খোলা বাজার২৪, রোববার, ১০ জুলাই ২০১৬: গুলশান ও শোলাকিয়ায় সন্ত্রাসী হামলায় জড়িতদের কয়েকজন ভারতের পিস টিভির বক্তা জাকির নায়েকের অনুসারী। এ তথ্য প্রকাশ হওয়ার পর ভারতে জাকির নায়েকের পিস টিভি সম্প্রচার করলে শাস্তির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এদিকে রোববার দুপুরে মন্ত্রণালয়ের আইন-শৃঙ্খলা কমিটির এক বৈঠকে বাংলাদেশেও পিস টিভি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়া সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে পিস টিভির আলোচকদের বিভিন্ন বক্তব্য নিয়ে চলছে সমালোচনা।
বাংলা পিস টিভির আলোচক আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফের একটি বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। ফেসবুকে এ নিয়ে সমালোচনার ঝড় বইছে। ওই বক্তব্যে তিনি জঙ্গি নেতা ওবায়দুর রহমানের জন্য দোয়া করেছেন। ওই সময় ওবায়দুর রহমান কারাবন্দী ছিলেন। তার দুই ভাই জেএমবি নেতা শায়খ আব্দুর রহমান ও আতাউর রহমানের ফাঁসি হয়েছিল। ওই বক্তব্যে তিনজনের জন্যই দোয়া করেছেন আব্দুর রাযযাক।
এছাড়া আব্দুর রাযযাকের কয়েকটি বক্তব্যে তরুণদের প্রতি ‘উস্কানিমূলক’ আহ্বান রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া একাধিক বক্তব্যে পয়লা বৈশাখকে চরমভাবে আঘাত করা হয়েছে। একটি বক্তব্যে তিনি বলেন, জাতি বহু অন্যায়ে পড়ে আছে। বলিষ্ঠভাবে এ জাতির সামনে দাঁড়াতে হবে। জেল, শেল, ফাঁসিকে ৫ পয়সা দাম না দিয়ে যে জাতি পয়লা বৈশাখ মানে, সে জাতিকে কবর দেওয়ার জন্য মাঠে নামতে হবে।
অন্য আরেকটি বক্তব্যে তিনি বলেন, আমি পয়লা বৈশাখকে কবর দিতে এসেছি। আমি মরণকে ভয় করি না। আমি মুসলিম চির রণবীর। মরলে শহীদ বাঁচলে গাজী। আমি কি হিন্দুর ঘরে এসেছি? এছাড়া একাধিক বক্তব্যে তিনি বলেন, আমি পয়লা বৈশাখের মুখে লাথি মারি।
রাজশাহীর আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী মাদ্রাসার মুহাদ্দিস আব্দুর রাযযাক তার একটি বক্তব্যে হেফাজতের তাণ্ডবের ঘটনায়ও সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করেছেন। তিনি বলেছেন, শাপলা চত্বরে যা ঘটেছে পৃথিবীর ইতিহাসে কোনোদিন তা ঘটেনি।
এ ঘটনা ফেরাউনের বর্বরতাকেও ছাড়িয়ে গেছে দাবি করে তিনি বলেন, অন্ধকারে হাজার হাজার আলেমকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। একই বক্তব্যে তিনি বলেন, কাপুরুষ, রাসুলকে কটু মন্তব্য করে, তুমি বসে থাকো কীভাবে? তুমি তাদের ফাঁসি দিতে না পারলে তোমার ছেলে দিবে, না হলে ঈসা (আ.) এসে দিবে। অন্য আরেকটি বক্তব্যে তিনি বলেছেন, রাসুলকে নিয়ে যারা দুর্বল মন্তব্য করবেন তাদের হত্যা করতে হবে।
স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের সংখ্যার দিকে ইঙ্গিত দিয়ে আব্দুর রাযযাক বলেন, ৩০ হাজার না, ৩০ লাখ? মানুষই ছিল ৭ কোটি তো ৩০ লাখ হয় কিভাবে? বললে ফাঁসি হবে, চুপ থাকো।
শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানোর সমালোচনা করে পিস টিভির এ আলোচক বলেন, পায়ের জুতা খুলে সিমেন্ট মাটির পিলারে ফুল নিয়ে রাখো। তোমার বিদ্যাকে কবর দিতে এসেছি আমি। এসব মূর্তিকে ভাঙ্গার জন্য আমি জন্ম নিয়েছি। এছাড়াও কয়েকটি বক্তব্যে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভাস্কর্য ভেঙ্গে দেওয়ার দাবি করেছেন।
বর্তমান সরকারের নেতৃত্বের সমালোচনা করে এ বক্তা বলেন, বড়টা নারী, মেজটা নারী, ছোটটা নারী। এ দেশে গজব নাজিল হয়ে গেছে। তাহাজ্জুদ করে এটি বন্ধ করতে হবে? সে পথ বন্ধ না করলে এ গজব থামবে না।
