Fri. Jun 20th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

33kখোলা বাজার২৪, শনিবার, ৫ মার্চ ২০১৬ : রাজধানী রামপুরার বনশ্রীতে ভাই-বোন অরণী (১২) ও আলভীর (৭) হত্যার ঘটনায় তাদের মা মাহফুজা মালেক জেসমিন জড়িত, এমনটিই দাবি করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ বক্তব্য কোনভাবেই মানতে পারছে মাহফুজার পরিবার। তার স্বজনরা বলছেন, মাহফুজা তার সন্তানদের কোনভাবেই হত্যা করতে পারেন না। আর যে কারণের হত্যা করা হয়েছে সেটিও ভিত্তিহীন। কারণ অরণী ও আলভী পড়ালেখায় দুর্বল ছিল না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দুই শিশুর পরীক্ষার ফলাফল ছিল সন্তোষজনক। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের ২০১৪ সালের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় নুসরাত ৮২০ নম্বরের মধ্যে ৫২৭ নম্বর পেয়েছিল। ক্লাসে ১১০ দিনের মধ্যে ৯৮ দিন উপস্থিত ছিল। স্কুলের অধ্যক্ষ সুফিয়া খাতুন জানান, নুসরাতের শ্রেণিশিক্ষককে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ওর ফল ভালো ছিল। খুব সৃষ্টিশীল ছিল, ভালো ছবি আঁকত।
আলভী সম্পর্কে হলি ক্রিসেন্ট (ইন্টারন্যাশনাল) স্কুলের প্রভাতি শাখার সমন্বয়ক মেহেদি মাসুদ জানান, আলভী প্লে গ্র“প থেকে নার্সারিতে ওঠার সময় ষষ্ঠ হয়েছিল। নিয়মিত স্কুলেও আসত।
এদিকে গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, বেশকিছু দিক পর্যালোচনা করে তদন্ত শুরু হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক সংস্থা ঘটনাটি তদন্তে মাঠে নামে। পারিবারিক সমস্যার কারণগুলোও যাচাই-বাছাই করা হয়। দুই শিশুর বাবা আমান উল্লাহ ও মা মাহফুজা মালেক জেসমিনকে জিজ্ঞাসাবাদে কিছু তথ্য বেরিয়ে আসে। কিন্তু সমাজের প্রভাবশালী এক ব্যক্তির প্রভাবের কারণে মাহফুজা সব কথা খুলে বলছেন না।
সন্তানদের ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তা ছাড়া অন্য কোনো কারণ ছিল কিনা-জানতে চাইলে র‌্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, মাহফুজা মালেক ম্যানেজমেন্টের ওপর মাস্টার্স করেছেন। ২০০৫ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত একটি কলেজে শিক্ষকতাও করেছেন তিনি। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে তিনি সব সময় উদ্বিগ্ন ছিলেন। আমরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। ঘটনার আরও তদন্ত হবে। তদন্ত শেষে আরও কোনো কারণ ছিল কিনা, জানা যাবে।
হত্যাকা-ের তদন্তকারী কর্মকর্তা রামপুরা থানার পুলিশ পরিদর্শক মোস্তাফিজুর রহমান জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে মাহফুজা সন্তানদের লেখাপড়া ও ভবিষ্যৎ নিয়ে টেনশনে থাকায় এ হত্যাকা- ঘটিয়েছেন বলে স্বীকার করলেও কীভাবে তিনি তাদের হত্যা করেছেন, প্রকৃত রহস্য কী, এ হত্যায় কারা লাভবান হলো- এ সব বিষয়ে কিছুই বলছেন না। তার প্রাথমিক জবানবন্দি যথেষ্ট নয়। আরও জিজ্ঞাসাবাদ করলে হত্যার মূল রহস্য উদঘাটিত হবে বলে জানান তিনি।
এর আগে বৃহস্পতিবার র‌্যাব সদর দফতরে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, সন্তানদের স্কুলের পরীক্ষার ফলাফল ও ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে মা মাহফুজা মালেক জেসমিন নিজের ওড়না পেঁচিয়ে তার সন্তানদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছেন। ২৯ ফেব্রুয়ারি বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে প্রথমে অরণীকে ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে ধরে একপর্যায়ে ধস্তাধস্তিতে উভয়েই বিছানা থেকে মেঝেতে পড়ে যায়। কিছু সময় পর মেয়ের শরীর নিস্তেজ হয়ে গেলে তিনি তার ছোট ছেলে আলভীকে খাটের উপর ঘুমন্ত অবস্থায় একইভাবে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করেন। মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর তিনি লাশ দুটির সামনে কিছু সময় ধরে কান্নাকাটি করেন। পরে খাবারের বিষক্রিয়ার কারণে মৃত্যু হয়েছে বলে সকলকে অবহিত করেন।
কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন বক্তব্য বিশ্বাসই করতে পারছেন না মাহফুজার পরিবার। মাহফুজার ভাই জাকির হোসেন সরকার জানান, আমার বোন সন্তানদের অনেক ভালবাসতো। সে কাউকে হত্যা করতে পারে না। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমন দাবি করলেও আমার বোন তো নিজ মুখে সবার সামনে বলেনি যে সে তার সন্তানদের হত্যা করেছে।
