Fri. Jun 20th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

21kখোলা বাজার২৪, বুধবার, ২০ এপ্রিল ২০১৬ : রাজকোষ কেলেঙ্কারির ঘটনায় দেশে ৮ জনকে নজরদারির আওতায় এনেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডি। তাদের মধ্যে কয়েকজন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকে তথ্য-প্রযুক্তিবিষয়ক সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠানের লোকজনও রয়েছেন। সিআইডির উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। সিআইডি কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের গাফিলতির কারণেই বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা হ্যাকাররা নিয়ে গেছে। এরই মধ্যে সংশ্লিষ্ট এই কর্মকর্তাদের কয়েক দফা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।
তারা প্রযুক্তি না জানার দোহাই দিয়ে রিজার্ভ চুরির দায় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। সিআইডি কর্মকর্তারা নিছকই প্রযুক্তিগত অজ্ঞতা নাকি ‘ক্রিমিনাল ইনটেনশন’ ছিল তা খতিয়ে দেখছেন। মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার আবদুল্লাহহেল বাকী বলেন, ‘মামলার কিছু অগ্রগতি হয়েছে। জড়িত বিদেশিদের শনাক্ত করা হয়েছে। দেশীয় কেউ জড়িত কি না তা বের করার জোর প্রচেষ্টা চলছে।’ তিনি বলেন, ‘কয়েকজনকে সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে। তাদের বিষয়ে আরও বিস্তারিত তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহের কাজ চলছে।’
সিআইডি সূত্র জানায়, সিআইডির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট দল বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক শাখা থেকে কয়েক ট্যারাবাইট তথ্য সংগ্রহ করেন। এসব তথ্য সিআইডির ডিজিটাল ফরেনসিক পরীক্ষাগারে পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার পর এখন চলছে তথ্য বিশ্লেষণের কাজ। ফরেনসিক পরীক্ষার পর সিআইডির তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কয়েক কর্মকর্তার দায়িত্বে চরম অবহেলার প্রমাণ পেয়েছেন। পরে তাদের এসব তথ্য সামনে হাজির করে কয়েক দফা সিআইডি কার্যালয়ে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। কিন্তু বারবারই ওই কর্মকর্তারা নিজেদের প্রযুক্তিগত দিক থেকে অজ্ঞ হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। সিআইডি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তা ছাড়াও একাধিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পেয়েছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের ফরেন এক্সচেঞ্জ ও অ্যাকাউন্ট অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টে যে ধরনের সাইবার নিরাপত্তা দেয়ার কথা ছিল তারা তা দিতে পারেনি। এই নিরাপত্তা যে পর্যাপ্ত নয় তা তারা জানার পরও তথ্য গোপন করে কোনোমতে চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছেন। সিআইডির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট ওই কর্মকর্তা বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাদের দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। আদালতে তাদের দায় নির্ধারণ করেই অভিযোগপত্র দেয়া হবে। সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের মধ্যে মধ্যম সারির কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ও উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদেরও তদারকিতে গাফিলতি ছিল বলে সিআইডির অনুসন্ধানে উঠে এসেছে। সিআইডির এক কর্মকর্তা জানান, তারা এসব বিষয় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আতিউর রহমানের সঙ্গেও কথা বলবেন।
