Wed. Apr 30th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

10খোলা বাজার২৪, শনিবার, ১২ নভেম্বর ২০১৬:
ভয়াল ১২ নভেম্বর আজ। উপকূলবাসীর জন্য সবচেয়ে শোকের দিন। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর রাতে দেশের দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চল নোয়াখালী, হাতিয়া, নিঝুমদ্বীপ, সুবর্ণচর, বরিশাল, পটুয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম, ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী ও মহেশখালীসহ দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যায় ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ‘গোর্কি’।

প্রায় দেড়শ মাইল বেগের গতি সম্পন্ন ঘূর্ণিঝড় ও ২০-২৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে মৃত্যুকূপে পরিণত হয় গোটা উপকূল। সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি এখনো কাঁদিয়ে তোলে উপকূলবাসীকে। ভয়াবহ এই দুর্যোগের তিন যুগ অতিবাহিত হলেও এখনো রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি মেলেনি। এ দিনটিকে উপকূল দিবস হিসেবে পালনের দাবি দীর্ঘদিনের।
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে হাতিয়ার বয়ারচরের সত্তোর্ধ্ব ইয়াকুব আলী জাগো নিউজে বলেন, সেই দিনটি ছিল রমজান মাসের কোনো এক বৃহস্পতিবার। সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ঝরছিল। বিকেলের দিকে বাতাসের বেগ বাড়ে। রমজান মাস হওয়ায় গ্রামের অধিকাংশ মানুষ সন্ধ্যার সঙ্গেই রাতের খাবার সেরে ভোররাতে তাড়াতাড়ি উঠার জন্য ঘুমিয়ে পড়ে। কিন্তু রাতের দিকে রেডিওতে খবর আসে উপকূলে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত। দিনভর কোনো সংকেত পাওয়া যায়নি। ঘুমন্ত মানুষের ওপর দিয়ে বয়ে যায় প্রাকৃতির ভয়াবহ হিংস্র থাবা। ঘুমের মধ্যেই জোয়ারের পানিতে ভেসে যায় উপকূলের হাজার হাজার মানুষ।
সেদিন বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি হারিকেনে রূপ ধারণ করে। যার প্রভাবে উপকূলীয় এলাকায় ২০-২৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, উপকূলবাসীর অধিকাংশ মানুষই এ সতর্কবাণী জানতে পারেনি। ঘুমন্ত মানুষের ওপর গভীর রাতে সর্বশক্তি নিয়ে আঘাত হানে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস ‘গোর্কি’।
মুহূর্তেই ঘর-বাড়ি, স্কুল-কলেজ, গাছ-পালা, গবাদিপশু, ফসলের মাঠ ও রাস্ত-ঘাট ভেঙে সমতলে পরিণত হয়। জলোচ্ছ্বাসের ফলে ভেসে যায় হাজার হাজার মানুষ। লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় উপকূলীয় এলাকার জনপদ। সেদিন শেষ রাতের দিকে প্রকৃতি শান্ত হয়ে আসে। কমতে থাকে জলোচ্ছ্বাসের পানি। কিন্তু থেকে যায় স্বজনহারাদের কান্না, আহাজারি আর হাহাকার। চারদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে লাশ আর লাশ। বাতাসে লাশের গন্ধ আর স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে পুরো উপকূলের বাতাস।
বয়ে যাওয়া সেই দুঃসহ স্মৃতির কথা এখনো ভুলতে পারছেন না উপকূলবাসী। আকাশে সামান্য মেঘ দেখলেই ভয়ে আতঙ্কে থাকেন তারা। চন্দ্র-সূর্য হিসাব নিকাশ আর ধারণার ওপর নির্ভর করেই ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের পূর্বাভাস জানার চেষ্টা করেন তারা। এ জনপদের মানুষ এখনো আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেননি। তাছাড়া আগের মতো সে ব্যবস্থাও নেই তাদের।
