Tue. Apr 22nd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলা বাজার২৪।। রবিবার, ৯জুলাই, ২০১৭:  21সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যাংকগুলো একের পর এক ধ্বংসের মুখে পড়ছে। চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ এবং ঋণ প্রদানে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণেই সংকটে পড়ছে সরকারি খাতের ব্যাংকগুলো। সরকারি খাতের সোনালী ও বেসিক ব্যাংকের পর এবার নতুন করে আলোচনায় এসেছে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড (বিডিবিএল)। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে ব্যাংকটির প্রায় ৬০ শতাংশ ঋণই ইতিমধ্যে খেলাপি হয়ে গেছে।

দেশে প্রথমবারের মতো বিপর্যস্ত দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক ও বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থাকে একীভূত করে গঠন করা হয়েছিল বিডিবিএল। একীভূত দুটি প্রতিষ্ঠান ব্যাংক হিসেবে যাত্রা শুরু করে ২০১০ সালের ৩ জানুয়ারি। একীভূত হয়ে নাম পরিবর্তন ছাড়া আর তেমন কিছুই বদল হয়নি ব্যাংকটির। সরকারের অন্যান্য ব্যাংক যেভাবে চলেছে, এটিও পরিচালিত হয়েছে সেভাবেই। ফলে ব্যাংকটি ব্যবসাসফল হয়নি, নতুন করে দেওয়া ঋণও হয়ে পড়েছে খেলাপি। যাত্রার সাত বছর পর একীভূত করা ব্যাংকটি টিকিয়ে রাখাই এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। ব্যাংকিং ব্যবসার পরিবর্তে ভবন ভাড়া ও শেয়ার ব্যবসা করে কোনোমতে টিকে আছে। একীভূত করার পর শীর্ষ কর্মকর্তাদের নানা অনিয়মই ব্যাংকটিকে তলানিতে নিয়ে গেছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

গত মার্চ পর্যন্ত ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপিই ৮৫৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকটির ৫৮ শতাংশ ঋণই খেলাপি হয়ে গেছে। ব্যাংকটির ৩৯ শাখার মধ্যে ডিসেম্বর পর্যন্ত লোকসান গুনেছে ১৯ শাখা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, জবাবদিহি না থাকলে এভাবে একীভূত করেও ব্যাংক ঠিক রাখা যাবে না, তারই বড় উদাহরণ বিডিবিএল। ব্যাংকটির ভিত ধসে পড়ার উপক্রম হয়েছে। জবাবদিহি ছাড়া কখনোই সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। অন্য সরকারি ব্যাংকগুলোর অবস্থা একই।

অনিয়ম ও দুর্নীতি ঠেকাতে বিডিবিএলসহ সরকারি ব্যাংকগুলোতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি।

তবে বিডিবিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মনজুর আহমেদ নিজ কার্যালয়ে বলেন, বিডিবিএল বড় ধরনের হোঁচট খেয়েছে, তবে শেষ হয়ে যায়নি। এ থেকে ব্যাংকটি বড় ধরনের শিক্ষা নিয়েছে। ব্যাংকটি প্রচলিত ব্যাংকিং সংস্কৃতি বুঝতে পারেনি, পুরোনো কর্মকর্তাদের দিয়ে জোর করে বৈদেশিক ব্যবসা করানোর চেষ্টা হয়েছে। ফলে বড় বিপর্যয় ঘটে গেছে।

বিডিবিএলের এমডি হিসেবে গত বছরের মে মাসে যোগ দেওয়া মনজুর আহমেদ বলেন, ‘এখন আমরা ছোট ছোট ঋণ দিয়ে ব্যাংকটিকে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। খেলাপি হওয়া ঋণগুলো আদায়ে গ্রাহকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি, আইনি মোকাবিলাও চলছে।’