সিআইডি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের যেই কর্মকর্তার কম্পিউটার হ্যাকাররা হ্যাক করে পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে, তা মোটামুটিভাবে নিশ্চিত হওয়ার পথে রয়েছে। এ কম্পিউটার থেকে মিশরের অপর একটি কম্পিউটারে কিছু বার্তা লেনদেন হয়। সিআইডির কর্মকর্তারা মিশরের ওই কম্পিউটারের আইপি (১০.৩৮.১০১.৬১) শনাক্ত করে এর বিস্তারিত জানার জন্য ইন্টারপোলের মাধ্যমে চিঠি পাঠিয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে এটি প্রক্সি আইপি বলে মিশরীয় কর্তৃপক্ষ জানালেও এর বিস্তারিত খোঁজখবর চলছে। সিআইডি সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের টাকা চুরির ঘটনাটি হ্যাকিং বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন।
হ্যাকারদের শনাক্ত করার জন্য ইন্টারপোলের মাধ্যমে ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কান পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে সিআইডি। ওই সূত্র জানায়, হ্যাকারদের শনাক্ত করতে পারলেই টাকা চুরির পুরো রহস্য উদ্ঘাটন সম্ভব হবে। এরপরের অভিযান হবে পুরো টাকাটা কীভাবে ফেরত আনা যায়। সিআইডি সূত্র জানায়, ফিলিপাইনের যেসব ব্যবসায়ী রিজার্ভের ৮১ মিলিয়ন ডলার হাতিয়ে নিয়েছে তারা প্রত্যেকে চাইলেই ৮১ মিলিয়ন ডলার ফেরত দিতে পারে। তাদের সেই সামর্থ্যও রয়েছে। আন্তর্জাতিকভাবে তাদের সেই চাপ দেয়ার প্রক্রিয়াও চলছে।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউ ইয়র্কে সঞ্চিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি যাওয়ার ৪০ দিন পর গত ১৫ই মার্চ মতিঝিল থানায় একটি মামলা দায়ের হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে অ্যাকাউন্টস অ্যান্ড বাজেটিং ডিপার্টমেন্টের যুগ্ম পরিচালক জোবায়ের বিন হুদা বাদী হয়ে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ এবং তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে মামলাটি করেন। দায়ের হওয়ার পর পরই মামলাটির তদন্তের ভার পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির কাছে স্থানান্তর করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল ২২শে মে
কোর্ট রিপোর্টার জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৮০০ কোটি টাকা চুরি করে হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ২২শে মে পরবর্তী তারিখ ধার্য করেছেন আদালত। গতকাল ধার্য তারিখে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল না করায় ঢাকার মহানগর হাকিম মো. খোরশেদ আলম তারিখ পুনর্নির্ধারণ করেন। চলতি বছরের ৫ই ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের ৮০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটে। যার কিছু অংশ ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কায় স্থানান্তর করা হয়। এ ঘটনার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক (একাউন্টস) মো. যোবায়ের