
ট্যারিফ কমিশনের এক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, দেশে তরল দুধের চাহিদা রয়েছে এক কোটি ৪০ লাখ মেট্রিক টন। দেশীয়ভাবে উৎপাদন রয়েছে ৬০ লাখ ৯০ হাজার মেট্রিক টন। অর্থাৎ ঘাটতি রয়েছে ৭৯ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন দুধের। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের দৈনিক গড় দুধের চাহিদা রয়েছে ২৫০ মিলিলিটার। এর বিপরীতে পর্যাপ্ততা রয়েছে ১০৯ মিলিলিটার। অর্থাৎ ঘাটতির পরিমাণ রয়েছে ১৪১ মিলিলিটার।
তথ্য মতে, পাস্তুরিত তরল দুধের বাজারের অর্ধেকই বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের )। দেশীয় বাজারে যেসব পাস্তুরিত তরল দুধ বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে তাদের মধ্যে ৫৫ শতাংশ মিল্ক ভিটার দখলে। ২০০৯ সালে এটি ছিল ৫২ শতাংশ। পাস্তুরিত তরল দুধে মিল্ক ভিটার বাজার আরো বেশি বৃদ্ধি পাওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি। গত সাত বছরে মাত্র ৩ শতাংশ বেড়েছে তরল দুধের বাজার।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ট্যারিফ কমিশন প্রকাশিত ‘স্টাডি অন লিকুইড অ্যান্ড পাউডার মিল্ক প্রসপেক্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে (২০০৯ সালের তথ্যের ভিত্তিতে), দেশীয় বাজারে মিল্ক ভিটার মার্কেট শেয়ার ৫২.০৮ শতাংশ। কম্পানিটি প্রতিদিন সমবায় সমিতির খামারিদের কাছ থেকে দুই লাখ লিটার দুধ সংগ্রহ করে। এগুলো পরে পাস্তুরিত করে বাজারজাত করা হয়ে থাকে। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আড়ং। বেসরকারি খাতের এই কম্পানির মার্কেট শেয়ার রয়েছে ২০.৮৩ শতাংশ। প্রতিদিন কম্পানিটি ৮০ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করে থাকে। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে খাদ্যপণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রাণ। তরল দুধের মার্কেটের ১০.৪২ শতাংশ রয়েছে প্রাণের দখলে। কম্পানিটি প্রতিদিন ৪০ হাজার লিটার দুধ সংগ্রহ করে থাকে। তবে প্রাণ কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, বর্তমানে প্রতিদিন তারা দেড় লাখ টন দুধ সংগ্রহ করে থাকে। এ ছাড়া অ্যামো মিল্ক, বিক্রমপুর ডেইরি, আল্ট্রা শিলাইড ডেইরি মার্কেট শেয়ার রয়েছে ২.৬০ শতাংশ করে। ২.০৮ শতাংশ করে বাজার ধরে রেখেছে আফতাব ডেইরি ও রংপুর ডেইরি। এদের দুধ সংগ্রহের পরিমাণ সামান্যই।
মিল্ক ভিটার চেয়ারম্যান শেখ নাদির হোসাইন লিপু বলেন, ‘সরকারি প্রতিষ্ঠানে তো চাইলেই দ্রুত অনেকটা সম্প্রসারণ করা যায় না। কিছু নিয়মের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আমাদের মেশিনারিজগুলো অনেক দিনের পুরনো। এর ব্যবস্থাপনা ব্যয়ও বেশি। আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারী অনেক বেশি। সব মিলিয়েই খরচটা হিসাব করা হয়। আমরা অনেক দিন ধরেই দুটি মিল্ক পাউডার তৈরির জন্য ফ্যাক্টরির অনুমোদন পেয়েছি। কিন্তু টাকার অভাবে কাজ করতে পারছি না। ’
ট্যারিফ কমিশনের গবেষণায় বলা হয়েছে, দুধের উৎপাদন খাতে নজরদারি বা উন্নয়নের জন্য কোনো ধরনের উন্নয়ন বোর্ড নেই। দুগ্ধ তৈরির পদ্ধতি পরীক্ষা, মান খতিয়ে দেখা, তাদের কার্যক্রম তদারকি, সেক্টরের উন্নয়ন, নীতি তৈরির মতো কাজগুলো ডেইরি উন্নয়ন বোর্ডের মাধ্যমে হওয়া উচিত বলে মত দেওয়া হয়েছে।
অবশ্য সম্প্রতি জাতীয় দুগ্ধ উৎপাদন নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে। এতে ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড গঠনের কথা বলা হয়েছে।
দেশীয় দুধের বাজারে বেশ কিছু সমস্যার কথা তুলে ধরা হয়েছে এ গবেষণায়। গুঁড়োদুধের বাজার নিয়ে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে দুধের দাম কমলে দেশীয় বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়ে না। কোনো ভোক্তা সেটা টেরও পায় না। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি পেলে সেটা খুব দ্রুত খুচরো মার্কেট পর্যন্ত পৌঁছে যায় এবং দুই-এক দিনের মধ্যেই এসব পণ্যের দাম বেড়ে যায়।
এ ছাড়া দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্যে ভেজাল একটি মারাত্মক হুমকি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
সার্বিক খাতের অবস্থা নিয়ে জানতে চাইলে প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের পরিচালক (বিপণন) কামরুজ্জামান কামাল বলেন, ‘বাজারে আমাদের সরবরাহ দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে আমরা প্রতিদিন দেড় লাখ টন দুধ সংগ্রহ করি। আমাদের এ সেক্টরের বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে, বিশ্বের মধ্যে আমাদের দেশে যে জাতের গরু রয়েছে এগুলোর উৎপাদনশীলতা সবচেয়ে কম। অন্যদিকে ভালো জাতের গরু দেশে আমদানির অনুমোদন নেই। এ কারণে আমাদের শুরু থেকেই উৎপাদন ও চাহিদার মধ্যে বড় একটি ঘাটতি রয়েছে। যার কিছুটা গুঁড়োদুধ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করা হয়। ’
বাংলাদেশে দুধের একটি বড় বাজার রয়েছে উল্লেখ করে কামরুজ্জামান কামাল আরো বলেন, “আমরা এ বাজারটা ধরতে কিছু ভিন্নধর্মী কাজ করছি। উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা নিয়ে পাঁচটি ‘হাব’ (২০-২৫টি গ্রাম নিয়ে একটি হাব) তৈরি করেছি। এখানে কৃষকদের গরু লালন-পালনে বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা হয়। আবার তাদের কাছ থেকেই আমরা দুধ সংগ্রহ করি। এ ছাড়া সরকার যদি খামারিদের গরু পালনে কিছু সহযোগিতা করে, আমার মনে হয় এ সেক্টরটা আরো বড় এবং সমৃদ্ধ হবে। ’