খােলা বাজার২৪, শনিবার, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ : আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কম হওয়ায় নির্দিষ্ট হারে পেট্রল, অকটেন, কেরোসিন ও ডিজেলের দাম কমালেও বছরে এক হাজার ৮৫৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা লাভ করবে সরকার। দাম কমলে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও গ্রামাঞ্চলের মানুষের উপকারের পাশাপাশি সার্বিক অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তারপরও নানা অজুহাতে দাম কমানো হচ্ছে না।
অনেক আগে থেকেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলে আসছিলেন ডিসেম্বর কিংবা জানুয়ারিতে জ্বালানি তেলের দাম কমবে। কিন্তু অর্থনৈতিক ও আর্থিকভাবে অনেক সুবিধাজনক অবস্থায় থেকেও শেষ পর্যন্ত দাম কমায়নি সরকার। এমনকি সহসা জ্বালানি তেলের দাম কমানোর কোনো পরিকল্পনা নেই এমনটিই আভাস দিয়েছেন জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।
এ পরিপ্রেক্ষিতে জ্বালানির দাম কমানোর বিষয়টি পুনরায় বিবেচনার জন্য একটি প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এ প্রস্তাব অনুমোদন পেলে বিশেষত ডিজেল ও কেরোসিনের দাম কমালে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও গ্রামাঞ্চলের মানুষরাই বেশি উপকৃত হবেন। এনমকি দাম কমানো হলেও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) প্রতিটিতেই লাভে থাকবে। দাম কমানোর পরও প্রতি বছর পেট্রলে লাভ হবে ১১৬ কোটি ও অকটেনে ১২৫ কোটি টাকা। কেরোসিনে লাভ হবে ৩৩৫ কোটি টাকা।
আর ডিজেলে লাভ হবে এক হাজার ২৭৯ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ দাম কমানোর পরও জ্বালানির এ চার খাত থেকেই বিপিসি বছরে এক হাজার ৮৫৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা লাভ করবে। ডিজেলের দাম কমলে বিদ্যুৎ উৎপাদনেও ভর্তুকি কমবে। পাশাপাশি কৃষক ও বিদ্যুৎচালিত পাম্প ব্যবহারকারীরাও বিশেষ সুফল পাবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিষয়টি সম্পর্কে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে জ্বালানি তেলের দাম কমানো বা সমন্বয় করা উচিত। এ ক্ষেত্রে তিন মাস পরপর সমন্বয় করার একটি নীতি নিয়ে সরকার অগ্রসর হতে পারে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবনায় জ্বালানি তেলের দাম কমানো/সমন্বয় করা হলে অর্থনীতি এবং সাধারণ জনগণের ওপর কী প্রভাব পড়বে তার একটি বিবরণ দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করা হলে অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। জনগণও এর সুফল পাবে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থনৈতিক সমীক্ষায় প্রকাশিত তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৪-১৫ ও ২০১৫-১৬ অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৫৫ থেকে ৭ দশমিক ১১ শতাংশ হয়েছে, রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে ৩ দশমিক ৩৯ থেকে ৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
বেসরকারি বিনিয়োগ ২২ দশমিক শূন্য ৭ থেকে ২২ দশমিক ৯৯ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরের শেষ প্রান্তিকে বিগত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় মূল্যস্ফীতি কমেছে প্রায় ৭ থেকে ৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ। এর আগে জ্বালানি তেলের দাম কমানোর ফলেই এসব অর্জন সম্ভব হয়েছে। সরকার আবারও জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় বা কমালে এ খাতগুলোসহ অর্থনীতির অন্যান্য খাতেও সুফল পাওয়া যাবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা সারসংক্ষেপটি প্রস্তাব আকারে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে। প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিলে তা কার্যকরের উদ্যোগ নেয়া হবে বলে দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে।
জ্বালানি তেলের দাম কমানোর ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় একটি সারসংক্ষেপ তৈরি করেছে। সারসংক্ষেপে পেট্রলের দাম ৪ টাকা ৩০ পয়সা, অকটেনে ৪ টাকা ৪৫ পয়সা কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। দেশের বাজারে বর্তমানে পেট্রলের খুচরা মূল্য ৮৬ টাকা। ৪ টাকা ৩০ পয়সা কমালে পেট্রলের দাম হবে ৮১ টাকা ৭০ পয়সা। অকটেন বিক্রি হচ্ছে ৮৯ টাকায়। ৪ টাকা ৪৫ পয়সা কমালে দাম হবে ৮৪ টাকা ৫৫ পয়সা। একইভাবে কেরোসিন ও ডিজেলে ৫ টাকা করে কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। বর্তমানে দুটি পণ্যই ৬৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ৫ টাকা করে কমালে পণ্য দুটির মূল্য হবে ৬০ টাকা করে।