মড়ৎশরউপকূলবাসী জানান, এক সময় রেড ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন সংস্থার পক্ষ থেকে ঝড় জলোচ্ছ্বাসের পূর্বে বিভিন্ন সতর্ক বার্তা প্রচার করা হতো। কিন্তু এখন আর তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে তাদের দেখা তো দূরের কথা ভয়ে সব কার্যক্রম গুটিয়ে ‘নিরাপদে’ চলে যান তারা।
উপকূলবাসী আরো জানান, সম্প্রতি বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড়গুলোতে প্রশাসন কিংবা বেসরকারি সংস্থাগুলো থেকে কোনো সতর্ক বার্তা পায়নি তারা। দুর্যোগকালীন আশ্রয়ের জন্য কিছু সাইক্লোন সেন্টার থাকলেও সেগুলো রয়েছে প্রভাবশালীদের দখলে। এছাড়া কোনোটিতে স্কুল, হাসপাতাল কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের অফিস রয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, উপকূলে যে পরিমাণ মানুষ তার মধ্যে ৫ শতাংশ মানুষের জন্য রয়েছ আশ্রয় কেন্দ্রের ব্যবস্থা। তাছাড়া যে কয়টি রয়েছে সেগুলোর নেই দরজা জানালা। আবার এগুলোতে যাতায়াতের ভালো ব্যবস্থাও নেই। তাই বন্যার সম্ভাবনা দেখলে কন্টেইনার, খালি কলস কিংবা শুকনো নারিকেলেই ভরসা উপকূলবাসীর।
দুর্যোগ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় চরাঞ্চলের সাধারণ মানুষের। এসব চরে আধুনিক প্রযুক্তির কোনো ছোঁয়া এখনো লাগেনি। আবহাওয়ার পূর্বাভাস পান না তারা। এ অবস্থায় দুর্যোগের পূর্ব মুহূর্তে জোর প্রচারণা ও প্রস্তুতির দাবি জানিয়েছেন উপকূলবাসী। তাছাড়া দুর্যোগ সচেতনতার লক্ষ্যে ভয়াল ১২ নভেম্বর সরকারকে ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে পালন করারও আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
‘আট বছর আগে চরে আইছি। তুফান আইলে আল্লারে বোলান ছাড়া আঙ্গো কিচ্ছু করার নাই। বই বই তফসিগুনি। আল্লায়নি বলা কাটি লই যা। কোড়াই যামু, কোড়াই খামু? আঙ্গো তো কোনো জয়গা জমি নাই। সিড়র, আইলা, রোয়ানু। কতো বন্য গেলো কেউ তো আঙ্গোরে এক্কানা উদ্ধার কইত্তো আয়েন। ৩ বছরের নাতি জোয়ারে ভাসি গেছে। আর এক্কানা যদি জোরে আইতে তাইলে আন্ডা সব চলি যাইতাম। মরি গেলে খালে খালে ভাইসতাম।’ দীর্ঘশ্বাস নিয়ে কথাগুলো বললেন নোয়াখালী উপকূলের মেঘনা পাড়ের বাসিন্দা ভূমিহীন নূর নেচা বেগম। দুর্যোগের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজে এসব কথা বলেন।
তিনি জানান, তাদের এলাকায় কোনো বেড়িবাঁধ নেই। ঝড়-জলোচ্ছাস নয়, সাগরে সামান্য জোয়ার বৃদ্ধি পেলেই পুরো এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়ে। আল্লার উপর ভরসা করে তখন সবাই নিজ ঘরেই অবস্থান করেন।
এ বিষয়ে উপকূল বাঁচাও আন্দোলনের উপদেষ্টা মশিউর রহমান রুবেল বলেন, ‘দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে সবাইকে আরো বেশি সচেতন হতে হবে। সচেতনতাই দিতে পারে ক্ষয়ক্ষতি থেকে মুক্তি। এতে যেমন উপকূলবাসীর দায়িত্ব রয়েছে তার চেয়ে বেশি দায়িত্ব সরকারের।’ দুর্যোগ সচেতনা বৃদ্ধির লক্ষে ১২ নভেম্বরকে দুর্যোগ দিবস হিসেবে পালন করার দাবিও জানান উপকূল বাঁচাও আন্দোলনের এই কর্মী।
সরকারিভাবে দিবসটি পালন না হলেও উপকূলের বিভিন্ন সামাজিক-স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দিনটিকে ‘উপকূল দিবস’ হিসেবে পালন করে থাকে।