খােলা বাজার২৪।। মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭: বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রাখাইনে নির্যাতিত অসহায় রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভালোবাসায় রীতিমতো মুগ্ধ হয়ে পড়েছেন। আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মুখে মুখে শুধু স্থানীয়দের ভালোবাসার কথা। সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে একেবারে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী পর্যন্ত সবার ভালোবাসা এবং আন্তরিকতা রোহিঙ্গাদের অনেকটা অভিভূত করেছে। আশ্রিত রোহিঙ্গারা অকপটে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছেন। ক্যাম্পে, গ্রামগঞ্জে ঘুরে রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ এবং শিশুদের সঙ্গে আলাপকালে তাদের প্রতি স্থানীয়দের ভালোবাসা, অকাতরে সহযোগিতার কথাই শোনা গেছে।
জানা যায়, ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ ও সেনা ক্যাম্পে কথিত বিদ্রোহীদের হামলার পর সে দেশের সেনাবাহিনী এবং পুলিশের অমানবিক নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে চার লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। যারা টেকনাফ-উখিয়ার বিভিন্ন রোহিঙ্গা ক্যাম্প এবং গ্রামগঞ্জে অবস্থান করছে। রোহিঙ্গারা ইচ্ছামতো ঘুরছেন এবং থাকছেন। কেউ ক্যাম্পে বা ক্যাম্পের আশে পাশে নতুবা গ্রামগঞ্জে ঝুঁপড়ি ঘর বেঁধে পরিবার-পরিজন নিয়ে অবস্থান করছেন। মাতৃভূমি ছেড়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এখানকার মানুষের ভালোবাসা এবং সহযোগিতায় নিজ দেশের চেয়ে আরামে এবং শান্তিতে আছেন।
মংডুর বড়ডেইল এলাকার আবদু সুফাইদ বলেন, পর দেশ হলেও নিজ দেশের চেয়ে আরামেই আছি। ‘এডিয়ার মানুষ এন কেন ভালা’ জানিয়ে উলুচামরী এলাকায় এক স্থানীয়ের কাছে আশ্রয়ে থাকা শতবর্ষী মরিয়ম বলেন, ঝড় এবং বৃষ্টিতে কিছুটা কষ্ট হলেও আগের চেয়ে ভালো আছি। আলীখালী এলাকায় স্থানীয়ের আশ্রয়ে থাকা মংডুর হাচ্ছুরতা গ্রামের কাসিম জানান, জালেম রাষ্ট্র থেকে শান্তির রাষ্ট্রে এসেছি। এখানকার লোকজনের ভালোবাসায় শান্তিতেই আছি। স্থানীয় মাস্টার মো. আবদুস সালাম, ফখরুল ইসলাম ফারুকী, নূরী, আব্বাছ আলী, রফিকুল ইসলাম অপি, আনোয়ারুল ইসলাম নয়ন, আবুল হোছাইন, মাসুদ, নাজমুলদের মতো অনেকেই রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আন্তরিকতা ও ভালোবাসা দিয়ে সহযোগিতা করে আসছেন। এ কারণেই বাঙালিদের নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় রোহিঙ্গারা মুগ্ধ হয়ে পড়েছেন।
জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক এইচ. এম. ইউনুছ বাঙ্গালী জানান, আথিথেয়তা প্রদানে বাঙালি জাতি শ্রেষ্টত্বের আসনে। নির্যাতিত লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাঙালিরা তাই প্রমাণ করেছে।
টেকনাফ মডেল থানার ওসি মো. মাইন উদ্দিন খাঁন জানান, মিয়ানমারে সংঘটিত ঘটনা পরবর্তী বাংলাদেশে পালিয়ে আসার সময় নৌকা ডুবিতে ৯৮ জন রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। স্থানীয়দের সহযোগিতায় পুলিশ আন্তরিকতা দিয়ে সব লাশের দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করেছে।