বিন হুদা বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় মামলা করেন। এ মামলায় এখনও পর্যন্ত কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এ মামলার তদন্ত করলেও দুই মাসেও এর কুলকিনারা হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে দেশব্যাপী সমালোচনার মুখে গত ১৫ই মার্চ পদত্যাগ করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান। অপসারণ করা হয় দুই ডেপুটি গভর্নরকে। পরিবর্তন এসেছে ব্যাংকিং সচিব পদেও। অর্থ চুরির সঙ্গে জড়িত সন্দেহে এখন পর্যন্ত যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম এসেছে তাদের সন্দেহজনক ব্যাংক হিসাব জব্দ করার জন্য আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংগঠন এগমন্ট গ্রুপের সদস্য ১৫১টি দেশকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ফিন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এ ঘটনার বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনসহ কয়েকটি বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার বিষয়ে সমপ্রতি রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। রিজার্ভ চুরির মামলা পরিচালনার জন্য ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসিকে আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অর্থ উদ্ধারে পারস্পরিক আইনি সহযোগিতা নেয়ার সুযোগ আছে
অর্থনৈতিক রিপোর্টার জানায়, রিজার্ভ থেকে চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারে ফিলিপাইনের সঙ্গে পারস্পরিক আইনি সহযোগিতা নেয়ার সুযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র শুভঙ্কর সাহা। প্রয়োজনে মামলাও করা হবে বলে জানান তিনি। গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকে এক ব্রিফিংকালে মুখপাত্র এসব কথা জানান। শুভঙ্কর সাহা বলেন, ফিলিপাইনে অবস্থিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি টিম অর্থ উদ্ধারের বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে। ফিলিপাইনের যে ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিস (ডিওজে) আছে তাদের সঙ্গে আমাদের টিমের আলোচনা হয়েছে।
মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্সির (সমন্বিত আইনি প্রক্রিয়া) যে সুযোগ আছে তার মাধ্যমে অর্থ আদায়ে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় কিনা সে বিষয়টি খতিয়ে দেখবো। ‘যেহেতু সার্বিকভাবে সব জায়গায় কার্যক্রমগুলো চলছে এবং এই জায়গা থেকে যা যা করা দরকার; সেখানে যদি আইনি পদক্ষেপের প্রয়োজন পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক সেটাও নেবে। আবার মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসটেন্সির মাধ্যমে যদি করা যায় সেটিও করা হবে। সমস্ত কিছু দেশের স্বার্থ বিবেচনায় এবং আইন অনুযায়ী করা হবে। তবে বিদেশিদের বিরুদ্ধে মামলা করে টাকা আদায়ের প্রয়োজন পড়বে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ফিলিপাইনে উদ্ধারকৃত বা জব্দ করা টাকা তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রসিড অব ক্রাইম। 
