খোলা বাজার২৪, রোববার, ২২ মে, ২০১৬: বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া কয়েকটি আলোচিত হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত এবং ওয়াশিংটন ডিসির উড্রো উইলসন সেন্টারের জ্যেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম বি মাইলাম বলেছেন, বাংলাদেশে এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য সন্ত্রাসবাদ ইস্যুটা বড় নয়, দুর্বল শাসন ব্যবস্থার ইস্যুটাই বড়।
বৃহস্পতিবার মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের এক নিবন্ধে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক হত্যাকাণ্ড এবং এই গতি-প্রকৃতি নিয়ে নিজের মত তুলে ধরেন তিনি।
নিবন্ধে মাইলাম বলেন, বাংলাদেশে গেল সপ্তাহে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু খুন হয়েছেন। সাম্প্রতিককালে সংখ্যালঘু, ধর্মীয় নেতা ও সমকামীসহ প্রায় ২৫ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব হত্যাকাণ্ডের কয়েকটি জনসমক্ষেই হয়েছে। ধর্মীয় সংখ্যালঘু, নাস্তিক অথবা বাকস্বাধীনতার পক্ষে থাকা ব্যক্তিদের হত্যাকাণ্ডের শুরু গত বছর ফেব্র“য়ারিতে। অনেকে হামলার শিকার হয়েও বেঁচে গেছেন। ২০টি বেশি হামলার দায় স্বীকার করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস), ছয়টির বেশি হামলার দাবি আল-কায়েদা করেছে। আর ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর চালানো দুটি হামলার দায় স্বীকার করেছে বাংলাদেশের স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠী জামাতুল মুজাহিদীন ও আনসার আল-ইসলাম।
স্বাভাবিকভাবেই জঙ্গি হামলার ঘটনা পশ্চিমা দেশগুলোকে বিচলিত করেছে। অনেক পশ্চিমা দেশ এই সংকটে বাংলাদেশকে সহায়তার হাত বাড়িয়েছে। বাংলাদেশের বেসামরিক বিমান নিরাপত্তায় সহায়তা করছে জাপান। জঙ্গি ও চরমপন্থিদের দমনে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তার প্রস্তাব করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে মাইলামের মতে, পশ্চিমা বিশ্বের এমন প্রতিক্রিয়া ধারণায় ছিল। কিন্তু এটা ভুল পথে চালিত এবং বিপজ্জনক। ভুল কারণ নির্ণয় করে এসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। কারণ বাংলাদেশে এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য সন্ত্রাসবাদ ইস্যুটা বড় নয়, দুর্বল শাসন ব্যবস্থার ইস্যুটাই বড়।
বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বি মাইলাম বলেন, ১৯৯১ সালের পর থেকে দেশটির দুটি দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ক্ষমতার পরিবর্তন হয়। যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, অপর দলকে দুর্বল করার চেষ্টা সব সময় দেখা গেছে। এ কারণেই অর্থনৈতিক বিস্তারে বিনিয়োগের বিষয়টি বেসরকারি খাতকেই করতে হয় এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক উন্নয়নসহ যেসব সেবা সরকার দেয় না, এনজিওরা সরবরাহ করে। দুই দশক ধরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৫ থেকে ৬ শতাংশের মতো বাড়ছে। সামাজিক ও স্বাস্থ্যের অনেক সূচকে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অব্যাহতভাবে খারাপের দিকে গেছে।
মাইলাম নিবন্ধে বলেছেন, বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বয়কটের পর আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে কার্যত এক দলের রাষ্ট্র বানিয়েছে। সরকারের তথাকথিত আইন প্রয়োগের একমাত্র টার্গেট হলো বিএনপি। আওয়ামী লীগ রুটিনমাফিক বিরোধী দলগুলো দমনে ও ভিন্ন কণ্ঠস্বর রোধে বিচার ব্যবস্থা ও পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করছে। বিরোধী দলের বিরুদ্ধে বিরতিহীন প্রচারণার সুযোগে উগ্রপন্থিরা বাধনমুক্ত হওয়ার সুযোগ পেয়েছে। বিএনপির বিরুদ্ধে বিচারিক ও পুলিশি শক্তি ব্যবহারের ফলে সীমিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপরাধ ও সন্ত্রাস দমনে নিয়োজিত হতে পারেনি। এ কারণে সৃষ্ট দায়মুক্তির পরিবেশে উগ্রপন্থি ও সন্ত্রাসীরা বেড়ে উঠেছে।
বাংলাদেশে একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটলেও সরকারের নেতাদের দাবি হলো, দেশে কোনো আল-কায়েদা অথবা ইসলামিক স্টেট নেই। তাদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে বিএনপি এবং অন্য বিরোধীরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। সম্প্র্রতি বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা জুলহাজ মান্নান হত্যাকাণ্ডের পরও সরকারের পক্ষ থেকে এমন দাবি দেখা গেছে।
নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধে তিনি আরো লিখেছেন, বাংলাদেশের সরকার মত প্রকাশের স্বাধীনতার ওপর হস্তক্ষেপ করছে। বর্তমানে বাংলাদেশে জঙ্গি হুমকির বিষয়টি মূল্যায়ন করা বেশ কষ্টকর। একই অবস্থা স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক খুঁজে বের করার ক্ষেত্রেও। এর ধরন যা-ই হোক, এটি মূলধারার ওপর সরকারের অব্যাহত চাপেরই একটি বড় ফল। তাই এসব হামলাকে একে শাসন ব্যবস্থার সমস্যা হিসেবে না দেখে নিরাপত্তার ইস্যু হিসেবে দেখা ভুল হবে। এতে পরিস্থিতি আরো খারাপই হতে পারে।