খােলা বাজার২৪।। শনিবার, ২৭ মে, ২০১৭: দিনাজপুর হাকিমপুরের হিলি স্টেশনের ওপারে সীমান্ত ঘেঁষা বেশ কয়েকটি বাসা রয়েছে। টিনশেডের তৈরি বাসাগুলোর একটির মালিক ফড়িং। এই ফড়িংয়ের বাসায় রয়েছে ফেনসিডিলের কারখানা। তার বাসায় তৈরি করা ফেনসিডিল আসছে বাংলাদেশে। সীমান্ত এলাকা ঘুরে বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেছে, শুধু ফড়িংয়ের বাসাতেই নয়, সীমান্তের আশপাশের লোকালয়ের বাসাবাড়িতে ফেনসিডিলের এমন অন্তত অর্ধশত কারখানা গড়ে উঠেছে। রাতের আঁধারে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে এসব নকল ও ভেজাল ফেনসিডিল বাংলাদেশে ঢুকছে। ওপার-এপারের মাদক ব্যবসায়ীরা সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়ার ফোকর দিয়ে, আবার কখনো বেড়ার উপর দিয়ে ছুড়েও ফেনসিডিল পাচার করে আনছে। উত্তরের চোরাচালানের এই পথে প্রতিদিন অর্ধলক্ষ বোতল ফেনসিডিল বাংলাদেশে ঢুকছে বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা। তারা বলছেন, সীমান্তঘেঁষা বাসাবাড়িতে এসব কারখানা গড়ে উঠেছে বাংলাদেশকে টার্গেট করেই।
প্রসঙ্গত, ফেনসিডিল বাংলাদেশে মাদকসেবীদের কাছে জনপ্রিয় মাদক। এর আগে বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে সীমান্ত এলাকার ফেনসিডিল কারখানাগুলো গুঁড়িয়ে দেয় ভারত সরকার। এরপর থেকে মাদক মাফিয়ারা নিজ বাড়িতেই গড়ে তোলে ফেনসিডিল কারখানা। মাদক ব্যবসায়ীরা বলছেন, ওপারের ফেনসিডিল ব্যবসায়ীরা দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করে যাচ্ছে।
বিএসএফের সামনে দিয়ে তারা ফেনসিডিল সীমান্তে নিয়ে এলেও তাদের খুব একটা মাথাব্যথা নেই। ফেনসিডিলে ভারতে কোনো ধরনের সমস্যা নেই। যে ফেনসিডিল তৈরি হয় তা শুধু বাংলাদেশের জন্যই। এসব কারণে বিএসএফের সামনে দিয়ে কখনো কখনো মাদক ব্যবসায়ীরা ফেনসিডিল পাচার করে নিয়ে আসে।
তবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ফেনসিডিল পাচাররোধে স্টেশন এলাকা সিসিটিভির আওতায় নিয়েছে। কিন্তু এতেও কাজ হচ্ছে না। পুলিশও মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে। কিন্তু ফেনসিডিল আসা রোধ করা যায়নি। বাংলাদেশের দিনাজপুরের হিলি ও জয়পুরহাটের সঙ্গে ভারতের প্রায় ৭২ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। অনুসন্ধান ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের তথ্য থেকে জানা গেছে, এই দীর্ঘ সীমান্তের ওপারে এসব ফেনসিডিল তৈরির কারখানা রয়েছে। বিজিবির তৎপরতার কারণে দিনের বেলায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ফেনসিডিল প্রবেশ করতে পারছে না।
তবে রাতের আঁধারে বস্তায় বস্তায় ঢুকছে ফেনসিডিল। বাংলাদেশের মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, ফেনসিডিলের এমন চাহিদা যে, ভেজাল ফেনসিডিলই হু হু করে বিক্রি হয়ে যায়। ভারতীয় মাদক ব্যবসায়ীরা এই সুযোগে এখন ভেজাল ফেনসিডিল বিক্রি করছে। এতে তাদের খরচ কম হলেও দাম ঠিকই চড়া রাখছে। জয়পুরহাট থেকে হিলি পর্যন্ত সীমান্তের ২০ পয়েন্ট দিয়ে রাতের আঁধারে ফেনসিডিল আসছে।
সীমান্ত সূত্রে জানা গেছে, শুধু বাংলাদেশকে টার্গেট করে কারখানাগুলো বানানো হয়েছে। ১০০ মিলিমিটারের বোতলের পাশাপাশি এখন ৫০ মিলিমিটার বোতলেও ফেনসিডিল পাওয়া যাচ্ছে। এর আগে শুধু ১০০ মিলিমিটার পাওয়া যেত। বোতলের গায়ে হিমাচল, বেঙ্গালুরু, কলকাতা ও লক্ষ্নৌ লেখা থাকলেও মূলত এগুলো স্থানীয়ভাবেই তৈরি। ১০০ মিলিলিটারের এক বোতল ফেনসিডিলের দাম ৬৫ থেকে ৭২ রুপি এবং ৫০ মিলিলিটারের দাম ৩৫ থেকে ৩৭ রুপি। পাচার হয়ে আসার পর ১০০ মিলিলিটার ফেনসিডিল এলাকাভেদে ৫০০ থেকে হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ঢাকায় কখনো কখনো এক বোতলের দাম ওঠে ১৫শ থেকে ১৮শ টাকা।
বাংলাদেশ সীমান্তে এসব ফেনসিডিল পাচার হয়ে আসার পর সড়কপথে, প্রাইভেট গাড়িতে, ট্রেনে, পণ্যবোঝাই ট্রাকে এবং যানবাহনের পাটাতনে বিশেষ ব্যবস্থায়, বোরকা পরা নারীদের শরীরে বেঁধে, কোমল পানীয়র বোতলে ভরে এবং আরও অনেক কৌশলে পাচার হয় ফেনসিডিল। শিশুদেরও ফেনসিডিল পাচার বা বহনকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। চোরাকারবারিরা ফেনসিডিল পাচারে বিরামপুর, ঘোড়াঘাট, গোবিন্দগঞ্জ, জয়পুরহাট ও বগুড়া রুট ব্যবহার করে টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও ঢাকায় পাঠাচ্ছে বলে জানা গেছে।
আরও জানা গেছে, দিনাজপুর জেলা পুলিশের তালিকায় মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে এক হাজার ৬৩২ জনের নাম রয়েছে। এর মধ্যে ৪০০ মাদক ব্যবসায়ী পুলিশের আহ্বানে আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু রাঘববোয়ালরা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।
এক অনুসন্ধানে জানা গেছে, হিলি এলাকা থেকে ফেনসিডিল ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে মাঠপাড়ার লোকমান হোসেন বেলাল ওরফে হুন্ডি বেলাল, চুড়িপট্টির হযরত আলী সরদার, শামীম সরদার, স্টেশনপট্টির কামাল হোসেন, হিলি বাজারের ফেরদৌস রহমান, পারভেজ, ফকিরপাডার সাজ্জাদ, নুর আলম, ফারুক, শাহাবুদ্দিন, সেলিম কমিশনার, নিলামকারী জাহিদ, অপু ওরফে পাবনাইয়া অপু, নোয়াখাইল্যা হারুন, কালীগঞ্জের মোফা, লেবার সুলতান, মধ্য বাসুদেবপুরের কাহের ম-ল, রায়হান হাকিম, চ-ীপুরের মিন্টু কমিশনার এবং সাতকুড়ির দেলোয়ার। হাকিমপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুস সবুর জানান, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে সর্বত্র। জেলার এসপির আহ্বানে এরই মধ্যে মাদক ব্যবসায়ীরা আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছে।