খোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ১১ আগস্ট ২০১৬:
একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে গিয়ে যারা অকাতরে দেশের স্বার্থে জীবন করেছেন উৎসর্গ। শ্রীমঙ্গলের সেসব অকুতভয় বীর মুক্তিযোদ্ধা,বুদ্ধিজীবি শহীদদের স্মরণে তৈরী করা হয়েছিল বধ্যভূমি ৭১ শ্রীমঙ্গল। যে পুত পবিত্র স্থানটিকে ঘিরে বর্তমান প্রজন্ম খুঁজে পায় মুক্তিযুদ্ধের সেই স্মৃতি ও গৌরবময় চেতনা।
শ্রীমঙ্গল শহরের ভানুগাছ সড়কের বিজিবি ক্যাম্পের পাশেই সাধুবাবার বটের তল নামে ব্যাপক পরিচিত এ বধ্যভূমি ৭১ (একাত্তর)। আর সেখানে এসে প্রতিদিন ভিড়জমান দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ভ্রমণপিপাসু তরুন-তরুনী ও নানা শ্রেণী পেশার পর্যটকেরা।
কিন্তু শ্রীমঙ্গলে মুক্তিযোদ্ধের এই স্মৃতি বিজড়িত বধ্যভূমি একাত্তর স্থানটি ক্রমেই ম্লান হয়ে নানা অশ্লীলতার ঘোরটোপে পর্যটকের আড্ডাস্থল হিসেবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে দিন দিন খ্যাতি লাভ করছে।
বুধবার বিকেলে সরেজমিনে বধ্যভূমি একাত্তরে গিয়ে দেখা যায় এসব চিত্র। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ছেলে মেয়েরা অশ্লীলভাবে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে নানা অঙ্গ ভঙ্গিতে ছবি তুলছে। পর্যটক ছাউনির নীচে বসে একে অপরকে আলিঙ্গন করার এ দৃশ্য এখন নিত্যদিনকার।
শ্রীমঙ্গল প্রেসক্লাবের সহ সম্পাদক ক্রীড়া ও সাংস্খৃতিক মো.মামুন আহমেদ বললেন,প্রতিদিনই এখানে দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে কমবেশী পর্যটক এখানে আসছেন। এসে অনেকেই এক শ্রেণীর বখাটেদের ইভটিজিংয়ের বিড়ম্বনারও স্বীকার হচ্ছেন। বিশেষ করে শুক্রবার ও শনিবারে এই বধ্যভূমিতে দূর দুরান্ত থেকে পর্যটকদেও পদচারণায় মুখরিত হয় বধ্যভূমি একাত্তর। কিন্তু বধ্যভূমির ঘেষা চা বাগানের ভেতরে ও পর্যটক ছাউনিতে একশ্রেণীর তরুনরা তরুনীদের নিয়ে আড্ডায় জমিয়ে তুলে নানান অঙ্গ ভঙ্গিতে অশ্লীলতার ছবি তুলছেন। যা এই পবিত্র স্থানটির সুন্দর পরিবেশটা কুলষিত করছে।
গনমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক কর্মী জহিরুল ইসলাম সোহেল বললেন, মনে খুব কষ্ট লাগে যখন দেখি বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিস্তম্ভে অনেকেই ছবি তুলে পায়ে জুতা নিয়ে। আবার এই স্মৃতিস্তম্ভের পাশেই রয়েছে বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা দিয়ে বানানো বেদী। যেখানে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে জাতীয় দিবস গুলোতে পুষ্পার্ঘ্য অপর্ণ করা হয়। আর সেই মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধার জানানোর স্থানে বসে একশ্রেণীর তরুন-করুনীরা গল্প গুজব করে আবার কেউ কেউ ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বান্ধবীদের নিয়ে বেসামাল আড্ডা দিচ্ছে লাল সবুজের পতাকা দিয়ে বানানো বেদীতে। এসব দিকে কারো বিশেষ নজর না থাকায় সেখানে অবাধে ছেলেমেয়েদের অশ্লীল মেলামেশায় এখানকার পরিবেশ দিন দিন নষ্টের দিকে ধাবিত হচ্ছে।একই কথা বললেন সংবাদকর্মী সুলতান মাহমুদ।
জানা গেছে,বধ্যভূমি একাত্তরে সীমান্ত ৭১ ফ্রেশ কর্ণারের দায়িত্বে রয়েছে বিজিবি। এমনকি এই বধ্যভূমি পরিচালনার জন্য রয়েছে সুশীল সমাজ,মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে একটি কমিটি। এ কমিটিই বধ্যভূমি একাত্তর দেখভাল করার কথা।
শ্রীমঙ্গলে এ বধ্যভূমি একাত্তর দেখার জন্য বুধবার বিকেলে ঢাকা থেকে সন্তানসহ তিনজনের পরিবার নিয়ে এসেছেন শামীম আহমেদ। তিনি একজন সাংস্কৃতিক কর্মী।
তিনি বললেন,এখানে যে মুক্তিযোদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত যে দৃশ্য গুলো এখানে আছে এটি আমাদের সবার উচিত পরিষ্কার পরিছন্নতার পাশাপাশি পবিত্র রাখা।
