Wed. Apr 30th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

1kখোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ১৮ আগস্ট ২০১৬: বাংলাদেশের ৬৩টি জেলায় ২০০৫ সালে একযোগে বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদীন তাদের সাংগঠনিক শক্তি সম্পর্কে একটি জোরালো বার্তা দিয়েছিল। বিভিন্ন জায়গায় হত্যা এবং বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করেছিল জেএমবি।
সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতা ও হত্যাকা- বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ব্যাপকভাবে বদলে গেছে নিষিদ্ধ সংগঠনটি। জেএমবির নাটকীয় এই পরিবর্তন কিভাবে?
১৯৯৮ সালে দেশের উত্তরাঞ্চলে ‘জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ বা জেএমজেবি’র জন্ম হয়। কিন্তু প্রথম কয়েক বছর এ সংগঠন সম্পর্কে নিরাপত্তা বাহিনী এবং সাধারণ মানুষের তেমন কোনও ধারনা ছিলনা ।
পরিস্থিতি বদলাতে ২০০১ সালের পর থেকে। ২০০৪ সালের দিকে সংগঠনটির নাম বদলে হয় জামা’তুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ বা জেএমবি।
সাম্প্রতিক জঙ্গি তৎপরতা এবং তার সাথে সম্পৃক্ত হত্যাকা-গুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত এক দশকে ব্যাপকভাবে বদলে গেছে জেএমবি সাংগঠনিক তৎপরতা।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, জেএমবি’র সাথে এখন শহরের শিক্ষিত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের অনেকেই যুক্ত হয়েছে।
গ্রামে যে সংগঠনটির উত্থান এবং ‘সর্বহারা নিধনের’ মাধ্যমে যাদের বিস্তার, গত এক দশকে সে জঙ্গি সংগঠনটির এতো নাটকীয় পরিবর্তন হল কিভাবে?
২০০৪ সালের মে মাসে সাংবাদিক জুলফিকার আলী মানিক রাজশাহীর বাগমারা এলাকায় গিয়ে তৎকালীন জেএমবি’র তিনজন শীর্ষ নেতার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। এরা হচ্ছেন- সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আব্দুর রহমান এবং সালাহউদ্দিন।
এদের মধ্যে প্রথম দু’জনের ফাঁসি হলেও সালাহউদ্দিন বর্তমানে পলাতক। ২০১৪ সালে ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশের প্রিজন ভ্যান থেকে তার সহযোগীরা তাকে ছিনিয়ে নেয়।
মানিক বলছেন, ২০০৪ সালের জেএমবি এবং ২০১৬ সালের জেএমবি’র মধ্যে বিস্তর তফাত। মি, মানিক বলেন, ‘ঐ সময়ের যে জেএমবি, সেটা ছিল একেবারেই মাদ্রাসা-ভিত্তিক একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিল। যাদেরকে রিক্রুট করা হয়েছিল, তারা গ্রামের নিম্নবিত্ত এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী।’
বর্তমানে জেএমবি সম্পর্কে পুলিশ যা বলছে সেটি পুরোপুরি ভিন্ন। মি. মানিকের বর্ণনায়, এখন পুলিশ যাদের জেএমবি’র সদস্য হিসেবে উল্লেখ করছে তাদের অনেকই শহরের শিক্ষিত এবং উচ্চবিত্ত।
তিনি বলেন, ‘দুই জেএমবি’র মধ্যে আমি আকাশ-পাতাল পার্থক্য দেখছি।’ দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় ‘সর্বহারা’ দমনের নামে প্রকাশ্যে আসে জেএমবি’র কর্মকা-। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জায়গায় তার আগে থেকেই ‘সর্বহারা’ পার্টির বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকা-ে মানুষ অতিষ্ঠ।
সে সুযোগটি নিয়েছিল জেএমবি। জেএমবি’র সে কর্মকা- সাধারণ মানুষের যেমন সমর্থন পেয়েছিল তেমনি প্রশাসনের ও প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল।
২০০৫ সালের পর থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর ব্যাপক অভিযানের মুখে জেএমবি কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ২০০৭ সালে সংগঠনের দুই শীর্ষ নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম এবং আব্দুর রহমানের ফাঁসি হয়।
কিন্তু জেএমবি’র এই পরিবর্তন হল কিভাবে? একটি গ্রামীণ উগ্রবাদী সংগঠন থেকে তারা কিভাবে শহরের শিক্ষিত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের সদস্যদেরও দলে ভিড়িয়েছে?
