Thu. May 1st, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

কী আছে অর্থমন্ত্রীর মনেখোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ০২ জুন২০১৬: রাজস্ব আয় ৩৫ শতাংশ বাড়িয়ে তা আহরণে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কালো ব্রিফকেসে কী কী জাদু লুকানো আছে, তা দেখার অপেক্ষা ফুরোবে বৃহস্পতিবার দুপুরে।
ঝানু ব্যবস্থাপক মুহিত তার অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার সার্বিক ব্যবস্থাপনায় কী কী বটিকা বের করেন, তা জানতে করদাতা জনগণ এদিন দুপুরে টিভি অন করবে, রেডিওর নব ঘুরাবে আর চোখ সেঁটে রাখবে মোবাইল ফোন আর কম্পিউটারের স্ক্রিনে।
এ যাবত প্রস্তুতির খবর থেকে জানা যাচ্ছে, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে আড়াই লাখ কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের বিশাল লক্ষ্য ধরে প্রায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা ব্যয়ের উচ্চাভিলাষে আগের সব রেকর্ড ভাঙতে যাচ্ছেন ৮৩ বছর বয়সী সাবেক দুঁদে আমলা মুহিত।
দুই বছর পর ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে ৫ লাখ কোটি টাকার বাজেট ছুঁতে আয় এবং ব্যয় দুটোর আকার এবার যতদূর সম্ভব বাড়িয়ে ধরছেন তিনি; যদিও বিদায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের শেষ দিকে এসে রাজস্ব বোর্ডের লক্ষ্যমাত্রা ২৬ হাজার কোটি টাকা কমাতে হয়েছে তাকে।
রাজস্ব আয়ে লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থতার জন্য প্রকাশ্য বিরক্তি ঝেড়ে কারও কারও মতে দায় সারলেও যে বাজেট দিতে যাচ্ছেন তাতে এনবি আর এর জন্য আয়ের লক্ষ্য একটুও কম রাখছেন না, বরং চলতি বাজেটের চেয়ে আয়ের প্রবৃদ্ধি আরও অনেক বাড়িয়ে বড় ব্যয় পরিকল্পনা করেছেন মুহিত।
অর্থমন্ত্রী ইতোমধ্যেই বলেছেন, ২০১৮-১৯ সালে বাংলাদেশকে কোথায় নিতে চান-তা মাথায় রেখেই বাজেট প্রস্তাব করছেন তিনি। আর এজন্য রাজস্ব আয় এবং ব্যয়ে বরাবরের উচ্চাভিলাষ ছাপিয়ে নতুন ধাপে যেতে চাইছেন তিনি।
করদাতাদের ওপর চেপে আয় বাড়িয়ে এমনকি ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার স্বপ্নও আছে সাহিত্যের এককালের নামজাদা ছাত্র মুহিতের।
প্রস্তুত মুহিত
২০১৬-১৭ অর্থবছরের বাজেট পেশের সব প্রস্তুতি শেষ। বৃহস্পতিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় নিয়ম মেনে কালো ব্রিফকেস হাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সঙ্গে নিয়ে সংসদে প্রবেশ করবেন অর্থমন্ত্রী। উপস্থাপন করবেন এই সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের তৃতীয় এবং ব্যক্তিগত দশম বাজেট। অবশ্য এরই মধ্যে টানা সাত বার বাজেট দেয়ার কৃতিত্ব অর্জন করেছেন তিনি। এবার হতে চলেছে অষ্টম।
ভিন্ন প্রেক্ষাপটে এরশাদ সরকারের সময় (১৯৮২-৮৩ এবং ১৯৮৩-৮৪ অর্থবছর) দুটি বাজেট দিয়েছিলন মুহিত।
প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া একাধারে ছয়টি বাজেট দেন।
সবচেয়ে বেশি বাজেট দেয়ার রেকর্ড এখনও আরেক প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের। তিনি মোট ১২টি বাজেট দিয়েছেন।
মুহিত সম্প্রতি বলেন, “বড় বাজেট দিতে দিতে আমার সাহস হয়ে গেছে। আশাবাদী করেছে আমাকে। সেই সাহস-আশাবাদ থেকেই এবার আমি সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার বাজেট দিতে যাচ্ছি।”
চ্যালেঞ্জ আয়
অপেক্ষাকৃত বড় বাজেট বাস্তবায়নের জন্যই আড়াই লাখ কোটি টাকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন মুহিত।
৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্য পূরণ না হওয়ায় উম্মা প্রকাশ করে মন্ত্রী বলেন, “আমি আমার সপ্তম বাজেট সংশোধন করছি; সেখানে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ৮ শতাংশ কম হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই এটা নিয়ে আমি খুব উদ্বিগ্ন।”
‘তারপরও অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট’ বড় বাজেট দিতে সাহস জুগিয়েছে মুহিতকে।
তার যুক্তি, “রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। হরতাল-অবরোধ চিরবিদায় নিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। আমাদের উদ্যোক্তাদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে।”
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম কম থাকার কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের রাখতে পারাও স্বস্তি দিচ্ছে মুহিতকে।
“বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৯ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। রপ্তানি খাতে ইতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। সব মিলিয়েই আমাকে সাহস দিয়েছে বড় বাজেট দিতে,” বলেন তিনি।
নতুন বাজেটে চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, “আমার বিবেচনায় রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাড়ানোই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর যদি রাজস্ব আদায় বাড়ানো না যায়, তাহলে বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন হবে।”
তার পরামর্শ: রাজস্ব আদায় বাড়াতে সরকার ও করদাতাদের মধ্যে যাতে ‘উইন উইন সিচ্যুয়েশন’ হয়, সেই পথ অবলম্বন করতে হবে। ব্যক্তি খাতকে সম্পূর্ণ আস্থায় নিতে হবে। করদাতার সংখ্যা বাড়াতে হবে; এভাবেই বাড়াতে হবে রাজস্ব।
করদাতার সংখ্যা বাড়ানো গেলে কর হার কমিয়েও বেশি রাজস্ব আদায় সম্ভব বলে মনে করেন ফরাসউদ্দিন।
বিনিয়োগের কী হবে?
