খােলা বাজার২৪।।শনিবার, ০৭ অক্টোবর, ২০১৭: ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পানাগড় থেকে চীন সীমান্তে পৌঁছাতে এক ঘণ্টাও লাগে না সুপার হারকিউলিসের। এই সময়ের মধ্যেই প্রায় আড়াই শ’ সেনা সদস্য নিয়ে চীনের সীমান্তে পৌঁছে যেতে পারে এই অত্যাধুনিক বিমান। আবার এই ১৩০ জে সুপার হারকিউলিস বিমান থেকেই সহজে শত্রুশিবিরের কাছাকাছি ঝাঁপিয়ে পড়ে আক্রমণ হানতে পারে প্যারাট্রুপার অথবা ভারতীয় বিমানবাহিনীর ‘গরুড়’ কমান্ডোরা। তাই বিমানবাহিনীর কাছে এখন পশ্চিম বর্ধমানের পানাগড়ে ‘এয়ারফোর্স স্টেশন অর্জন সিং’য়ের গুরুত্ব অপরিসীম। ভারতীয় মিডিয়ায় শনিবার এ খবর প্রকাশিত হয়েছে।
শুক্রবার পানাগড়ে এয়ার ভাইস মার্শাল বিক্রম সিং জানান, পানাগড় বিমানবাহিনীর ঘাঁটির পরিকাঠামো এখন এতটাই উন্নত যে, এই বিমানঘাঁটি থেকে শত্রুশিবিরের দিকে উড়ে যেতে পারে যেকোনো রকমের ‘ফাইটার’ বা যুদ্ধবিমান। চীনের সীমান্ত থেকে তুলনামূলকভাবে কম অথচ নিরাপদ দূরত্বের কথা মাথায় রেখে পানাগড়ে তৈরি হয়েছে ‘সুপার হারকিউলিস’ হাব। এখন এই ‘হাব’-এ রয়েছে ছয়টি অত্যাধুনিক ১৩০জে সুপার হারকিউলিস বিমান। আরো দুটি বিমান নিয়ে আসা হতে পারে এই ‘হাব’-এ। এবার থেকে ‘অপারেশনাল বেস’ হিসেবে কাজ শুরু করল পানাগড়ের বিমানবাহিনী ঘাঁটি। তাই দিনে ও রাতে সারাক্ষণই মহড়া দিচ্ছে সুপার হারকিউলিস।
ভারতীয় মিডিয়ার খবরে বলা হয়, এই পানাগড়েই রয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পার্বত্য বাহিনী। মহড়ার অংশ হিসাবে যথাসম্ভব কম সময়ের মধ্যে সুপার হারকিউলিস সেনাদের উড়িয়ে নিয়ে চলেছে চীনের সীমান্তে। কখনো বা এই বিমান যাচ্ছে উত্তরবঙ্গের হাসিমারা বা বাগডোগরায়। আবার কখনো হারকিউলিস সেনাদের নিয়ে যাচ্ছে অরুণাচলের মেচুকা বা তাংওয়াং অথবা আসামের ছাবুয়ায়। আবার সীমান্তবর্তী এলাকায় চলছে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর মহড়াও।
কারণ শত্রুপক্ষের শিবিরের কাছে সেনা ও প্যারাট্রুপারদের নামিয়ে দিয়েই অল্প সময়ের মধ্যে ফিরে যেতে পারে এই বিমান। আবার ‘অপারেশন’-এর শেষে সুপার হারকিউলিস এসে কম সময়ের মধ্যে তুলে নিয়ে যেতে সক্ষম পুরো বাহিনীকে। পানাগড়ের বিমানবাহিনীর ঘাঁটির রানওয়ের পাশে মহড়া দিচ্ছে সেনাবাহিনীর এল ৭০ বিমানধ্বংসী কামান। এই কামানের র্যাডার জানিয়ে দিচ্ছে কোনদিকে রয়েছে বিমান। সেইমতো স্বয়ংক্রিয়ভাবে কামানের নল ঘুরে চলেছে আকাশ লক্ষ্য করে।
সুপার হারকিউলিস বিমানে রয়েছে ইনফ্রারেড ক্যামেরা। অত্যন্ত কম শব্দ করে চলে এই বিমান। ওঠানামা করতেও লাগে কম জায়গা। এই বিমান বহন করতে পারে সেনা জিপ বা ট্যাঙ্ক। প্রয়োজন হলে মাঝ আকাশেই তেল ভরতে পারে। টানা বারো ঘণ্টা ধরে উড়তে পারে এই বিমান। তাই গভীর রাতেও শুরু হয়েছে যুদ্ধের মহড়া। রাতের অন্ধকার ভেদ করে পানাগড়ের বিমানবাহিনী ঘাঁটি থেকে উড়ে যাচ্ছে সুপার হারকিউলিস।
উল্লেখ্য, পানাগড়ে অত্যাধুনিক রাফায়েল যুদ্ধবিমান মোতায়েনের কথাও চলছে।
ডোকলামে আবার রাস্তা বানাচ্ছে চীন
মাসখানেক আগে শেষ হয়েছে ডোকলামে ভারত ও চীনের টানাপড়েন। কিন্তু আবারো চীন, ভুটান ও ভারতের সীমান্তে ওই এলাকায় রাস্তা তৈরির কাজ শুরু করেছে চীনের সৈন্যরা।
ত্রিদেশীয় সীমান্তের ডোকলাম মালভূমিকে ভুটানের অংশ বলে মনে করে থিম্পু। কিন্তু বেজিংয়ের দাবি, ওই ভূখণ্ড তাদের। ভুটানের দাবির প্রতি সমর্থন রয়েছে দিল্লির। জুন মাসে ওই এলাকায় চীনা সেনা রাস্তা তৈরির কাজ শুরু করায় হস্তক্ষেপ করে ভারতীয় সেনা। ফলে প্রায় দুই মাস ডোকলামে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ছিল ভারত ও চীনের সেনা। সেইসাথে শুরু হয় দুই দেশের বাগ্যুদ্ধ।
