Thu. May 1st, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

41খোলা বাজার২৪, রবিবার, ২৬ জুন ২০১৬: ঝিনাইদহ: পুরোহিত আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী খুন হওয়ার পর ঝিনাইদহের নলডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিণত হয়েছে আতঙ্কের জনপদে।শুধু রাতে নয়, দিনের বেলাতেও মানুষ একা চলতে ভয় পাচ্ছে। হিন্দু-অধ্যুষিত এই এলাকায় ২০টির মতো ছোট-বড় মন্দির আছে। পুরোহিত হত্যার পর এসব মন্দিরে নিয়মিত পূজা-অর্চনা চলছে এখন সীমিত আকারে। ১০ জুন এই ইউনিয়নসহ আশপাশের এলাকায় জামাইষষ্ঠীর পূজাও হয়নি এখানে।
স¤প্রতি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের জেলা ঝিনাইদহের সদর উপজেলার নলডাঙ্গা ইউনিয়নের করাতিপাড়া, নারায়ণপুর, খেদাপাড়া, সোনাইখালী, নলডাঙ্গা, ডাকাতিয়াসহ আরও কয়েকটি গ্রাম ঘুরে ভয় ও আতঙ্কের এ চিত্র চোখে পড়েছে।
করাতিপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আনন্দ গোপাল গাঙ্গুলী নলডাঙ্গা বাজারে একটি দুর্গামন্দিরের পুরোহিত ছিলেন। ৭২ বছরের প্রবীণ এই পুরোহিতকে ৭ জুন সকালে মহিষেরভাগাড় নামক স্থানে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। দেশে সা¤প্রতিক সময়ে এ ধরনের অন্যান্য হত্যাকান্ডের মতো এ ঘটনারও দায় স্বীকার করে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস (ইসলামিক স্টেট)। এরপর সরকারের শীর্ষ কয়েকজন মন্ত্রী-সাংসদসহ ক্ষমতাসীন ১৪-দলীয় জোটের অনেকে ওই এলাকায় গিয়ে হিন্দু স¤প্রদায়কে আশ্বস্ত করেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসনও তৎপর। তারপরও সেখানকার বাসিন্দাদের ভীতি কাটছে না।
নলডাঙ্গায় অবস্থিত শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী মায়ের বাড়ি নামের মন্দিরটি সাড়ে তিন শ বছরের বেশি পুরোনো। আনন্দ গোপাল খুন হওয়ার পর পাঁচ কিলোমিটার দূরের এই মন্দিরের প্রধান পুরোহিত রামকৃষ্ণ ব্যানার্জি ভয়ে এলাকা ছাড়েন। তিনি মন্দিরে তালা দিয়ে অন্যত্র চলে যান। ফলে কয়েক দিন মন্দিরের নিয়মিত পূজা-অর্চনা পুরোপুরি বন্ধ ছিল। পরে পুরোহিত রামকৃষ্ণ ব্যানার্জিকে সবাই গিয়ে নিয়ে আসেন। এখন সীমিত পরিসরে পূজা-অর্চনা চালু করা হলেও সবাই উদ্বেগ-আতঙ্কের মধ্যে আছেন। পুরোহিত সন্ধ্যার পর ঘর থেকে বের হন না।
সিদ্ধেশ্বরী সর্বজনীন পূজা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মন্টু গোপাল বাবু বলেন, ‘সবাই ভয়ে আছে। পুজো-আচ্চা বন্ধ হবার জোগাড়। পুরোহিত রামকৃষ্ণ বাবুকে এখন পাহারা দিয়া বাড়ি থেকে নিয়ে আসতে হয়। ‘সইন্ধের পর ভক্তরাও আসতে চায় না।’ তিনি বলেন, সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবারের পূজায় এই মন্দিরে তিন হাজার মানুষের জন্য ভোগের আয়োজন হতো। এখন তা নেমে এসেছে পঞ্চাশের কোঠায়।
মন্দিরের প্রধান ফটকের সামনে মন্টু গোপালের সঙ্গে যখন কথা বলার সময় তখন পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছিলেন মুসা শেখ। মন্দিরসংলগ্ন বেগবতী নদীর ওপারে খেদাপাড়া গ্রামের তাঁর বাড়ি।

তিনি জানালেন, পুরোহিত আনন্দ গোপাল হত্যার ঘটনা শুধু হিন্দুদের নয়, ওই এলাকার মুসলমানদেরও কাঁপিয়ে দিয়েছে।
করাতিপাড়ায় পুরোহিত আনন্দ গোপালের বাড়ির পাশের ছোট মন্দিরটিতে সাপ্তাহিক হরিসভায় ৫০ থেকে ৬০ জন অংশ নিতেন। তিনি খুন হওয়ার পর ভয়ে লোকজন না আসায় এখানে নামকীর্তন আয়োজন করা সম্ভব হয়নি বলে জানালেন তাঁর প্রতিবেশী ফণীভূষণ ।

ছোট মন্দিরটির দেয়াল পাকা ইটের। টিনের ছাউনি দেওয়া বর্ধিতাংশেই হতো হরিনামের আয়োজন। এখন মেঝেতে ধুলার স্তর জমেছে। ফণীভূষণ বলেন, ‘আমরা কেউ মন খুলে বেড়াতে পারছিনা। উনি (আনন্দ গোপাল) ছিলেন ২২ গ্রামের পুরোহিত। নলডাঙ্গার হিন্দু-মোসলমান সবাই তাঁরে মান্য করত। সেই লোকের যদি এমন মৃত্যু হয়, তাহলে আমাদের কী হবে ?’