উল্লেখ্য, ভারতের নিষিদ্ধ পিস টিভির প্রধান জাকির নায়েক বাংলা পিস টিভিরও প্রধান। এ টিভির বেশ কয়েকজন নিয়মিত বক্তা রয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম আব্দুর রাযযাক, যিনি রাজশাহীর আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী মাদ্রাসার অধ্যক্ষও ছিলেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসি ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে তিনজন ব্যক্তির ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তব্যের ভিডিও সরিয়ে নিতে আহ্বান জানায়। ওই তিন ব্যক্তি হলেন জসিমউদ্দীন রহমানী, আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ ও তারিক মানওয়ার। এর মধ্যে রহমানীর বক্তব্য শুনে অনেকেই উগ্র জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন বলে গ্রেফতারকৃত কয়েকজন জঙ্গি জানিয়েছে।
তিন বক্তার মধ্যে রহমানীকে পুলিশ আগেই আটক করেছে। ফেসবুকে অনেকেই জঙ্গিবাদে ম“ দেওয়ার অভিযোগে আব্দুর রাযযাককে দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছিলেন। ফেসবুকে, ইউটিউবে ও সিডি মাধ্যমে রাযযাকের ওয়াজ ও জুমা’র খুতবার অসংখ্য বক্তব্য ভিডিও করে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে; যা দম্ভোক্তি আর বিদ্রূপে ভরপুর।
ভারত-বাংলাদেশে অধ্যয়ন করা এ বক্তার অধিকাংশ বক্তব্যেই বাংলা সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে তরুণদের ক্ষেপিয়ে তোলার উপাদান রয়েছে। শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলার পাশাপাশি শাহজালাল, শাহপরান, মাইনুদ্দীন চিশতিসহ বিশিষ্টজনদের কবর লাথি দিয়ে গুড়িয়ে ফেলার আহ্বান জানান তিনি। জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে নানাভাবে কটূক্তি করে তাকে শিরক বলে ঘোষণা ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকেও নানাভাবে অপদস্থ করেছেন বিতর্কিত এ বক্তা।
দেশের আইন, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কটু মন্তব্যের পাশাপাশি নারীদের নিয়ে অপমানকর অনেক মন্তব্যও করেছেন আব্দুর রাযযাক। এমনকি নারী নেতৃত্বের অবসান না ঘটলে দেশে গজব বন্ধ হবে না বলে তার মন্তব্য। হেফাজতের তাণ্ডবেরর ঘটনায় হাজার হাজার আলেমকে রাতের অন্ধকারে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে মিথ্যাচার করেছেন তিনি, যদিও বাস্তব চিত্র ছিল ভিন্ন। তিনি বর্তমান সরকারকে ফেরাউন থেকে বর্বর আখ্যা দিয়ে পুলিশ সদস্যদের ফাঁসি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘কাপুরুষ তুমি বসে আছো কেন?’
বিতর্কিত এ বক্তার নানা বক্তব্যের সমালোচনা করে খোদ বিভিন্ন আলেমও ফেসবুকে সরব রয়েছেন কয়েক বছর ধরে। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে অনেকেই তার বক্তব্যে সরাসরি জঙ্গিবাদকে সমর্থন করার অভিযোগ এনে তাকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন।
তবে ফেসবুকে রাযযাকের নামেও অসংখ্য ফেসবুক আইডি এবং পেজ রয়েছে। ওইসব আইডি ও পেজে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে, তিনি জঙ্গিবাদের বিরোধী। জঙ্গিবাদের বিস্তৃতি ইহুদীদের চক্রান্তে, যা ইসলামের জন্য ক্ষতিকর।
যদিও তার বক্তব্যে এসব দাবির কোনো সমর্থন মেলে না। প্রতি বক্তব্যেই তিনি তরুণদের ‘কাপুরুষ’ উল্লেখ ‘আমি মুসলিম রণবীর, বাঁচলে গাজী মরলে শহীদ’ মন্ত্রে উজ্জীবিত করতে দেখা যায়।
এছাড়া বিভিন্ন বক্তব্যে তিনি আরেক বিতর্কিত বক্তা জাকির নায়েকের প্রশংসা করে, তার বিরুদ্ধে ইহুদীদের ষড়যন্ত্র চলছে বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন। বাংলা পিস টিভির ওয়েবসাইটে তার ব্যক্তিগত বৃত্তান্ত থাকলেও যোগাযোগের কোন ঠিকানা বা নাম্বার নেই।