের দৌলতে এই গ্রাম একদিন রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিল। এই গ্রামে এসে সিপিএমের লোকজনের বাড়ি ভাঙচুরের হুমকি দিয়েছিলেন তাপস। পরের দিন তৃণমূলের লোকজন এলাকায় সিপিএমের কর্মী বলে পরিচিত রফিকুল শেখের বাড়ি ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ উঠেছিল। সেই রফিকুলই যে এমন কাণ্ড করতে পারে তা পড়শিরা ভাবতে না পারলেও পুলিশ কিন্তু বলছে অন্য কথা।
জেলা পুলিশের একাংশ জানাচ্ছে, রফিকুলের মতো একজন কুখ্যাত দুষ্কৃতীর পক্ষে এমন কাজ করা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। পুলিশের খাতায় তার বিরুদ্ধে একাধিক খুনের অভিযোগ আছে। ২০১৪ সালে দলবল নিয়ে গ্রামের পুলিশ ফাঁড়িতেও সে আক্রমণ চালিয়েছিল বলে অভিযোগ। সেই ঘটনার পরে পুলিশ তাকে গ্রেফতারও করে।
প্রতিবেশীরা জানাচ্ছেন, স্কুলে যাতায়াতের পথে আলাপ হয় সাজু ও ললিতার। তারপরে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। ললিতার কথায়, ‘‘আব্বা এই সম্পর্ক মেনে নিতে পারেনি। সেই কারণেই সাজুকে খুন করে দিল।’’ সাজুর পারিবারিক সূত্রে জানা গিয়েছে, এর আগেও রফিকুল সাজুকে ডেকে ললিতার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে নিষেধ করেছিল।
ললিতার মা মনোয়ারা বিবিও সাজুর বাড়িতে গিয়ে জানিয়ে এসেছিলেন এই সম্পর্কে তাঁদের আপত্তি রয়েছে। তারপরেও কোনও কিছুই সেই সম্পর্কের পথে বাধা হতে পারেনি। সাজুর মা নরিছন বিবি বলছেন, ‘‘ললিতা প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসত। ছেলের সঙ্গে গল্প করত। নিষেধ করতাম। ললিতার বাবা ডাকাত। ছেলেকেও বোঝাতাম যে এমন লোকের মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়লে বিপদ আছে। কিন্তু ছেলেটাকে যে খুনই করে ফেলবে কে জানত!’’
আকস্মিক এই ঘটনায় গোটা গ্রামও যেন হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। শনিবার রাত থেকেই লাগোয়া দুই বাড়ির সামনে প্রতিবেশীদের ভিড়। ঘটনার পরেই বাড়ি ছেড়ে সপরিবার পালিয়েছিল রফিকুল। ললিতা সারাক্ষণই ছিল সাজুর সঙ্গে। রাতে ছিল নাকাশিপাড়া থানায়। গ্রামে যাতে কোনও রকম বিশৃঙ্খলা তৈরি না হয় সেই জন্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে দুই বাড়ির সামনে। ললিতা আপাতত রয়েছে পাশের গ্রাম পেটোয়াভাঙায় তার মামার বাড়িতে। সাজুর এক বন্ধুর কথায়, ‘‘ললিতা সাজুকে খুব ভালবাসত। দেখবেন, ও কোনওদিন ওর বাবাকে ক্ষমা করবে না।