এই টাকাগুলোকে উদ্ধার করা, বাজেয়াপ্ত করার পর এটার বেনিফিশিয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংককে ফেরত দেয়ার ক্ষেত্রে কিন্তু অবশ্যই তাদেরকে কিছু আইনি কার্যক্রম বা আইনি পদক্ষেপের আবশ্যকতা থাকাটাই স্বাভাবিক। সেটা তাদের কাছে আছে। সেটার মধ্য দিয়ে যেয়েই তাদেরকে টাকা ফেরত দিতে হবে। টাকা উদ্ধারে আইনি প্রক্রিয়া যে কারণে প্রয়োজন পড়বে তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শুভঙ্কর বলেন, কাগজে কলমে সন্তুষ্ট থাকতে হবে, এই টাকাটা আসলে আমার। আমার যেমন কাগজ কলম আছে, তার (ফিলিপাইন) কাছেও আছে। এই বিষয়গুলোর জন্যই আসলে এই প্রসেডিং, এই সমস্ত কিছু, আইনের নিয়মাচার, নীতিমালা। আগামীতে যাতে কোনো অসুবিধা না হয় এই বিচার করেই টাকাটা ফেরত দেয়া হয়।
ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের আইনি প্রক্রিয়া গ্রহণের প্রয়োজন পড়লে আমরা তা করবো। তবে ফিলিপাইনে অবস্থিত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি টিম টাকা উদ্ধারে সে দেশে কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা কিন্তু সময় অসময়ে আমাদেরকে বিষয়গুলো জানাচ্ছেন। পরবর্তীতে তারা বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে যে পদক্ষেপ নিতে বলবেন সে পদক্ষেপ অবশ্যই গ্রহণ করবো। পুরো অর্থ আদায়ের সম্ভাবনা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত যতটুকু আদায় হয়েছে সে আদায় যদিও প্রায় আট ভাগের এক ভাগ, কিন্তু এটাতে বোঝা যাচ্ছে পুরো টাকাটাই উদ্ধার করা হয়তো সম্ভব হবে, আমরা আশাবাদী। তবে সব তো আর আদায় হয় না; যে খরচ গেল, যে কষ্টটা যাচ্ছে, মনের দিক থেকে যতটা পেরেশানি গেল, ভাবমূর্তিরও একটা বিষয় আছে, আমাদের মনটা যতদিন খারাপ থাকে এগুলোও একটা বিষয় থাকে। এসব তো আর ফেরত পাওয়া যাবে না।
আরও ৪৩ লাখ ডলার ফেরত দিয়েছেন কিম ওং
মানবজমিন ডেস্ক জানায়, রাজকোষ চুরির আরও ২০ কোটি পেসো বা ৪৩ লাখ ডলার ফেরত দিয়েছেন ক্যাসিনো জাঙ্কেট অপারেটর কিম ওং। এ নিয়ে মোট প্রায় এক কোটি ডলার ফেরত দিলেন তিনি। কিম ওং সোমবার কর্তৃপক্ষের কাছে ৪৩ লাখ ডলার ফেরত দিয়েছেন বলে জানিয়েছে ফিলিপাইনের এন্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিলের এক কর্মকর্তা। এ খবর দিয়েছে এবিএস-সিবিএন নিউজ। বলা হয়েছে, মঙ্গলবার সিনেট ব্লু রিবন কমিটিতে এ নিয়ে আবার শুনানি শুরু হয়েছে। সেখানে এন্টি মানি লন্ডারিং কাউন্সিলের নির্বাহী পরিচালক জুলিয়া বাকা-আবাদ বলেছেন, ইস্টার্ন হাওয়াই লিজার কোম্পানির একাউন্ট থেকে ওই অর্থ ফেরত দিয়েছেন কিম ওং। এর আগে প্রথম দফায় কিম ওং ফেরত দেন ৪৬ লাখ ৩০ হাজার ডলার।
তারপরে ফেরত দেন ৩ কোটি ৮০ লাখ পেসো। এসব অর্থ ফিলিপাইনের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভল্টে রাখা আছে। কিম ওং এর আগে শুনানিতে বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে চুরি করা ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার ফিলিপাইনে নিয়েছে দু’চীনা ব্যবসায়ী শুহুয়া গাও এবং ডিং ঝিজি। তারপর তা রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনে চারটি একাউন্টে জমা হয়। তবে ওই দুই ব্যবসায়ী কোথায় তা এখনও কেউ বলতে পারেন না। এর আগের দুই শুনানিতে নিজেকে অসুস্থ দেখিয়ে অনুপস্থিত ছিলেন রেমিট্যান্স কোম্পানির ম্যাসেঞ্জার পালমারেস। তিনি গতকালকের শুনানিতে উপস্থিত ছিলেন।
মিথ্যা বলেছিলেন দেগুইতো