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) মুনিরুজ্জামান বর্তমান জেএমবিকে ‘হাইব্রিড জঙ্গি সংগঠন’ হিসেবে বর্ণনা করছেন। এখন জেএমবিতে বিভিন্ন শ্রেণি, পেশার মানুষের সমন্বয় হচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি মনে করেন, ২০১৪ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে ময়মনসিংহের ত্রিশালে পুলিশের প্রিজন ভ্যান থেকে জেএমবি’র অন্যতম শীর্ষ নেতা সালাহউদ্দিনসহ কয়েকজনকে ছিনিয়ে নেবার পর জেএমবি পুনরায় সংগঠিত হতে থাকে। এ সময়ের মধ্যে জেএমবি’র চিন্তা-ধারায় পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে বলে মনে করেন এ নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
জেএমবি’র লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে ‘ইসলামী শাসন’ প্রতিষ্ঠা করা। তবে জেএমবি’র এ পরিবর্তন কিভাবে ঘটলো সেটি এখনো পরিষ্কার নয় বলে উল্লেখ করছেন সাংবাদিক মি. মানিক।
তিনি বলেন, ২০০৪ সালে তিনি জেএমবি সম্পর্কে সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের মুখ থেকে সরাসরি জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু বর্তমানে জেএমবি সম্পর্কে পুলিশের ভাষ্য পাওয়া যাচ্ছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মুনিরুজ্জামান বলেন, সিরিয়া এবং ইরাকে জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটের আবির্ভাবের পর জেএমবি’র কর্মপদ্ধতিও বদলে গেছে।
গত পাঁচ বছরে ইন্টারনেটে জঙ্গি তৎপরতা বেড়েছে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে জেএমবি’র মতো সংগঠনগুলো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠনগুলোর সাথে যোগাযোগ তৈরি করছে।
বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হবার পর ২০০৯ সাল থেকে বহু সন্দেহভাজন জঙ্গিকে আটক করা হয়। ২০১২ সাল নাগাদ নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা এমন দাবীও করেছিলেন যে জেএমবি’র ‘মেরুদ- ভেঙ্গে’ দেয়া হয়েছে।
তাহলে কয়েক বছরের মাথায় সংগঠন হিসেবে জেএমবি কিভাবে তাদের পরিবর্তন করলো? মি. মুনিরুজ্জামান বলেন জঙ্গি দমন নিয়ে নিরাপত্তাবাহিনীগুলো কিছুটা ‘আত্মতুষ্টিতে’ চলে গিয়েছিল।
তিনি বলেন , ‘আমাদের এটা বোঝা উচিত সবসময় জঙ্গি সংগঠনগুলোর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের আমরা একবার সরিয়ে ফেলি বা মেরে ফেলি, তার অর্থ এই নয় যে সংগঠনটা সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে গেছে।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারের পরে জেএমবি তাদের কর্মপদ্ধতি বদলে ফেলেছে। তারা গ্রামের পাশাপাশি শহরেও তাদের লোকবল বাড়ানোর দিকে মনোযোগী হয়েছে।
বাংলাদেশের জঙ্গি হামলাগুলোর সাথে ইসলামিক স্টেটের সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারটি অস্বীকার করে থাকেন সরকারের একাধিক মন্ত্রীও । তারা বলেন, বাংলাদেশে আইএসের কোন অস্তিত্ব নেই এবং এগুলো স্থানীয় জঙ্গি সংগঠনেরই কাজ।
কিন্তু ইসলামিক স্টেটের সাথে জেএমবির এক ধরণের সম্পর্কের একটা ধারণা পাওয়া যায় আইএস’র মুখপত্র ‘দাবিক’-এর নিকট অতীতে প্রকাশিত কিছু নিবন্ধ থেকে। এতে স্পষ্টই বলা হয়, জেএমবিকে বাংলাদেশে তাদের ঘনিষ্ঠ সংগঠন বলেই মনে করে আইএস।
দাবিকের দ্বাদশ সংখ্যায় এক নিবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশের ইসলামপন্থী সংগঠনগুলোর মধ্যে একমাত্র জামাতুল মুজাহিদীনই যথার্থ ‘জিহাদি’ সংগঠন।
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, জেএমবি’র আগের কার্যক্রম এবং বর্তমান কাজের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে। শুরুর দিকে এই জঙ্গি সংগঠনটি বিভিন্ন জায়গায় বোমা হামলার মাধ্যমে যেভাবে কর্মকা- পরিচালনা করতো, সেখানে পরিবর্তন এসেছে।
দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা টার্গেট কিলিং-এ অংশ নিচ্ছে। এর মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং বিদেশী নাগরিকদেরও টার্গেট করা হচ্ছে।
তাছাড়া নিরাপত্তা বাহিনীর ভাষ্য অনুযায়ী নিষিদ্ধ এ সংগঠনটি এখন নারী সদস্যদেরও তাদের দলে টানার চেষ্টা করছে।
পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী সব মিলিয়ে গত এক দশকে ব্যাপকভাবে বদলে গেছে জেএমবি। যেটি হয়তো অনেকে ধারণাও করতে পারেননি। বিবিসি বাংলা