গত মঙ্গলবার দুপুরে আনন্দ গোপালের বাড়ির সামনে বসে কথা হয় পরিবারের কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে। আনন্দ গোপালের ছোট বোন রাধারানী মুখার্জি বলেন, ‘ভয় হচ্ছে দাদা। কী একটা বিভীষিকা! খালি মনের মধ্যে গলাকাটা মানুষটা আকৃতি পাচ্ছে।’
এই বাড়ির কাছে রাস্তার ডান পাশে একটি পুকুরের পাড়ে ভজন কর্মকারের কামারশালা। সেখানে পাটি পেতে শুয়ে-বসে ছিলেন স্থানীয় মসজিদের মুয়াজ্জিন মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী মোল্লা, কাঠমিস্ত্রি শান্তিপদ বিশ্বাস, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী অশোক রায়সহ আরও তিনজন কৃষিজীবী।
মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী মোল্লা জানান, আনন্দ গোপাল খুন হওয়ার পর তিনি নিজেও নিরাপদ বোধ করছেন না। তিনি জঙ্গিগোষ্ঠীর প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, ‘হিন্দু-মোসলমান বলে কথা নেই। ওরা তো কারো ছাড়ছে না।’
নারায়ণপুরের বিপুল কুমার বাগচী লাঙ্গলবাদ চৌদ্দপল্লী মহাশ্মশানের পুরোহিত। নারায়ণপুর ও করাতিপাড়ার মাঝামাঝি মহিষেরভাগাড়ে আনন্দ গোপাল খুন হওয়ার পর প্রথম কয়েক দিন তিনি বাড়ি ফিরতেই সাহস পাননি। এখন বাড়ি এলে দিনের বেলাতেই আবার লাঙ্গলবাদে ফিরে যান। বিপুল কুমার বাগচী বলেন, ‘লাঙ্গলবাদের মানুষ আমাক সাহস দিচ্ছে। পুলিশ-প্রশাসনও সক্রিয়। তারপরও ভয় কাটছে না।’ তিনি জানান, নারায়ণপুর রাস মন্দিরের পুরোহিতও ভয়ে মন্দিরে যেতে চাচ্ছে না।

নলডাঙ্গা ইউনিয়নের এই পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঝিনাইদহের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ বলেন, ‘আমরা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত আছি। মানুষকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছি। হত্যাকান্ডের পর জেলার ৩৬৫টি পূজা মন্দির ও গির্জায় সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। পুলিশের নিয়মিত টহল চালু আছে।’

এদিকে পুরোহিত খুন হওয়ার ১৩ দিন পর ২১ জুন রাতে ঝিনাইদহ পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন এক সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, আগের রাতে ঢাকার গাবতলী থেকে এনামুল হক (২৬) নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, যিনি ছাত্রশিবিরের ঝিনাইদহ পৌর এলাকার ২ নম্বর ওয়ার্ড শাখার সেক্রেটারি। এনামুল ওই দিন বিকেলে পুরোহিত হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দেন বলে জানান পুলিশ সুপার আলতাফ হোসেন ।

এনামুল সদর উপজেলার আড়মুখ গ্রামের ফজলুল হক জোয়ার্দারের ছেলে। তাঁর বড় ভাইয়ের দাবি, এ ঘটনার সঙ্গে তাঁর ভাই জড়িত নয়। ঘটনার আগে থেকে এনামুল চাকরির খোঁজে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। ১৬ জুন ঝিনাইদহ থেকে এনামুলের এক বন্ধুকে নিয়ে পুলিশ ঢাকায় গিয়ে তাঁকে আটক করে। এনামুলের বড় ভাই নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করে জবানবন্দি পাওয়ার দাবি করলেও নিহত আনন্দ গোপালের নিকটাত্মীয়রা সন্তুষ্ট নন। তাঁর ছোট ভাই গোবিন্দ গোপাল গাঙ্গুলী বলেন, ‘একজনরে ধরতে পারলে তো আরও দুইজনরে ধরতে পারার কথা। তাদের কথা তো কিছু শুনলাম না।’

অবশ্য তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে কিছু বলতে রাজি হননি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজবাহার আলী শেখ। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি তদন্তাধীন আছে। এ মুহূর্তে সবকিছু বলা সম্ভব না।