রাজকোষের ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরির ঘটনা তদন্তের সময় মিথ্যা বলার কথা স্বীকার করেছেন ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং করপোরেশনের (আরসিবিসি) শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতো। ফিলিপাইনের সিনেটের ব্লু রিবন কমিটির তদন্তে তিনি স্বীকার করেন, জড়িত কিছু ব্যক্তিকে বাঁচাতে তিনি মিথ্যা বলেছেন। এ খবর দিয়েছে ফিলিপাইন ডেইলি এনকোয়ার। গতকাল সিনেট কমিটির শুনানিতে সাক্ষ্যদানকালে তিনি বলেন, যে চার ব্যক্তির একাউন্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা গেছে, সে একাউন্টগুলো থেকে জনৈক উইলিয়াম গোর মালিকানাধীন সেঞ্চুরিটেক্স ট্রেডিং-এর একাউন্টে সব অর্থ পাঠানোর নির্দেশনা দিয়েছিলেন ব্যবসায়ী কিম ওং। ওই চার ব্যক্তির একাউন্ট ছিল ভুয়া।
সিনেটর সার্জিও ওসমেনা শুনানিতে তাকে প্রশ্ন করেন, ওই চার ব্যক্তির একাউন্ট থেকে উইলিয়াম গোর একাউন্টে সব অর্থ ট্রান্সফারের নির্দেশনা আপনাকে কে দিয়েছিল? জবাবে মায়া দেগুইতো বলেন, মি. কিম ওং দিয়েছিলেন। তবে দেগুইতোর দাবি, তিনি তখন বুঝতে পারেননি, কেন কিম ওং ওই অর্থ গোর একাউন্টে ট্রান্সপারের নির্দেশনা দিলেন। প্রসঙ্গত, এ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের একজন ক্যাসিনো অপারেটর কিম ওং। দেগুইতোর উত্তরের পর ওসমেনা পাল্টা প্রশ্ন করেন, তাহলে আপনিই বলুন আমরা কাকে বিশ্বাস করবো? ওসমেনা দেগুইতোকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনি জানেন যে, চার ব্যক্তি ওই একাউন্টগুলোর মালিক ছিল। তাদের অস্তিত্ব যদি থাকতো, তাহলে মালিক হিসেবে তারাই আপনাকে টাকা ট্রান্সফারের কথা বলতো বা নির্দেশনা দিতো।
আপনি কিম ওং-এর নির্দেশনা কেন গ্রহণ করলেন? তখন দেগুইতো ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, কিম ওং ওই চার ব্যক্তির একাউন্ট খোলার সুপারিশ করেছিলেন। ওই চার ব্যক্তির পক্ষে তিনিই ছিলেন তাদের একাউন্ট থেকে অর্থ লেনদেনের নির্দেশনা দেয়ার অধিকারপ্রাপ্ত ব্যক্তি। তবে দেগুইতোর এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেন তার সাবেক কর্মস্থল আরসিবিসি ব্যাংকের আইনি প্রধান মারিয়া সেলিয়া এস্তাভিল্লো। এস্তাভিল্লো বলেন, ‘এরকম কোনো নিয়ম নেই। তাছাড়া, তিনি (দেগুইতো) যা বলছেন, সেসবের পক্ষে কোনো নথিপত্রও নেই। এছাড়া, আমাদের কাছে আগে এ ব্যাপারে চিঠি লিখেছিলেন তিনি। সেখানে বলেছিলেন যে, মি. লাগ্রোসাস (ওই চার ভুয়া একাউন্টধারীর একজন) তাকে উইলিয়াম গোর একাউন্টে অর্থ স্থানান্তরের নির্দেশনা দিয়েছিল। তাই ব্যাংককে দেয়া নিজের লিখিত স্টেটমেন্টের সঙ্গে তার এ বক্তব্যের কোনো মিল নেই।’
তখন সিনেটর ওসমেনা পাল্টা দেগুইতোকে প্রশ্ন করেন, কেন তিনি তখন ব্যাংকের কাছে ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছিলেন। দেগুইতো বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘তখন আমি একাউন্টগুলোর সুপারিশকারী ও কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতদের পরিচয় প্রকাশে প্রস্তুত ছিলাম না। তাই আমার আইনজীবীরা আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন লাগ্রোসাসের নাম উল্লেখ করতে যে, তিনিই আমাকে ট্রান্সফারের নির্দেশনা দিয়েছিলেন।’ নিশ্চিত হওয়ার জন্য সিনেটর ওসমেনা প্রশ্ন করেন, ‘তার মানে আপনি তখন কিম ওং-এর নাম উল্লেখ করতে চাননি। এটাই তো বলছেন এখন? সে জন্য আপনি তখন মিথ্যা বলেছিলেন। বলেছিলেন যে, লাগ্রোসাস আপনাকে টাকা স্থানান্তরের নির্দেশনা দিয়েছিল। তাই তো?’ তখন দেগুইতো জবাবে বলেন, ‘জ্বি।’