এ স্থানটি আমাদের মুক্তিযোদ্ধের চেতনার কথা স্মরণ করে দেয়। এটি বাঙালীর অহংকার। আমি একজন সাংস্কৃতিক কর্মী হিসেবে, একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে বলতে চাই। আমাদের প্রত্যেকের উচিত মুক্তিযোদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত যে স্থান গুলো আছে সেগুলোর পবিত্রতা রক্ষা করা এবং পরিবেশ সুন্দর রাখা। এটি দেখার জন্য আমাদের প্রত্যেকের যেমন নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি প্রশাসন সরকার এবং সর্বস্তরের জনগনেরও উচিত এগিয়ে আসার। আমাদের এই পবিত্র স্থানগুলোর ঐতিহ্যকে ধরে রাখা, পবিত্রতা রক্ষা করা।
তিনি বললেন,শ্রীমঙ্গলের বধ্যভূমি একাত্তর এসে যা দেখেছি। অনেকে এখানে এসে এলো মেলো অশ্লীল ঘুরাফেরা করছেন। অসামাজিক অনেক কার্যকলাপ এখানে দেখা যায়। এখানে আসা ছেলেমেয়েদের পরিবেশটা কিছুটা একটু দৃষ্টি কটু দেখতে।
সেই দৃশ্যগুলো আসলে প্রশাসনের উচিত সেগুলো কঠোর হস্তে দমন করা। যাতে পরিবারের সকল সদস্য নিয়ে এখানে বেড়াতে সবাই আসতে পারেন। ছেলে মেয়ে ভাইবোন সবাইকে নিয়ে মুক্তিযোদ্ধের স্মৃতিগুলো একবার দেখতে পারে।
এ বিষয়ে সবাইকে যেমন সচেতন হতে হবে তেমনি প্রশাসন যেমনি আছে প্রেস বা মিডিয়া কর্মীদের বিষয়গুলো তুলে ধরতে হবে। সবার কাছে যেমন গ্রহণযোগ্য পরিবেশ তৈরী হয়। যেভাবে পরিবারের সবাইকে নিয়ে এখানে আসতে পারে। সেরকম একটা সুন্দর পরিবেশ যেন এখানে বিরাজ করে। সেজন্য সবার উচিত সে বিষয়ে নজর দেওয়া। বিশেষ করে প্রশাসনের এ ব্যাপারে বলিষ্টভাবে ভূমিকা নিতে হবে যাতে করে বধ্যভূমি একাত্তরের পবিত্রতা রক্ষা হয়।
একই সময়ে কথা হয় সাবিনা আক্তার এর সাথে। তিনি ৫ সদস্যের পরিবার নিয়ে এসেছেন ঢাকার যাত্রা বাড়ী থেকে। তিনি বললেন,অনেকদূর ভ্রমণ করে বধ্যভূমি একাত্তরে এসেছি। মুক্তিযোদ্ধের চেতনা বিষয়ক এ স্থানটি দেখতে। এখানে এসে যা দেখতে পেলাম,আসলে এটা শোভনীয় নয়। আমার মনে হয় যে,মুক্তিযোদ্ধের এত বড় একটা স্মৃতিবিজড়িত জায়গা। এই জায়গায় যদি এরকম পরিস্থিতি থাকে তাহলে ঘুরতে আসটাই বৃথা। আমার মনে হচ্ছে, এত কষ্ট করে এখানে আসছি, এটা ব্যর্থ হয়ে গেছে। আমি মনে করি প্রশাসন যদি এ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখেন। এখানের কেমন পরিস্থিতি। একটু সময় পর্যবেক্ষণ করে এর প্রতিকারে সুব্যবস্থা নেয়।
তিনি বলেন,প্রশাসনের কাছে আমার একটাই রিকোয়েস্ট থাকবে এটা একটা আদর্শ জায়গা। এটি একটি মুক্তিযোদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত পবিত্র স্থান। এই জায়গায় যাতে কোনও অশালীন কার্যকলাপ যাতে এখানে আর না ঘটে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, এখানে যারা কর্তৃপক্ষ আছেন ওরা যাতে এবিষয়টাকে এলাউ না করেন। কর্তৃপক্ষ এলাউ করতেছে বলেই ওরা সাহস পাচ্ছে। আমি অনুরোধ করব প্রশাসনকে। আপনারা অত্যন্ত গুরুত্বদিয়ে এ পবিত্র জায়গাকে পবিত্র রাখার চেষ্ঠা করবেন।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড কাউন্সিলের কমান্ডার কুমোদ রঞ্জন দেব বলেন,বধ্যভূমি একাত্তর স্থানটিতে অসংখ্য বুদ্ধিজীবি ও মুক্তিযোদ্ধাকে পাকহানাদার বাহিনীরা ধরে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। এ স্থানটি আমাদের পবিত্রতার স্থান। এখানে কেউ অশ্লীললতায় চলাফেরা করতে পারবে না। বিষয়টি নিয়ে বিজিবির সাথে আমি কথা বলব।
৪৬ বিজিবির কমান্ডিং অফিসার মেজর আখতার ইকবাল মুঠোফোনে বলেন,এটি ফিনলের জায়গা। বিজিবির জায়গা নয়। মুক্তিযোদ্ধের পবিত্রস্থান রক্ষা করা সবার দায়িত্ব। খারাপ কার্যকলাপের দেখার দায়িত্ব উপজেলা প্রশাসনের ও পুলিশ প্রশাসনের বিজিবির নয়।
শ্রীমঙ্গল থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, বধ্যভূমি একাত্তর যেহেতু বিজিবি ক্যাম্পের পাশে। তাই এটা তো দেখার দায়িত্ব বিজিবির। পুলিশ এখানে গেলে উনারা মাইন্ড করেন। তারপরও এ পবিত্রস্থানের সুন্দর পরিবেশ রাখার দায়িত্ব আমাদের সকলের। বিষয়টি আমরা দেখব।
এ প্রসঙ্গে শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো.শহীদুল হক বলেন, এটা বিজিবি দেখার দায়িত্ব। বিজিবি যখন পাশে আছে। তারাই বিষয়টা দেখবেন। তবুও এই পবিত্রস্থানের পবিত্রতা রক্ষার জন্য যা যা করার দরকার আমরা তাই করব।