সোমবার, ২ অক্টোবর ২০১৭: ১৯৭০-এর দশক থেকে মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু হয়। সেখানে বসবাসরত রোহিঙ্গদের ৮০ শতাংশের বেশি বসতভিটা ছেড়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্যানুযায়ী ১৯৭০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে ১১ লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম পালিয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ভারত, উপসাগরীয় এবং এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে।
ইউরোপীয় কমিশনের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের শুরুতে রাখাইন রাজ্যে মুসলমানদের সংখ্যা ছিল ৮ লাখ। জাতিসঙ্ঘের সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে গত ২৫ আগস্ট নতুন করে জাতিগত নিধনযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর ৫ লাখ ১০ হাজার রোহিঙ্গা সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের তথ্যানুযায়ী রাখাইন রাজ্যে এখন মাত্র ৩ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে। বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ১৬ লাখ।
প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, ১৯৭০ সালের পর ৮৪ শতাংশ বা ১৯ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। রাখাইনে এখন রয়েছেন মাত্র ১৬ শতাংশ রোহিঙ্গা। এই সংখ্যা থেকে বোঝা যায় যে, রোহিঙ্গা মুসলমানরা কী ভয়ানক জাতিগত নিধনের শিকার হয়েছেন। উদ্বাস্তুদের সাম্প্রতিক প্রবাহ শুরু হয়েছে রোহিঙ্গা গ্রামে নিরাপত্তা বাহিনী ও বৌদ্ধ মগদের নতুন অভিযানের ফলে, এতে নারী-শিশুসহ কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে, তাদের বাড়িঘর লুট করে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানিয়েছেন, প্রায় ৩ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে।
জাতিসঙ্ঘ বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী হিসেবে রোহিঙ্গাদের উল্লেখ করেছে। ২০১২ সালে সাম্প্রদায়িক সহিংসতায় কয়েকজন নিহত হওয়ার পর থেকে সহিংসতা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে।
মিয়ানমার ১৯৮২ সালে জাতীয়তা নিয়ে একটি আইন পাস করে যাতে রোহিঙ্গাদের দেশটির নাগরিক হিসেবে স্বীকার করা হয়নি। শত শত বছর ধরে দেশটিতে বসবাসকারী রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নাগরিকত্ব হরণের পর থেকেই তাদের সমস্যা চরম আকার ধারণ করেছে।
মিয়ানমারকে অবশ্যই একঘরে করতে হবে
Gulf News সম্পাদকীয়
মিয়ানমারের সাবেক সামরিক জান্তার সাথে বর্তমান সরকারের কোনো পার্থক্য নেই। তাই এখনই জরুরি ভিত্তিতে মিয়ানমারকে আগেকার মতো একঘরে করে এড়িয়ে চলতে হবে। এ ক্ষেত্রে জরুরিভিত্তিতে যা করা প্রয়োজন তার সাথে আছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। অনলাইন গালফ নিউজের এক সম্পাদকীয়তে এ কথা বলা হয়েছে।
‘মিয়ানমার মাস্ট বি শানড অ্যান্ড আইসোলেটেড’ শীর্ষক ওই সম্পাদকীয়তে আরো বলা হয়, এ ক্ষেত্রে জরুরিভিত্তিতে পরিকল্পনা নিতে পারে জাতিসঙ্ঘ। সব সময় যেভাবে করেছে ঠিক সেভাবেই ভাইদের সাহায্য করতে পাশে আছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। এতে আরো বলা হয়, গত প্র্রায় ছয় সপ্তাহ ধরে পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থী তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। কৃষিজমি, বন পেরিয়ে তারা উত্তাল সাগর পাড়ি দিয়েছেন নিষ্পেষণ ও হত্যাযজ্ঞের হাত থেকে রেহাই পেতে। এসব অপরাধ করছে ইয়াংগুনের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী ও সেনারা। নিজ দেশে নিষ্পেষণ থেকে রক্ষা পেতে পালানো মাঝে মধ্যেই ট্রাজেডিতে পরিণত হচ্ছে। শুধু বুধবার রাতে কক্সবাজার সৈকতে ভেসে উঠেছে ১৫ রোহিঙ্গার লাশ।
রোহিঙ্গাদের এককভাবে বেছে নেয়া হয়েছে একটি কারণেÑ মাত্রই একটি কারণেÑ তা হলো তারা মুসলিম। মিয়ানমারে সরকার স্বীকৃত কমপক্ষে ১৩০টি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস আছে। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গারা বসবাস করলেও তাদের স্বীকৃতি দেয়নি রাষ্ট্র। উল্টো দশকের পর দশক চাপাতি ও অস্ত্র হাতে উগ্রপন্থীরা তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। পুড়িয়ে দিয়েছে মসজিদ। টার্গেট করেছে মুসলিম সংখ্যালঘুদের। পুড়িয়ে দিয়েছে তাদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। আগস্টের শেষের দিকে সেখানে সেনাবাহিনী পুরোদমে নৃশংস অভিযান শুরু করেছে বিপর্যস্ত ও নিরস্ত্র রোহিঙ্গাদের ওপর।
বৃহস্পতিবারে নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে এ নিয়ে মুক্ত আলোচনা হয়েছে। সেখানে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব অ্যান্টনিও গুতেরেস রোহিঙ্গাদের এই দুর্দশাকে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুততম সময়ের শরণার্থী সঙ্কট, মানবিক সঙ্কট ও মানবাধিকারের জন্য এক দুঃস্বপ্ন বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি এর আগে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এই অভিযানকে জাতি নিধন হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। ওই অনুষ্ঠানে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চির সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি। তিনি বলেছেন, মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে আমরা ভীত হবো না। সেখানে দৃশ্যত এক নৃশংসতা ঘটেছে। সেখানে জাতি নিধন চলছে। মিয়ানমারের গণতন্ত্রের জন্য যেসব নেতা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের জন্য লজ্জা হওয়া উচিত। ওই দিকে রোহিঙ্গা জাতি নিধনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে মিয়ানমার। তারা বলছে, এখনো রাখাইনে ৫৬ শতাংশ গ্রাম অক্ষত আছে। এর অর্থ ৪৪ শতাংশ গ্রাম পুড়িয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। এ জন্য পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ এখন বেঁচে আছেন মানবিক সাহায্য, সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে, তবে এ ক্ষেত্রে তারা যদি বাংলাদেশে পৌঁছানোর মতো সৌভাগ্যবান হয়ে থাকেন।