সিনেটর আবারও প্রশ্ন করেন, ‘এখন আপনি বলছেন যে, লাগ্রোসাস আপনাকে টাকা ট্রান্সফারের নির্দেশ দেয়নি?’ আবারও দেগুইতো উত্তর দেন, ‘জ্বি স্যার। আসলে মি. ওং আমাকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন।’ ওসমেনা বলেন, ‘আপনি তাহলে আপনার নিজের হেড অফিসের কাছে মিথ্যা বলেছিলেন?’ তখন দেগুইতো আবারও একই ব্যাখ্যা দিতে চাইলে সিনেটর তাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘না, মিথ্যা বলার জন্য আমাদের কোনো অজুহাত দেবেন না।’ দেগুইতো পরে বলেন, ‘আপনি যদি ওই মিথ্যাকে বিবেচনা করেন স্যার, তবে হ্যাঁ, আমি এটা স্বীকার করবো।’
ফিলরেমে ব্যবহার করা হয়েছে জাল রিসিপট
বাংলাদেশের রাজকোষ থেকে চুরি করা অর্থ নগদ ডেলিভারি দেয়ার সময় জাল রিসিপট ব্যবহার করা হয়েছিল। এমন একটি রিসিপট উপস্থাপন করেছে ফিলরেম সার্ভিসেস করপোরেশন। মঙ্গলবার এ তথ্য প্রকাশ করেছেন ফিলিপাইনের সিনেট ব্লু রিবন কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর তিওফিস্তো গুইঙ্গোনা তৃতীয়। তিনি স্থানীয় একটি রেডিওর সঙ্গে কথা বলছিলেন। এরই এক পর্যায়ে তিনি এ তথ্য প্রকাশ করেন। এ সময় তিনি ফিলরেমের একজন ম্যাসেঞ্জারের বিলাসবহুল বাড়ি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
এ খবর দিয়েছে এবিএস-সিবিএন নিউজ। এতে বলা হয়েছে, ফিলরেম যে রিসিপট উপস্থাপন করেছেন তাতে দৃশ্যত স্বাক্ষর রয়েছে জাঙ্কেট অপারেটর ওয়েইকাং সু’র। বাংলাদেশের চুরি করা ৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের ভাগ তিনিও পেয়েছিলেন। উপস্থাপিত রিসিপটে যে স্বাক্ষর রয়েছে ওয়েইকাং সু’র তার সঙ্গে তার পাসপোর্ট ও ফিলিপাইনের ভিসা আবেদনের স্বাক্ষরের সঙ্গে কোনো মিল নেই। আজ আবার এ ঘটনায় সিনিট ব্লু রিবন কমিটিতে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে ওই রিসিপট উপস্থাপনের কথাও রয়েছে। উল্লেখ্য, ফিলরেম ও ক্যাসিনো জাঙ্কেট অপারেটর কিম ওং এর মধ্যে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা পরস্পরবিরোধী। চুরি যাওয়া অর্থের এক কোটি ৭০ লাখ ডলার সম্পর্কে তারা দু’রকম তথ্য দিয়েছেন। ফিলরেম প্রেসিডেন্ট সালুদ বাউতিস্তা ও তার স্বামী ফিলরেমের কোষাধ্যক্ষ মাইকেল কোনকোন বাউতিস্তা বলেছেন, ওই এক কোটি ৭০ লাখ ডলার তাদের কাছে নেই। তারা নগদ অর্থ দেয়ার সময় ওই অর্থ পরিশোধ করে দিয়েছেন।
কিন্তু কিম ওং বলছেন, এ অর্থ ‘মিসিং’ হয়েছে। বাউতিস্তা দম্পতি ও কিম ওংয়ের মধ্যকার এই দুই রকম তথ্য যাচাই করতে এর আগে রেমিট্যান্স কোম্পানি ফিলরেমের ম্যাসেঞ্জার মার্ক পালমারেসকে তদন্ত কমিটি তলব করেছিল। কিন্তু অসুস্থতার অজুহাতে তিনি দু’বারই সিনেটের শুনানিতে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হন। ওদিকে পালমারেস যে বাড়িটি ব্যবহার করেন তার একটি ছবি গুগল আর্থ ব্যবহার করে উদ্ধার করেছেন এমপিরা। তাতে দেখা যায় ওই বাড়িটি বিশাল। এ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন গুইঙ্গোনা। ওই বাড়িটি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের অফিসের কাছে। গুইঙ্গোনা বলেন, তারা পালমারেসকে তলবের যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন তা গ্রহণ করেছেন পালমারেসের নিরাপত্তা প্রহরী।