খোলা বাজার২৪, বৃহস্পতিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬:
রাখাইন রাজ্যে নতুন রোহিঙ্গা বিদ্রোহকে ‘পালাবদল’ আখ্যা দিয়ে সেখানে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের ব্যাপারে কড়া সতর্কবার্তা জানিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ-আইসিজি।
সংস্থাটি বলছে, রাখাইনে চলমান সহিংসতার জন্ম হয়েছ গত অক্টোবর ও নভেম্বরে সৌদি আরব সমর্থিত হরকাত আল-ইয়াকিন নামে একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সুসংগঠিত আক্রমণের মধ্য দিয়ে।
এই সংগঠনটির বিদ্রোহী কর্মকাণ্ড অন্য সন্ত্রাসী বা আন্তঃদেশীয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর চেয়ে আলাদা। তারা অন্য ধর্মাবলম্বী ও বেসামরিক নাগরিকদের হামলা করছে না।
বরং মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্য অর্জনে নিরাপত্তা বাহিনীর উপর হামলা চালানোর সহিংস উপায় বেছে নিয়েছে আল- আল-ইয়াকিন।
এই পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনা বাহিনীর অভিযানের বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা জানিয়েছে আইসিজে।
সংস্থাটির মতে, দুই দফা হামলার পর হরকাত আল-ইয়াকিন আরও হামলা চালাতে পারে। অন্যদিকে সন্ত্রাস দমনের নামে সেনা অভিযানের ফলে পুরো সংখ্যালঘু মুসলিম জাতিটির সশস্ত্র হয়ে ওঠার ঝুঁকিতে পড়ছে।
এ অবস্থায় পরিস্থিতি এমন দিকে মোড় নিতে পারে, যার সুযোগ নিয়ে আন্তঃদেশীয় জিহাদীরা মিয়ানমারে তাদের নিজস্ব এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে পারে।
আইসিজের এশিয়া প্রোগ্রামের দুই পরিচালক টিম জনস্টন এবং অনাঘা নিলাকান্তন এক প্রতিবেদনে এ সতর্কতার কথা জানান।
গত ৯ অক্টোবর রাখাইনে বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন তিনটি চৌকিতে হামলা চালায় একদল সশস্ত্র ব্যক্তি। তারা মিয়ানমারের নয়জন সীমান্ত পুলিশকে হত্যা করে। এরপর থেকে রাখাইনের উত্তরাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী।
সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে বহু রোহিঙ্গা হত্যাযজ্ঞ, ধর্ষণ এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতন থেকে পালাতে ২৭ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এসব নিপীড়নের ঘটনা মিয়ানমারের নেত্রী অংসান সুচির বেসামরিক প্রশাসনের উপর চাপ তৈরি করেছে।
নিপীড়নের অভিযোগগুলো জোরালোভাবে অস্বীকার করে মিয়ানমার সরকার বলছে, তারা কয়েকশ’ সন্ত্রাসীকে আটক এবং লুট করে করে নেয়া অস্ত্র উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনী অভিযান চালাচ্ছে।
আইসিজি বলছে, গত ৯ অক্টোবর এবং ১২ নভেম্বরে নিরাপত্তা বাহিনীর উপর রাখাইনে যে হামলা হয়েছে তা গত কয়েক দশক ধরে সংঘটিত যেকোনো ঘটনার চেয়ে গুণগতভাবে একেবারেই আলাদা।
সৌদি সমর্থিত হরকাত আল-ইয়াকিন এ হামলা চালিয়েছে বলে এর বেশ কয়েকজন সদস্যের সাক্ষাৎকারকালে পাওয়া তথ্যের বরাতে দাবি করছে আইসিজে।
২০১২ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উপর সাম্প্রদায়িক হামলা চালায় বৌদ্ধরা। এতে প্রায় ২০০ নিহত এবং এক লাখ ২০ হাজার জন উদ্বাস্তু হয়। হতাহতদের বেশিরভাগই রোহিঙ্গা। তারা বহু বছর ধরে মিয়ানমারে নাগরিকত্ব বঞ্চিত, তাদের স্বাধীনভাবে চলাফেরা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত এবং সরকারি চাকরিতে যোগ দেয়ার সুযোগ একেবারেই সীমিত।
রোহিঙ্গাদের উপর পরিচালিত ওই সহিংসতার পর মক্কায় নতুন সশস্ত্র রোহিঙ্গা সংগঠন হরকাতুল ইয়াকিন গড়ে ওঠে। সংগঠনটির প্রচারিত বিভিন্ন ভিডিও থেকে জানা গেছে এর প্রধান হলে আতাউল্লাহ। তিনি করাচিতে জন্ম নেয়া একজন রোহিঙ্গা এবং মক্কায় বেড়ে উঠেছেন।
আতাউল্লাহ ২০ রোহিঙ্গার একটি দলের সদস্য, যাদের আন্তর্জাতিক আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের অভিজ্ঞতা রয়েছে এবং তারাই রাখাইনে সশস্ত্র অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে জিয়াবুর রহমান নামে সৌদিতে উচ্চাশিক্ষাপ্রাপ্ত একজন সিনিয়র আলেম রয়েছেন।