বিডিবিএলের ২০১৬ সালের নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ব্যাংকটি মূলত এখন ভবন ভাড়া ও শেয়ার ব্যবসার ওপর টিকে আছে। অর্ধেকের বেশি ঋণ খেলাপি হওয়ায় মুনাফা প্রতিনিয়ত কমছে। ২০১৬ সালে ব্যাংকটির ঋণের বিপরীতে সুদ আয় হয় ২০০ কোটি টাকা, তবে আমানতকারীদের সুদ দেয় ১৩০ কোটি টাকা। এর বাইরে শেয়ার বিনিয়োগ থেকে আয় হয় ৯০ কোটি টাকা এবং ভবন ভাড়াসহ অন্য আয় হয় ৬৬ কোটি টাকা। বেতন-ভাতা বাবদ ব্যাংকটির ব্যয় ৯৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে গত বছরে মুনাফা হয় ৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণের জন্য ১৫ কোটি টাকা সঞ্চিতি ও ১২ কোটি টাকা কর শোধ করতে হয়। ফলে নিট মুনাফা হয় ৩৮ কোটি টাকা। ২০১৫ সালেও মুনাফা ছিল ৫১ কোটি টাকা।

বিডিবিএলের মার্চেন্ট ব্যাংক, ব্রোকারেজ প্রতিষ্ঠান ও মিউচুয়াল ফান্ড রয়েছে। আর ব্যাংকটির ভাড়া থেকে আয় আসে মূলত রাজউক অ্যাভিনিউতে প্রধান কার্যালয় এবং কারওয়ান বাজার, চট্টগ্রাম ও খুলনায় বহুতলবিশিষ্ট চারটি নিজস্ব ভবন থেকে। এ ছাড়া বিডিবিএলের ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, ঝিনাইদহ ও রাজশাহীতে মোট ২৭ বিঘা জমি রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিডিবিএল সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, শীর্ষ ২০ খেলাপির কাছে পাওনা ৩৫৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২৪৭ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হয় বিডিবিএল গঠনের পর। বিডিবিএলের ৭ বছরের ৫ বছরই এমডি ছিলেন জিল্লুর রহমান। তিনি ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ব্যাংকটির এমডি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। খেলাপি হওয়া এসব ঋণের বেশির ভাগই বিতরণ হয় তাঁর হাতে। খেলাপি হওয়া বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও তাঁর এলাকার। বর্তমানে তিনি ইসলামী ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান।

জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমার সময়ে দেওয়া সব ঋণই খেলাপি হয়ে গেছে, বিষয়টি তেমন নয়। কিছু ঋণ খেলাপি হয়েছে। এসব গ্রাহক থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা চালাচ্ছে ব্যাংক। ওই সময়ে পুরো ব্যাংক খাতেই কিছু ঝামেলা হয়েছে। আমি তো একা ঋণ দিতে পারি না, বিভিন্ন ধাপ অনুসরণ করেই বিতরণ হয়েছে।’

জানা গেছে, ২০১২ সালে দেওয়া ঋণই এখন ব্যাংকটির শীর্ষ ঋণ খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। যেমন চট্টগ্রামভিত্তিক মোস্তফা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান এম এম ভেজিটেবল অয়েলের কাছে ব্যাংকের পাওনা ৭৬ কোটি টাকা। মোস্তফা গ্রুপের চেয়ারম্যান হেফাজাতুর রহমান।

গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান শফিক উদ্দিন বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে দীর্ঘদিন ধরে ঋণ পরিশোধ করা হয়নি। আমরা ঋণ পুনঃ তফসিল করার প্রক্রিয়া শুরু করেছি।’