একই কথা সাংবাদিকদের বললেন, মাহফুজার ছোট বোন আফরোজা মিলি। তিনি বলেন, আমার কাছে মনে হচ্ছে এটা কাল্পনিক। দুশ্চিন্তার কারণে সে নিজের বা”চাদের মেরে ফেলবে এটা হতে পারে না। আপার মেয়েটাও ভালো ছাত্রী ছিল। সন্তানদের নিয়ে সে যে খুব দুশ্চিন্তা করতো তা কিন্তু না।
তিনি আরও বলেন, আমার মেয়েটা গতবার ক্লাসে সেকেন্ড হয়েছিলো, এবার ফোর্থ হয়েছে। তখন আপা আমাকে বললো ‘ও যেভাবে পড়াশোনা করছে, সেভাবেই করুক। যা রেজাল্ট হচ্ছে হোক, তুই ওকে কোনো চাপ দিস না।’ যিনি আমার সন্তান নিয়ে এমন মন্তব্য করেছেন আর তিনি তার সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণে তাদের হত্যা করবেন এমন বক্তব্য সত্য হতে পারে না, যোগ করেন তিনি।
গোয়েন্দা সূত্রে আরও জানা যায়, ঘটনার সময় বাসায় থাকা দুই শিশুর দাদী হাসনা বেগমের ভূমিকা ও প্রতিক্রিয়া নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। সন্দেহের তালিকায় নিহতদের মা মাহফুজার পাশাপাশি বাবা আমান উল্লাহও ছিলেন। কারণ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সন্তানদের লাশ নিতে মাহফুজার সঙ্গে আমান উল্লাহ আসেননি। আমান উল্লাহও মাহফুজার মত গাড়ি থেকে না নেমে সন্তানদের মৃতদেহ রেখেই গ্রামের বাড়ি জামালপুরে রওনা দেন। মাহফুজা ও পরিবার চাইছিলেন না দুই শিশুর লাশের ময়নাতদন্ত হোক। সেখান থেকেই বাবা-মার প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সন্দেহ জাগে।
যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে শুধু মাহফুজাই হত্যাকা-ের কথা স্বীকার করেছেন এবং আমান উল্লাহ হত্যাকা- সম্পর্কে কিছুই জানতেন না। বুধবার রাতে জিজ্ঞাসাবাদে যখন মাহফুজা অপরাধ স্বীকার করেছেন তখনই আমান উল্লাহ জানতে পেরেছেন।
শিশু দুটিকে মর্গে রেখে একসাথে গ্রামে চলে গেলেও পরে আমান উল্লাহ ৩ মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে রামপুরা থানায় স্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। ৪ মার্চ শুক্রবার পুলিশের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মাহফুজার পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন মহানগর হাকিম স্নিগ্ধা রানী চক্রবর্তী। আদালতের কাঠগড়ায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা মাহফুজাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। শুনানির সময় তিনি কোনো কথা বলেননি। এজলাসে আনা-নেওয়ার সময় সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নেরও জবাব দেননি তিনি।
তবে দুই সন্তানের লাশ না নিয়ে কেন আমান উল্লাহ তার স্ত্রী মাহফুজার সঙ্গে গ্রামে চলে গেলেন? এ প্রশ্নের জবাব এখনও কেউ পায়নি।
এদিকে শিশুদের সহপাঠী ও শিক্ষকদের বক্তব্য অনুযায়ী তাদের উপর মায়ের অতীতেও নির্যাতনের প্রমাণ মিলেছে। সম্প্রতি আলভী হাতে মায়ের মারের আঘাতের চিহ্ন নিয়েই স্কুলে গিয়েছিল। এছাড়া অরণীর চোখেও জমাট রক্তের দাগ দেখেছিল সহপাঠীরা। বাড়ির দারোয়ান পিন্টু মন্ডল বলেন, মাহফুজা মালেক জেসমিন বদমেজাজি ছিলেন।
এ প্রসঙ্গে রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রফিকুল ইসলাম জানান, মাহফুজা বার বার লেখাপড়ার বিষয়টিই বলছে। কিন্তু আমরা আরও জিজ্ঞাসাবাদ করবো। সব কিছু খতিয়ে দেখবো। এরপরই হয়তো মূল রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে।
এর আগে, শিশু দুটির ময়নাতদন্ত শেষে মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রভাষক ডা. প্রদীপ বিশ্বাস জানান, শিশু দুটিকে শ্বাসরোধে হত্যার আলামত মিলেছে। তাদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
দু’জনের শরীরেই আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। অরণীর চোখে রক্ত জমাট ও গলায় আঘাত এবং আলভীর পা ও গলায় আঘাত রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে তাদের শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছে,’ জানান ডা. প্রদীপ বিশ্বাস।
ফুড পয়জনিং হয়েছিল কিনা সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভিসেরা রিপোর্ট হাতে পেলে বিষয়টি জানা যাবে।’