হরকাতুল ইয়াকিনের এসব প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রোহিঙ্গাদের মুক্তির জন্য লড়াই করার পক্ষে সৌদি আরব, আরব আমিরাত ও পাকিস্তানের সিনিয়র উলামাদের কাছ থেকে ফতোয়া নিয়ে আসে। এর মাধ্যমে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের মধ্যে তাৎপর্যপূর্ণ জনপ্রিয়তা অর্জন করে তারা।
এরপর অন্তত দু’বছর ধরে রাখাইনে কয়েকশ’ রোহিঙ্গাকে দলে ভিড়িয়ে গেরিলাযুদ্ধ এবং বিস্ফোরকের প্রশিক্ষণ দেয়।
আইসিজে বলছে, হরকাত আল-ইয়াকিনের কৌশল অত্যন্ত নিপুণ। গত ৯ অক্টোবর ভোররাতে সদর দফতরসহ সীমান্ত পুলিশের তিনটি ঘাঁটিতে হামলা চালায় তারা। সদর কমপ্লেক্সে কয়েকশ’ রোহিঙ্গা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হামলা চালায়। তারা সদর থেকে অস্ত্র লুট করার সময় এর সংলগ্ন সড়কে অ্যাম্বুশ করে যাতে ঘটনাস্থলে সেনা মোতায়েনে বিলম্ব হয়।
পরবর্তীতে ১২ নভেম্বর ফের হামলা চালিয়ে একজন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে তারা। এর মাধ্যমে তাদের দৃঢ় সংকল্প এবং সুপ্রশিক্ষিত বিদ্রোহী তৎপরতার বিষয়টি ফুটে উঠেছে। যাতে প্রতীয়মান হয় যে সামনের দিনগুলোতে তারা আরও হামলা চালাবে।
এদিকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার ও হামলায় জড়িতদের ধরতে বড় ধরনের অভিযান চালাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। ভূলণ্ঠিত মর্যাদা এবং আঘাতের জবাব দিতে সেনারা মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করছে। তবে সাধারণ মানুষের ভেতর থেকে হামলাকারীদের আলাদা করতে পারছে না তারা।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ গত ১৩ ডিসেম্বর স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে মিয়ানমার সেনা অন্তত এক হাজার ৫০০ রোহিঙ্গা বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। স্থানীয়ভাবে ৩০ হাজার মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে পড়েছে এবং ২৭ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
যেসব এলাকায় সেনাবাহিনী অভিযান চালাচ্ছে সেখানে পুরোপুরি অবরুদ্ধ অবস্থা বিরাজ করছে। এর ফলে সেখানকার গুরুতর মানবাধিকার হরণের অভিযোগগুলো স্বাধীনভাবে যাচাই করতে পারছে না মানবিধার বাহিনীগুলো। তবে বাংলাদেশে যে হারে রোহিঙ্গারা আসছে তাতে রাখাইনের আসল চিত্র পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠছে।
আইসিজের প্রতিবেদেন অং সান সুচির সমালোচনা করে বলা হয়েছে রাখাইনের পরিস্থিতি নিয়ে প্রকাশে খুব একটা উচ্চবাচ্য করেননি। এমনকি তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাননি বা সেনাবাহিনীর দমনাভিযানের সমালোচনা করেননি। সুচি নিয়ন্ত্রিত সরকারি সংবাদমাধ্যমে লাগামহীনভাবে নিপীড়নের অভিযোগ অস্বীকার করা হচ্ছে, যা ঘটনাস্থলে সেনাদের কর্মকাণ্ডকে দায়মুক্তি দেয়ার ঝুঁকি তৈরী করছে। এর ফলে মালয়েশিয়া এবং বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।
মিয়ানমার সরকারকে আনাড়িভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে ব্রাসেলস ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইসিজে। তারা বলছে, সরকারি বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র গোষ্ঠী হরকাত আল-ইয়াকিনের সমর্থনের দিকে ঠেলে দেব, যা একের পর এক সহিংসতার জন্ম দেবে। এর ফলে চরমপন্থার পরিস্থিতি তৈরি হবে যাকে ব্যবহার করে আন্তঃদেশীয় জিহাদী গোষ্ঠীগুলো মিয়ানমারে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে পারে। সন্ত্রাসী হামলা মিয়ানমারজুড়ে ধর্মীয় উত্তেজনা তৈরি করতে পারে, যা বড় ধরনের বিপর্যয়কর পরিস্থিতির জন্ম দিতে পারে।
যদি মিয়ানারের সেনাবাহিনীর লাগাম টেনে ধরা যায় এবং রোহিঙ্গাদের একটি সুন্দর রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আশাবাদী করা যায় তাহলে বিপজ্জনক পরিস্থিতি এড়ানো যাবে বলে মত দিয়েছে আইসিজে। সংস্থাটি এ অঞ্চলের দেশগুলোকে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা এবং গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের উপর গুরুত্বারোপ করেছে। একই সঙ্গে পরিস্থিতি শোচনীয় পর্যায়ে না যাওয়া রোধ করতে অংসান সুচিকে শক্তিশালী ভূমিকা রাখার আহবান জানেয়ছে।