ব্যাংকটির দ্বিতীয় শীর্ষ ঋণ খেলাপি ঢাকা ট্রেডিং হাউস। ২০১২ সালে বিতরণ করা এ ঋণের বর্তমান স্থিতি ৪২ কোটি টাকা। এর মালিক ঢাকা-বগুড়া রুটে চলাচলকারী টিআর পরিবহনের কর্ণধার টিপু সুলতান। সাবেক এমডি জিল্লুর রহমানের এলাকার হওয়ার সুবাদে অবাধে ঋণ সুবিধা পেয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর পল্টনের আল-রাজী কমপ্লেক্সে প্রতিষ্ঠানটির দাপ্তরিক কার্যালয়। এ কার্যালয়ে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। টিপু সুলতানের মালিকানাধীন আরেক প্রতিষ্ঠান টিআর স্পেশালাইজড কোল্ডস্টোরেজ ব্যাংকের পঞ্চম শীর্ষ খেলাপি। প্রতিষ্ঠানটির কাছে ব্যাংকের পাওনা ১৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।

রংপুরের মিঠাপুকুরের নাজমুল হাসান সিদ্দিকীও ঋণ সুবিধা পেয়েছেন। তাঁর দুটি প্রতিষ্ঠানের কাছে ব্যাংকটির পাওনা ৪৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে নর্থ বেঙ্গল এগ্রোর কাছে ২৬ কোটি টাকা ও নর্থ বেঙ্গল হ্যাচারির কাছে ১৯ কোটি টাকা।

ধানমন্ডির অক্সফোর্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সাখাওয়াত হোসেনের মালিকানাধীন টাটকা এগ্রোর কাছে ব্যাংকের পাওনা ২৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি একসময় টাটকা ব্র্যান্ডের বিভিন্ন খাদ্যপণ্য উৎপাদন করত। ধানমন্ডির অক্সফোর্ড স্কুলের নিচতলাতেই টাটকার কার্যালয়। সেখানে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। ব্যাংকিং সূত্র বলছে, সাখাওয়াত হোসেন তাঁর সব ব্যবসা বিক্রির চেষ্টা করছেন।

বিএনপিদলীয় সাবেক সাংসদ হারুনুর রশিদ খানের মালিকানাধীন মুন্নু ফেব্রিকসের কাছে ব্যাংক পায় প্রায় ১১ কোটি টাকা। বিডিবিএল গঠনের আগেই এ ঋণ নিয়েছিল প্রতিষ্ঠানটি। যোগাযোগ করা হলে মুন্নু গ্রুপের মহাব্যবস্থাপক ফিয়াজ মাহফুজ উল্লাহ বলেন, ‘আমরা ব্যাংক ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করছি। ঋণটি শিগগিরই নিয়মিত হয়ে যাবে।’

বগুড়া মাল্টিপারপাসের কাছে পাওনা ১০ কোটি টাকা। ব্যাংকটির আগের এমডি জিল্লুর রহমানের ইচ্ছাতেই নিজ এলাকার এ ব্যবসায়ীকে ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়। তবে ঋণ শোধ করেননি এ ব্যবসায়ী।

এ ছাড়া রংপুরের রণাঙ্গন কোল্ডস্টোরেজের কাছে ব্যাংক পায় ১৩ কোটি টাকা, বগুড়ার হাসান জুট অ্যান্ড স্পিনিংয়ের ১২ কোটি, মিতা ব্রিকস ফিল্ডের কাছে সাড়ে ৭ কোটি টাকা, ঝিনাই টেক্সের কাছে ১২ কোটি এবং বিএস প্লাস্টিকের ৭ কোটি টাকা।

বিডিবিএলের চেয়ারম্যান ইয়াছিন আলী বলেন, ‘আমি চেয়ারম্যান হওয়ার পর কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি। যা হয়েছে সব আগের। আমরা চেষ্টা করছি খেলাপি ঋণগুলো আদায়ের।’

সরকারি ব্যাংকগুলোর এই দুর্দশা নিয়ে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, এখনই এসব অনিয়ম-দুর্নীতির পেছনে যারা জড়িত, তাদের চিহ্নিত করার সময়। এ ছাড়া সোনালী ও বেসিক ব্যাংকের অনিয়মে জড়িতদেরও বিচারের আওতায় আনতে হবে। প্রথম আলো