
পড়ালেখায় ‘ভাল’ ছিলাম বলে সব কাজে অবাধ স্বাধীনতা ছিলো আমার। নদীতে ঝাঁপ দিয়ে সারাদিন মেঘনার জলে ভাসা, হোগলাবনে মহিষ-বাথানে চাঁদ জোৎস্নায় রাত যাপন, গভীর জলে ডুব দিয়ে গলদা চিংড়ি হাতে নিয়ে মাথা-তোলা কিংবা দু’চারদিন নিরুদ্দেশ হয়ে পুরো জেলে ‘জলদাস’ হয়ে আবার ঘরে ফেরা, কোন কাজই বাদ দেইনি আমি কৈশোরিক এ আনন্দঘন জীবনে। আমার এ নিরুদ্দেশ সময়ে মা স্কুলে যেতেন আমার পড়ালেখার খোঁজ, বেতন ইত্যাদি দিতে। ‘এসএসসি’ ফরম ফিলাপের কদিন আগেই ১০-দিনের জন্যে সাগরে চলে যাই আমি জলদাসদের সাথে রাতের অন্ধকারে। কারণ সুমদ্র আমায় টানতো খুব এক নিটোল প্রেমিকার চৌম্বকীয় অদেখা আবেশে। ঘরে ফিরলে বন্ধুরা জানায়, ‘ফরম ফিলাপ’ সবার শেষ, কেবল আমারটা ছাড়া। স্কুলে গেলেও টিচারগণও একই কথা বলে আমায়। স্কুল শেষ না করেই নানাবাড়ি যাই মাকে খুঁজতে। আমার কান্না দেখে মা বলে, “সে করে রেখেছে আমার ফরম ফিলাপ সবার অজান্তে”।
সকল পরীক্ষাতে রেজাল্ট বের হওয়ার সব খবরই আগাম রাখতেন মা। আমি পরীক্ষা দিয়েই চরে, নদীতে, বিলে, সমুদ্রে চলে যেতাম অজানিত জীবনের সুখ-খোঁজে। বাড়ি ফিরলেই নদীর ঘাটে বন্ধুদের আগে মা বলতেন, কত নম্বর পেয়ে কত ক্রমিকে পাস করেছি আমি। এমনকি গণিতে সবচেয়ে কম নম্বর পেয়েছি, সেটাও বলতে ভুলতো না মা। তাই হয়তো জীবন গণিতে এখনো খুবই কাঁচা আমি সেই কৈশোরিক বেলার মতই। এবং এ জীবনের আর্থনীতিক গণিতে কখনো আর পারঙ্গম হবোনা আমি এটা নিশ্চিত। অনেকবার গণিত টিচারের সাথে কথা বলেছিল মা, আমায় অংক বিষারদ বানাতে। কিন্তু আমি তখন নিমগ্ন থাকতাম জলদাসদের মাঝে সোভিয়েত ইউনিয়ন, সোভিয়েত নারী আর উদয়নের বিশ্বাত্ববোধের প্রগাঢ় ভালবাসা নিয়ে।
আমার সব পরীক্ষার সব রেজাল্টের সময় উদগ্রীব থাকতো আমার মা ভীষণ। খুব কম রেজাল্টই আমি জানতাম স্কুলে গিয়ে। গণিতে কাঁচা থাকলেও, এ হিসেবটা আমি বুঝতাম যে, কেবল অংকশাস্ত্র ছাড়া সব সাবজেক্টে ন্যুনতম ৮০% নম্বর পাবোই আমি। গণিতে ৪০-৫০ এর মধ্যে থাকবে। ইন্টারে গণিত থাকবে না বলে, ৮ম শ্রেণি থেকেই আমি স্বপ্নে ইন্টারে পড়তাম। আমার সব পরীক্ষার রেজাল্টেই মা খুশী হতো খুব, মানে আমার চেয়ে অনেক বেশি। এসএসসি পরীক্ষায় ১ম বিভাগ পেলে আমার গাঁয়ের অন্তত পাঁচ হাজার জেলে-কৃষাণকে নদীর ঘাটে গিয়ে নিজ হাতে ‘রসগোল্লা’ খাইয়েছিল আমার মা। রাতে ‘হ্যাজাক-লাইট’ জ্বালিয়ে লাঠি খেলার আয়োজন করেছিল মা, যাতে আমার বন্ধু আর আমিও ঢোলজাতীয় ‘খঞ্জুরা’ বাজিয়েছিলাম এক অপার সমুদ্রঘন বোহেমিয়ান আনন্দে।