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম এবং গবেষক জায়েদ বখত মনে করেন, বিনিয়োগ বাড়ানোই নতুন বাজেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
বিদায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের ১০ মাসের হিসাবে (জুলাই-এপ্রিল) সরকারের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়নের হার সবচেয়ে কম-এই তথ্য দিয়ে মির্জ্জা আজিজ বলেন, “সরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশপাশি এর কাজের গুণগতমানও নিশ্চিত করতে হবে।”
বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বি আইডিএসের গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত বলেন, “আমার বিবেচনায় আগামী বাজেটের মেইন চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিৎ বিনিয়োগ বাড়ানো।”
বিনিয়োগ বাড়লে রাজস্ব আদায় বাড়বে বলেও মনে করেন তিনি।
গত কয়েক বছরের বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের ৫ বছরে সরকারের আয় অর্থাৎ রাজস্ব আদায় বেড়েছে গড়ে ১১ শতাংশ হারে। অবশ্য একবার ২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধিও ছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবি আরের আয়ে। পাল্লা দিয়ে ব্যয়ও বাড়িয়েছে সরকার। তবে আয়-ব্যয়ের ঘাটতি কোনোবারই ৫ শতাংশের বেশি হতে দেননি অর্থমন্ত্রী।
স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রথম বাজেটের আকার ছিল মোটে ৭৮৬ কোটি টাকা। ৩টি বাজেট দেওয়া জিয়াউর রহমানের শেষ বাজেটও ছিল আড়াই হাজার কোটি টাকার মধ্যে। ৪ হাজার ১০০ কোটি দিয়ে শুরু করে সবচেয়ে বেশি বার বাজেট দেয়া প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানের শেষ বাজেট অবশ্য ছিল ৭০ হাজার কোটি টাকার।
মাঝে আওয়ামী লীগ সরকারের ৯৬-২০০১ মেয়াদে প্রয়াত অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াও বাজেটের আকার বাড়ানোর ব্যাপারে অত উদার ছিলেন না। তত্ত্ববধায়ক সরকারের দুই বছরের শাসনামলে এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের বাজেটও ছিল ১ লাখ কোটির মধ্যে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিতীয় মেয়াদে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়া আবুল মাল আবদুল মুহিত সাহস দেখিয়েছেন বড় বাজেট দেওয়ার। দিন বদলের স্বপ্ন দেখানোর দর্শন নিয়ে ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনার সরকার বা তার দল আওয়ামীলীগ কতটুকু সফল সে স্বপ্নপূরণে?
মুহিতের উত্তর: শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯-১০ অর্থবছরে আমি যে বাজেট দিয়েছিলাম তার আকার ছিল এক লাখ ১৩ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। আট বছরের মাথায় সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার যে বাজেট দিচ্ছি সেটা দিন বদলের স্বপ্ন পূরণেরই বাজেট।
“সেই স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছেৃ। ২০২১ সালের আগেই আমরা মধ্যম আয়ে দেশে পরিণত হব।”
সামষ্টিকের স্থিতিই ভরসা
বিদায়ী ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ২ লাখ ৯৫ হাজার ১০০ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ের (এনবি আর) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ১ লাখ ৭৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। ১০ মাসের হিসাবে (জুলাই-এপ্রিল) রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি হলেও লক্ষ্যমাত্রা থেকে অনেক পিছিয়ে আছে এনবি আর। সে কারণেই লক্ষ্যমাত্রা ২৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা কমিয়ে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
পাশাপাশি মোট বাজেটের আকার সংশোধন করে ২ লাখ ৬৫ হাজার টাকায় নামিয়ে আনা হয়।
নতুন বাজেটের আকার হতে পারে ৩ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকার মতো। এনবি আর-নন এনবি আর মিলে মোট রাজস্ব প্রাপ্তির লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবি আরের মাধ্যমে ২ লাখ ৩ হাজার ১৫০ কোটি টাকা আদায় করার হিসাব কষেছেন অর্থমন্ত্রী, যার মধ্যে ভ্যাট থেকেই ৮০ হাজার কোটি টাকা আদায় করা হবে।
তবে ভ্যাট আদায়ের এই লক্ষ্যে ইতোমধ্যে বাগড়া হতে চলেছেন ব্যব্সায়ীরা। ১ জুলাই থেকে বিক্রির উপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাটের নতুন আইন থেকে হয়ত পিছুও হটতে পারেন মুহিত। তবে কী হচ্ছে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত।
নতুন বাজেটে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির (জিডিপি প্রবৃদ্ধি) লক্ষ্য ধরা হচ্ছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ। বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের নীচে; ৫ দশমিক ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রত্যাশা নিয়ে বাজেট দেবেন মুহিত।
সামগ্রিক বাজেট ঘাটতি ৫ শতাংশের (জিডিপির) মধ্যেই থাকবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বিডিনিউজ২৪