টেকনাফে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ বিতরণ নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সমন্বয়কারী, সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রণয় চাকমা জানান, সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে আমরা অসহায় রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছি। যথাযথ শৃঙ্খলা বজায় রেখে প্রতিদিন তাদের মধ্যে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদ হোসেন ছিদ্দিক জানান, রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানে সরকার কাজ করছে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সব সমস্যার সমাধানে স্থানীয় প্রশাসন দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ত্রাণ এবং রোহিঙ্গা সংক্রান্তে যাবতীয় কিছুতে সংশ্লিষ্ট লোকজন শৃঙ্খলা ভালোবাসা দিয়ে সহযোগিতা করলে দেশান্তরিত নির্যাতিত জনগোষ্ঠী আরো বেশি উপকৃত হবে।
২৫ রোহিঙ্গার অস্ত্রোপচার করছে বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটি: কক্সবাজার সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে ঢাকা থেকে ছুটে আসেন বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির ১০ সদস্যের একটি বিশেষজ্ঞ দল। গতকাল সোমবার ও আজ মঙ্গলবার দুই দিনব্যাপী ‘বিশেষ অস্ত্রোপচার কর্মসূচি’র মাধ্যমে ২৫ জন আহত রোহিঙ্গার অস্ত্রোপচারের উদ্যোগ নেয় সংগঠনটি। ১ম দিনে অর্থাৎ সোমবার ১০ জনের সফল অস্ত্রোপচার করা হয়।
কক্সবাজার সদর হাসপাতালের অর্থোপেডিক বিভাগের চিকিৎসক ডা. মারজানা খানম বলেন, গতকাল সকাল ৯টা থেকে অস্ত্রোপচার কর্মসূচি শুরু হয়। এই কর্মসূচিতে শুধুমাত্র আহত রোহিঙ্গাদের অস্ত্রোপচার করা হচ্ছে। প্রথম দিনে ১০ জনের অস্ত্রোপচার করা হয়। এরা হলেন- ইমাম হোসেন (৪৫), নুর জাহান (৪০), মো. হোছেন (৭০), মর্জিনা আক্তার (১৩), ফাতেমা বেগম (৬০), নুর কায়েদা (১০), কলিম উল্লাহ (১২), ধলু হোসেন (৫১), আলমাস খাতুন (৬০) ও সাইফুল্লাহ (২৫)।
তিনি বলেন, এর মধ্যে মাত্র একজন রোগী গুলিবিদ্ধ রয়েছেন। বাকিরা সবাই হাড় ভাঙা, কোমর ভাঙা, পায়ের রগ কাটা রোগী। হাসপাতালের ৩য় তলায় অস্ত্রোপচার কক্ষের বাইরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটির সভাপতি ও পঙ্গু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল গণি মোল্লা। তিনি বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে মিয়ানমারে যে নির্যাতনের খবর শুনেছেন এবং গণমাধ্যমে জেনেছেন সেটা খুবই অমানবিক। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এখন সারা বিশ্ব রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে এগিয়ে আসছে। তাই মানবিক তাড়নায় তারাও রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়াতে ছুটে এসেছেন।
তিনি আরো বলেন, তার সঙ্গে দেশের ৯জন জ্যেষ্ঠ অর্থোপেডিক সার্জন আছেন। দুইদিনের কর্মসূচিতে প্রাথমিকভাবে ২৫ জন রোগী নির্ধারণ করা হয়। সময় পেলে নির্ধারিত সংখ্যার বাইরেও অস্ত্রোপচার করার চিন্তা ভাবনা রয়েছে তাদের। পরবর্তীতে আরো কর্মসূচি নেয়ার চেষ্টা করবেন বলে জানান তিনি।
কক্সবাজার হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল কর্মকর্তা (আরএমও) ডা. শাহিন আব্দুর রহমান বলেন, গত ২৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ১৭০ জন গুলিবিদ্ধ ও আহত রোগী ভর্তি হয়। বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ৫৩ জন। সেখান থেকে ২৫ জন রোহিঙ্গা রোগীকে অস্ত্রোপচার করছে বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটি। যাদের দ্রুত ও উন্নতমানের অস্ত্রোপচার প্রয়োজন তাদেরই এই কর্মসূচির মাধ্যমে অস্ত্রোপচরা করানো হচ্ছে। তিনি বলেন, বিনামূল্যের এই কর্মসূচিতে বাংলাদেশ অর্থোপেডিক সোসাইটি যন্ত্রপাতি ও ওষুধ দিয়েও সহযোগিতা করছে। -মানবকণ্ঠ