ইন্টার পাস করার পর যখন জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটিতে ভর্তি হই আমি, মা তখন বেশি খুশী হননি, ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হইনি এ বেদনায়। ন’মাস ক্লাস করেই মাকে না জানিয়ে বিদেশে চলে যাই আমি আকস্মিক একদিন একটা দ্বীপদেশে। তাতে মা খুবই কষ্ট পান আমার পড়ালেখাতে ছেদ পড়লো বলে। দুবছরের মাথায় আবার ঝড়ের মত ফিরে এসে, এবার যখন ঢাবির ‘বাঙলা বিভাগে’ ভর্তি হই আমি, মার মুখ তখন উজ্জ্বলতর হয় দুপুরের চকমকে অমেঘ সূর্যের মত। আমার প্রায় ৩-বছরের ব্রেকের পরও ভার্সিটির সব পরীক্ষাতে ঈর্ষণীয় ফলাফলে মা আকাশ দিগন্তে উড়তো সব সময়। এমনকি আমার টিচার ড. হুমায়ুন আজাদের কাছে যখন একদিন নিয়ে এলাম মাকে, তখন গভীর চিত্ততায় মাকে সালাম করলেন স্যার, আমাকে পেটে ধরেছেন মা এ কারণে। স্যারের লেকচার থিয়েটারের কক্ষে কেবল আমি, মা আর স্যার অনেকক্ষণ গল্প করেছিলাম আমরা পুরো দুপুর ভেঙে। এক লোক পাঠিয়ে মায়ের জন্য ‘পান’ আনিয়েছিলেন স্যার, মা চা খাবেন না এ কথা শুনে। মাকে আবৃত্তি করে শুনিয়েছিলেন স্যার তার নিজ কবিতা ‘মা’। তাতে মা আর আমি এক সাথেই কেঁদেছিলাম স্যারের সাথে। স্যারের গলা ধরে গিয়েছিল কবিতাটির শেষ কয় চরণে। স্যারকে ঐ একদিনই কাঁদতে দেখেছি আমি ক্ষণিকের জন্যে। হয়তো তাঁর মায়ের জন্যে!
পরীক্ষার ফলাফলে কখনো উদগ্রীব থাকতাম না উদাসীন যাযাবর আমি। এমনকি এইচএসসি পরীক্ষার আগের দিনও বড়বোনের সাথে “অবুঝমন” ছবি দেখেছিলাম চট্টগ্রামের ‘আলমাস’ সিনেমায়। কারণ আমার মনে হতো, সারাবছর সবসময় যেহেতু কমবেশি পড়তেই থাকি, তাই পরীক্ষার আগের দিন ‘রিলাক্স’ থাকা দরকার খুব। একদিন ঢাবির কলাভবনে একটা নোটিস টানানো দেখলাম। অনার্সে ভাল মার্কস পাওয়াতে মাসে ১৮০-টাকা করে স্টাইপেন্ড পাবো আমি পুরো স্নাতকোত্তর শেষ পর্বে। ঐ নোটিসটা নিয়ে যাই খুলে আমি মাকে দেখাতে। ওটা পেয়ে মা কি যে খুশী হয়েছিলো, তা বোধের ভাষা রপ্ত করতে পারিনি আমি আজো ভাষাবিজ্ঞান পড়েও। মায়ের নির্দেশে ওটা বাঁধাই করেছিলাম আমি নীলক্ষেত থেকে। মা মৃত্যুর আগের দিনও, আমাকে খুঁজে-খুঁজে না পেয়ে বাঁধানো ঐ ‘স্টাইপেন্ডের নোটিস’টা বুকে চেপে রেখেছিল মৃত্যুর পূর্বক্ষণ পর্যন্ত! ওটাকে আমি ‘লেমিনেটেড’ করানোর পরও মায়ের শারীরি গন্ধ পাই ঐ কাগজটা থেকে এখনো!
আজ মা-হীন এ জীবনে আমার কেবলই মনে হচ্ছে, এসএসসি থেকে শুরু করে আমার জীবনের সকল পরীক্ষার সকল “স্টারমার্কগুলো” আমি কখনো পা্ইনি, সব পেয়েছিল আমার ‘মা’। কিন্তু এ মায়ের উঠুনে, তার জনান্তিক ছেলের অজান্তে, একদিন অকাল-সন্ধ্যায় কড়ানাড়লো যমদুতের ট্রাজিক পরিসমাপ্তি। যে কারণে হয়তো এখনো মায়ের কবরে, তার ছেলের গোপন প্রেমজ রাত্রির নরম নীল জ্যোৎস্নায়, ভেজা ফুলেরা রাতে স্নিগ্ধতার ঘ্রাণ ছড়ায় অন্ধকারে একাকি। গাঁয়ের বৃক্ষঘেরা কবরের চারপাশের জমাট আঁধারে ধুসরিত দু:খজীবনের গান গায় নিশাচর রঙহীন পাখিরা। মায়ের ঐ তথাকথিত স্টারপাওয়া ছেলের জীবনে অহর্নিশ ঘুরপাক খায় দু:খাতুর চাঁদ, যা ভেসে বেড়ায় মায়ের প্রতিচ্ছায়ায়, অনন্ত আকাশে ধূমায়িত মেঘরাজ্যে!