খােলা বাজার২৪।। সোমবার, ৩১ জুলাই, ২০১৭: রামপাল প্রকল্প এগিয়ে নিতে ইউনেসকোর কাছ থেকে ছাড় পাওয়া গেছে বলে সরকার যে দাবি করেছিল, প্রকাশিত সিদ্ধান্তে তার উল্লেখ নেই। পোল্যান্ডে অনুষ্ঠিত সুন্দরবন ও রামপাল বিষয়ে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের ৪১তম সভার সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন রবিবার প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রভাব নিয়ে সুন্দরবন এবং দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে একটি কৌশলগত পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (এসইএ) করতে অনুরোধ করেছে জাতিসংঘের বিজ্ঞান, শিক্ষা ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থার (ইউনেসকো) বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র।
এই সমীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই অঞ্চলে কোনো বৃহদাকার শিল্প অবকাঠামো নির্মাণ না করতে অনুরোধ জানিয়েছে সংস্থাটি। ফলে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক সংস্থাটি যেসব আপত্তি তুলেছিল, সেগুলো বহাল রইল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে রামপাল প্রকল্প এগিয়ে নিতে ছাড় পাওয়া গেছে মর্মে সরকার যে বক্তব্য দিয়েছিল, সেটি সঠিক নয়।
১২ জুলাই বৈঠক শেষ হলেও ওই বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ পাওয়া গেল ১৮ দিন পর। তবে বৈঠক চলাকালেই এটির সিদ্ধান্ত জানিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৭ জুলাই একটি বিজ্ঞপ্তি দেয়, যাতে দাবি করা হয়, ২ জুলাইয়ের অধিবেশনে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যাপারে ইউনেসকো তাদের আপত্তি তুলে নিয়েছে এবং সুন্দরবনের নাম বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তির যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন উঠলে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী পোল্যান্ডের ক্র্যাকো শহরের ওই বৈঠক থেকে দেশে ফিরে ১০ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন, আপাতত সুন্দরবনের পাশে বড় ধরনের শিল্প অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি সরকার দেবে না, তবে রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ বন্ধ হচ্ছে না। তিনি বলেন, ইউনেসকোর সুপারিশ ভবিষ্যতের অবকাঠামোর জন্য বলা হয়েছে। রামপালের কাজ যেহেতু আগে থেকেই শুরু হয়েছে, ফলে রামপালের জন্য তা প্রযোজ্য নয়।
বৈঠকের ৭ নম্বর সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে ইউনেসকোর রিঅ্যাক্টিভ মনিটরিং মিশন যেসব সুপারিশ করেছিল, সেগুলো পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে হবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে ইউনেসকো ২০১৬ সালের মার্চে একটি রিঅ্যাক্টিভ মনিটরিং মিশন পাঠায়। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত দলটি সুন্দরবন এলাকায় সমীক্ষা চালিয়ে যে প্রতিবেদন দেয়, তাতে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প বাতিল করার সুপারিশ করা হয়েছিল।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব আনু মুহাম্মদ এ প্রতিবেদককে বলেন, সরকার ইউনেসকোর সভায় গিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত মানার অঙ্গীকার করে এসেছে।
এখন ইউনেসকোর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে বলা হচ্ছে, রামপাল কেন, সুন্দরবনের পাশে কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানই করা যাবে না। সরকার যদি জাতিসংঘের এই সংস্থার সিদ্ধান্ত মানে, তাহলে অবশ্যই রামপালের কাজ বন্ধ করতে হবে। আর সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে রামপাল প্রকল্পে ইউনেসকোর আপত্তি তুলে নেওয়া হয়েছে বলে যেসব বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে, তা যে মিথ্যা, তা আবারো প্রমাণিত হলো। আর সুন্দরবন রক্ষা করতে হলে রামপাল প্রকল্প বাতিল করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
তবে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৪১তম সভায় পর্যবেক্ষক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ওয়াটার কিপার্স অ্যালায়েন্সের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শরিফ জামিল। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ইউনেসকো রামপাল প্রকল্প নিয়ে তাদের অবস্থান রিঅ্যাক্টিভ মনিটরিং প্রতিবেদনে পরিষ্কার করেছে। সেখানে তারা রামপালসহ সুন্দরবনের চারপাশে সব ধরনের শিল্পকারখানা ও অবকাঠামো না করার সুপারিশ করেছিল। রবিবার প্রকাশিত চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে রিঅ্যাক্টিভ মনিটরিং রিপোর্টের সুপারিশের বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র করা যাবে না।
শরিফ জামিল আরো বলেন, বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির সভা শেষে ঢাকায় ফিরে প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী তার বক্তব্যে ইউনেসকো রামপাল প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে বলে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা যে অসত্য, তা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেখে প্রমাণিত হলো।