তবে এ চার জ্বালানির দাম কমানো হলেও বিপিসি প্রতিটিতেই লাভে থাকবে। পেট্রলে লাভ হবে ১১৬ কোটি টাকা। অকটেনে ১২৫ কোটি ও কেরোসিনে ৩৩৫ কোটি টাকা। আর ডিজেলে লাভ হবে এক হাজার ২৭৯ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ দাম কমানোর পরও জ্বালানি খাত থেকেই বিপিসি বছরে এক হাজার ৮৫৪ কোটি ৭২ লাখ টাকা লাভ করবে। আগামীতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কেমন থাকবে তা বিশ্লেষণ করে এ প্রস্তাবগুলো করা হয়েছে বলে সারসংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বলা হয়, সম্প্রতি প্রকাশিত ব্লুমবার্গ নিউজ অনুযায়ী, গত তিন বছরে জ্বালানি তেলের মূল্য পতন হলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০১৭ সালে এটি কিছুটা স্থিতিশীল থাকবে। এক্ষেত্রে জ্বালানি তেল (বিশেষত ব্রেন্ট ক্রুড অয়েল) বিক্রি হবে ব্যারেলপ্রতি ৫৮ মার্কিন ডলারে।
ব্লুমবার্গের আরেক প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত বছরের ২৮ ডিসেম্বরে গড়ে ব্যারেলপ্রতি ক্রুড অয়েলের মূল্য ছিল ৫৪ দশমিক ৩৩ মার্কিন ডলার। সে হিসাবে ২০১৭ সালে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের মূল্য ব্যারেলপ্রতি গড়ে ৫৬ মার্কিন ডলার দাম হবে বলে ধারণা করা যায়।
তবে সৌদি আরব, রাশিয়া, মেক্সিকো, বাহরাইনসহ আরও কিছু তেল উৎপাদনকারী দেশ উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে। চাহিদার তুলনায় যাতে সরবরাহ বেশি না হয় সে জন্যই দেশগুলো এ কৌশল অবলম্বন করছে। সৌদি আরব তেলের ব্যারেলপ্রতি মূল্য ৬০ থেকে ৭০ মার্কিন ডলারে উন্নীত করতে চেষ্টা করছে।
কিন্তু গালফ রিসার্চ সেন্টারের তথ্যমতে, চলতি বছর তেলের ব্যারেলপ্রতি মূল্য ৬০ মার্কিন ডলারের মধ্যেই ওঠানামা করবে। এছাড়া বিশ্বব্যাংকের প্রক্ষেপণ অনুযায়ীও চলতি বছর ব্যারেলপ্রতি মূল্য দাঁড়াবে ৫৫ দশমিক ২ মার্কিন ডলার। এ থেকে ধরে নেয়া যায়, চলতি বছর ব্যারেলপ্রতি জ্বালানি তেলের মূল্য ৬০ মার্কিন ডলারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। ৬০ মার্কিন ডলার বিবেচনায় হিসাব করলে (৮ শতাংশ কমালে) ডিজেলে লাভ থাকবে ৩ টাকা ২২ পয়সা। কেরোসিনের মূল্যও ৬০ টাকা ধরলে লাভ হবে ১০ টাকা ৫৬ পয়সা।
বর্তমানে সর্বোচ্চ ব্যবহৃত জ্বালানি হলো ডিজেল। বর্তমানে ডিজেল ব্যবহার করা হয় ৬৪ শতাংশ, ফার্নেস অয়েল ১৭ এবং কেরোসিন ব্যবহার করা হয় ৫ শতাংশ। প্রায় ৮৬ শতাংশ জ্বালানি পরিবহন (৪৪ দশমিক ৫ শতাংশ), বিদ্যুৎ (২৬ শতাংশ), কৃষি (১৭ দশমিক ৫ শতাংশ) এবং গৃহস্থালিতে (৮৮ শতাংশ) ব্যবহার করা হয়। ডিজেল ও কেরোসিনের মূল্য কমালে বা সমন্বয় করা হলে দরিদ্র, মধ্যবিত্ত কিংবা গ্রামাঞ্চলের মানুষই বেশি উপকৃত হবে।
এছাড়া বিদ্যুৎ খাতে বিশেষত ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার (আইপিপি), রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট (আরপিপি) এবং কুইক রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টে (কিউআরপিপি) ডিজেল ব্যবহার করা হয়। ডিজেলচালিত প্লান্টেও বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি। ডিজেলের দাম কমালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ভর্তুকি কমবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব মাহবুব আহমেদ বলেন, জ্বালানি তেলের দাম কমানোর ব্যাপারে কাজ চলছে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণ করেই সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
তবে বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার কারণ দেখিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু গত বৃহস্পতিবার বলেন, সরকার আপাতত জ্বালানি তেলের দাম কমাচ্ছে না। তবে ভবিষ্যতে কমাবে। ‘ইয়ং বাংলা’র ফেসবুক পেজে সরাসরি সম্প্রচারিত এক অনুষ্ঠানে তিনি একথা বলেন।
জ্বালানি তেলের দাম নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা চেয়েছিলাম দাম কমাতে। কিন্তু সরকার মনে করছে, বিশ্বে তেলের দাম যেহেতু বেড়ে গেছে, তাই এই মুহূর্তে কমাচ্ছি না। তবে ভবিষ্যতে আশা রাখি কমবে।’
২০১২ সালে যে তেলের দাম ছিল প্রতি ব্যারেল ১০৫ ডলার, দফায় দফায় কমে একপর্যায়ে ২০১৬ সালে তা ৩৩ ডলারে নেমে আসে। এ প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন মহলের দাবির মাধ্যমে ২০১৬ সালের ২৪ এপ্রিল ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪ শতাংশ এবং অকটেন ও পেট্রলের দাম ১০ শতাংশের মতো কমানো হয়। তার কয়েকদিন আগে ফার্নেস অয়েলের দাম প্রতি লিটার ৬০ থেকে ৪২ টাকায় নামিয়ে আনা হয়। তেলের দাম যে পরিমাণ কমেছে, তাতে যানবাহনের ভাড়ায় তেমন কোনো পরিবর্তন না আসায় আরও কমানোর দাবি ছিল ভোক্তাদের।