খোলা বাজার২৪, বুধবার, ১৫ জুন ২০১৬: আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলার আপিলের রায়ে হাইকোর্ট তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেছেন, ‘রাজনীতিক দলগুলোর মধ্যে উচ্ছৃঙ্খল কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে দেখা যায় না। দলগুলো এসব কর্মীদের ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। এসব কর্মীদের পরিহার করা না হলে সুস্থ রাজনীতি ও সংস্কৃতি বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।’
আজ বুধবার আহসান উল্লাহ হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের রায়ে দেওয়া হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণে এসব কথা বলা হয়। বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের ডিভিশন বেঞ্চ এই পর্যবেক্ষণ দেন।
পর্যবেক্ষণে তৃণমূল থেকে উঠে আসা আওয়ামী লীগ নেতা আহসান উল্লাহ মাস্টারের রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা, হত্যার মামলার আসামিদের রাজনৈতিক প্রভাব ও বেপরোয়া মনোভাব, রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন সর্বোপরি আদর্শবর্জিত রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের অবৈধ ব্যবসায়িক স্বার্থের দ্বান্দ্বিক নানা মেরুকরণের রূপরেখাও উঠে এসেছে।
রায়ে আদালত বলেছেন, ‘এই হত্যাকাণ্ড একটি জঘন্যতম ঘটনা। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন জড়িত এটি উপলব্ধি করা যায়।’
আহসান উল্লাহ হত্যা মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ২০০৪ সালের ৭ মে গাজীপুরের টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় সংসদ সদস্য আহসান উল্লাহ মাস্টারকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনার পরের দিন তাঁর ভাই মতিউর রহমান টঙ্গী থানায় হত্যা মামলা করেন।
সাধারণ একজন স্কুলশিক্ষক থেকে রাজনীতিতে আসা আহসান উল্লাহ মাস্টার ১৯৮৩ ও ১৯৮৮ সালে পুবাইল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরে ১৯৯০ সালে গাজীপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তিনি। গাজীপুর-২ আসন থেকে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালে পর পর দুবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
এ সময়ে আহসান উল্লাহ মাস্টার জাতীয় শ্রমিক লীগের কার্যকরী সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
আজ আপিল বিভাগে আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় প্রধান আসামি বিএনপি নেতা নূরুল ইসলাম সরকারসহ ছয়জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে রায়ে নয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ এবং ১১ জনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
‘এক ঢিলে দুই পাখি’
আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে আহসান উল্লাহ মাস্টারের রাজনৈতিক অবস্থান ও ভূমিকার বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, তিনি একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন। জননেতা থাকাকালে তিনি গাজীপুরে মাদক ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তিনি বেঁচে থাকলে জনগণের কল্যাণে আরো ভাল কাজ করতে পারতেন। কিন্তু তাঁকে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। আমাদের সংবিধান ও অন্যান্য আইন অনুযায়ী, একটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে মানুষের চাওয়া-পাওয়া এবং বিভিন্ন রকম দাবি-দাওয়া মিটানোর জন্য তথা মানুষের কল্যাণে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য।’
রায়ে আদালত আরো বলেন, জাতীয়তাবাদী যুবদলের কেন্দ্রীয় নেতা নুরুল ইসলাম সরকার এ মামলার অন্যতম আসামি। ঘটনা থেকে দেখা যায়, এ আসামির সঙ্গে আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতা মাহফুজুর রহমান মহলের সঙ্গে যতটুকু না ছিল রাজনৈতিক বৈরিতা তার চেয়েও বেশি ছিল অর্থনৈতিক সংঘাত। কেননা নুরুল ইসলাম সরকার ও মাহফুজুর রহমান মহল উভয়েই ব্যবসায়ী। উভয়ের মধ্যে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের একটি প্রতিযোগিতা ছিলো।
‘ব্যবসায় এককভাবে নিজের আধিপত্য বিস্তারের জন্য মাহফুজুর রহমান মহলকে খুনের পরিকল্পনা করেন নুরুল ইসলাম। সাক্ষীদের স্বাক্ষ্যের মাধ্যমে তা প্রমাণিত হয়েছে। পরিকল্পনা মোতাবেক, আওয়ামী লীগের সম্মেলনে আসামি নুরুল ইসলাম সরকার তাঁর গাড়িতে করে আসামি নুরুল ইসলাম দীপু ও শহীদুল ইসলাম শীপুকে সাহারা মার্কেটের সামনে নামিয়ে দেয়। পিঠ চাপড়ে কাজ সেরে ফেলার জন্য উৎসাহ দেয়।’
পর্যবেক্ষণে আরো বলা হয়, ‘এসব আসামিরা সম্মেলনে সভাস্থলের সামনে গিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়ে। আসামিরা মাহফুজুর রহমান মহলকে খুনের পরিকল্পনার পাশাপাশি আহসান উল্লাহ মাস্টারকেও হত্যা করার ষড়যন্ত্র করে। যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাঁকে হত্যা করার মধ্য দিয়েই। এতে করে এক ঢিলে দুই পাখি মারা পড়লো।’
‘আসামিরা বেপরোয়া, ভেবেছিল তাদের কিছুই হবে না’
আপিল আদালত আসামিদের বেপরোয়া মনোভাবের কথা উল্লেখ করে পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘আসামিরা এতই বেপরোয়া ছিল যে প্রকাশ্যে দিবালোকে সংগঠিত এই ঘটনার সময় কোনোরকম মুখাবরণ (মাস্ক) পর্যন্ত ব্যবহার করেনি। তারা ভেবেছিলো, তাদের চেহারা অনাবৃত থাকার কারণে কেউ যদি চিনেও ফেলে তথাপিও তাদের কিছু হবে না। তাদের এ ধরনের ভাবার কারণ হলো তাদের পিছনে এমন একটি শক্তি রয়েছে যে, ভবিষ্যতে সম্ভাব্য ঝামেলা হলে তাদের রক্ষা করার শক্তি রাখেন।’
‘আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ ধরনের উচ্ছৃঙ্খল কর্মীদেরকে পরিহার করার প্রবণতা দেখা যায় না বরং অনেকাংশে তারা এদের উপর নির্ভরশীল, যা কিনা দেশে সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিকাশের এক বিরাট অন্তরায়। সুস্থ রাজনৈকিতক সংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে এক বিরাট অন্তরায়’ যোগ করেন আদালত।