প্রতিবেদনে দুই পৃষ্ঠার বাংলাদেশ অংশে যে ১১ দফা সিদ্ধান্ত তুলে ধরা হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রভাব নিয়ে সুন্দরবন ও দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় একটি কৌশলগত পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (এসইএ) চালানোর যে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে, সেটি যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করে বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রে পাঠাতে হবে। এরপর বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র সেটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারকে (আইইউসিএন) দিয়ে সেটি পর্যালোচনা করে নেবে।
১১ নম্বর সিদ্ধান্তে আরো বলা হয়েছে, যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির কাছে জমা দিতে হবে। কমিটির ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় ৪৩তম অধিবেশনে ওই প্রতিবেদন নিরীক্ষা করা হবে।
ইউনেসকোর ১১ দফা সিদ্ধান্ত
১. ডব্লিউএইচসি/১৭/৪১.সিওএম/৭বি নথিপত্র যাচাই।
২. ৩৯ সিওএম ৭ বি.৮ সিদ্ধান্ত প্রত্যাবর্তন, যেটি ২০১৫ সালে জার্মানির বনে বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রের ৩৯তম অধিবেশনে গৃহীত হয়।
৩. ওরিয়ন পাওয়ার প্ল্যান্ট ও রামপাল পাওয়ার প্ল্যান্টের দ্বিতীয় পর্যায় অনুমোদন না করার বাংলাদেশের সিদ্ধান্তকে স্বাগত।
৪. রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রভাব নিয়ে সুন্দরবন ও দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় একটি কৌশলগত পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (এসইএ) চালানোর যে সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ সরকার নিয়েছে, তাকে স্বাগত। এই সমীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই অঞ্চলে কোনো বৃহদাকার শিল্প বা অবকাঠামো নির্মাণ না করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হলো। এসইএ যত দ্রুত সম্ভব সম্পন্ন করে একটি প্রতিবেদন বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্রে পাঠাতে হবে। বিশ্ব ঐতিহ্য কেন্দ্র এটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারকে (আইইউসিএন) দিয়ে পর্যালোচনা করে নেবে।
৫. পরিবেশগত পর্যবেক্ষণের তথ্য দেওয়ার জন্য স্বাগত। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণের প্রবেশ, স্বাদু পানির প্রবাহ কমে যাওয়ার বিষয়গুলো সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানের ওপর যে হুমকি সৃষ্ট করেছে, তা নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের জন্য স্বাগত। এই হুমকির কারণে সম্পদ বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ।
৬. বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ পুরো সুন্দরবনের ব্যাপারে বাংলাদেশ (সুন্দরবন) ও ভারতের (সুন্দরবন ন্যাশনাল পার্ক) আন্তসীমান্ত সহযোগিতার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে সহযোগিতা বাড়াতে উভয় দেশের সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত। সংশ্লিষ্ট এলাকায় পর্যাপ্ত স্বাদু পানির প্রবাহ নিশ্চিত করার বিষয়ে ২০১৬ সালে ইউনেসকোর মিশনের করা সুপারিশ পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে।
৭. রামপাল প্রকল্প নিয়ে ২০১৬ সালে ইউনেসকোর রিঅ্যাক্টিভ মনিটরিং মিশনের করা অন্যান্য সুপারিশও পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়নে ধারাবাহিক পদক্ষেপ নিতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
৮. ‘ন্যাশনাল ওয়েল স্পিল অ্যান্ড কেমিক্যাল কন্টিনজেন্সি প্ল্যান’-এর (এনওএসসিওপি)খসড়া তৈরির অগ্রগতিকে স্বাগত। সেই সঙ্গে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত তহবিল জোগান এবং মানবসম্পদের ব্যবহার নিশ্চিত করতে অনুরোধ জানানো হলো। সাম্প্রতিক নৌদুর্ঘটনাগুলোতে বিপজ্জনক উপাদান ছড়িয়ে পড়ার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে আরো তথ্য দিতে হবে। নৌচলাচলের কারণে ক্ষতিকর প্রভাব কমাতে নৌচলাচল ব্যবস্থাপনা, ড্রেজিংয়ের মতো বিষয়গুলো সম্পর্কেও তথ্য দিতে হবে।
৯. পশুর নদে পরবর্তী কোনো ড্রেজিং কার্যক্রম চালানোর আগে সুন্দরবনের আউটস্ট্যান্ডিং ইউনিভার্সাল ভ্যালুর (ওইউভি) ওপর এর প্রভাব নিয়ে সমীক্ষা চালানোর অনুরোধ জানানো হলো। সেই সঙ্গে কৌশলগত পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) করারও অনুরোধ জানানো হলো।
১০. কমিটি উদ্বিগ্ন যে, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করা হলে সুন্দরবনে পরিবেশগত প্রভাব পড়বে। বায়ু ও পানিদূষণ বাড়বে। নৌচলাচল ও ড্রেজিং বেড়ে যাবে। মিঠা পানি কমে যাবে। এর মধ্যেই ওই অঞ্চলের পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে। বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির ৪১তম অধিবেশন ডব্লিউএইচসি/ ১৭ / ৪১. কম/ ১৮, পি ১০৪ অনুসারে কমিটি কৌশলগত পরিবেশ মূল্যায়নের (এসইএ) অংশ হিসেবে এসবের প্রভাব নিরূপণ নিশ্চিত করতে হবে বাংলাদেশকে। ঝুঁকি কমাতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। সুন্দরবনের আউটস্ট্যান্ডিং ইউনিভার্সাল ভ্যালুর (ওইউভি) ওপর ক্ষতিকর প্রভাব এড়াতে বাংলাদেশকে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
১১. সবশেষে অনুরোধ, যেসব শর্ত দেওয়া হয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি উল্লেখ করে একটি প্রতিবেদন ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ্ব ঐতিহ্য কমিটির কাছে জমা দিতে হবে। কমিটির ২০১৯ সালে অনুষ্ঠেয় ৪৩তম অধিবেশনে ওই প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করা হবে।