শেষ পর্যন্ত চীনে ব্রিকস সম্মেলনের কিছু দিন আগে সমঝোতায় পৌঁছায় দু’পক্ষ। ২৮ অগস্ট ডোকলাম থেকে সেনা সরানোর সিদ্ধান্ত নেয় ভারত ও চীন।
কিন্তু সেনা সূত্রে খবর, ২৮ আগস্টের পর থেকেই আবার সক্রিয় হয় চীনা সেনারা। জুন মাসে যে এলাকায় দুই দেশের সেনা মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল সেখান থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে আবারো কাজ শুরু করেছে তারা। একটি রাস্তাকে ফের চওড়া করা হচ্ছে। নির্মাণকর্মীদের সাথে ৫০০ চীনা সেনাও এসেছে। তবে তাদের জন্য ওই এলাকায় কোনো স্থায়ী ছাউনি তৈরি করা হয়নি। চীনা শহর ইয়াটুং ডোকলামের ওই এলাকা থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে। চীনা সেনা ও নির্মাণকর্মীরা সেখান থেকেই সড়কপথে যাতায়াত করছে।
ভারতীয় সেনা সূত্রের মতে, কূটনৈতিক উত্তাপ চরমে ওঠায় চীন সাময়িক সমঝোতা করেছিল। কিন্তু তারা যে ফের ওই এলাকায় শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা করতে পারে তা আঁচ করতে পেরেছিল দিল্লি। ফলে ডোকলাম মালভূমি থেকে নেমে এলেও ওই এলাকা থেকে ভারতীয় সেনা পুরোপুরি সরেনি। ভারতীয় সেনার তৈরি অস্থায়ী পরিকাঠামোও সরানো হয়নি। ফলে প্রয়োজনে আবারো ডোকলামে উঠে চীনকে বাধা দিতেই পারে ভারতীয় সেনা।
আগামী সপ্তাহে দিল্লিতে সেনা কম্যান্ডারদের সম্মেলন হওয়ার কথা। সেখানে চীন সীমান্তে ভারতীয় সেনার প্রস্তুতি নিয়ে বিশদ আলোচনা হবে। সেনা সূত্র বলছে, ডোকলামে রাস্তা নির্মাণকর্মীদের সাথে ৫০০ চীনা সেনা রয়েছে ঠিকই। কিন্তু ওই এলাকায় দেড় থেকে দুই হাজার চীনা সেনা রয়েছে।
সীমান্তে চীন-ভারত গোলাগুলি না হওয়ার রহস্য
ডোকলাম নিয়ে ভারত আর চীনের মধ্যে বিরোধ চললেও দুই দেশের সেনারা হিংসাত্মক কোনো ঘটনা ঘটায়নি। বিপরীত চিত্র পাকিস্তান আর ভারতের সীমান্তে। সেখানে নিয়মিত গুলি বিনিময় হয় দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে, মাঝে মাঝেই দুই দেশের সেনাসদস্যদের মৃত্যুও হয়।
কিন্তু ভারত-চীন সীমান্তে বড়জোর দুই বাহিনীর মধ্যে হাতাহাতি হয় – তার বেশি কিছু না।
দুই দেশের সাথে দুই সীমান্তে কেন দুই চিত্র?
চীনে কর্মরত সিনিয়র সাংবাদিক শৈবাল দাসগুপ্ত বলছেন, “ভারত আর চীনের মধ্যে একটা সমঝোতা আছে যে যতই মতভেদ হোক, সীমান্তে উত্তেজনা কোনো দেশই বাড়তে দেবে না।
অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন চীনে এসেছিলেন, সেই সময়েই রাজনৈতিক প্রেক্ষিতটা তৈরি হয়েছিল। পরে মনমোহন সিংয়ের আমলেও সেই একই নীতি অনুসরণ করা হয়েছে।”
“দুটো দেশের মধ্যে এরকম সিদ্ধান্ত রয়েছে যে ফ্রন্ট লাইনে যেসব সেনা সদস্য মোতায়েন থাকবেন, তাঁদের কাছে কোনও রকম অস্ত্র থাকবে না। যদি সেনা র্যাঙ্ক অনুযায়ী কোনও অফিসারের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র রাখা নিয়ম হয়, তাহলে তার নল মাটির দিকে ঘুরিয়ে রাখা থাকবে। সেজন্যই দুই দেশের সেনাসদস্যদের হাতাহাতি বা কুস্তি করার ভিডিও দেখা যায়, কোথাও গুলি বিনিময়ের ছবি দেখা যায় না। পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের এরকম কোনো চুক্তি নেই,” বলছিলেন দাশগুপ্ত।
ভারত আর চীনের সেনাদের মধ্যে যখন উত্তেজনা বেড়ে যায়, বা হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছয়, সেইসময়েও কয়েকটা দিকে নজর রাখা হয়।
দুই দেশের সেনাদের মধ্যে হাতাহাতির যেসব ভিডিয়ো দেখা যায় গণমাধ্যম বা সামাজিক মাধ্যমে, সেগুলো যদি কেউ খুঁটিয়ে দেখেন, তাহলেই বোঝা যাবে সৈনিকরা যেন বাচ্চাদের মতো কুস্তি লড়ছে।
একে অপরকে ধাক্কা দেয়, কেউ পড়ে গিয়ে আবার উঠে দাঁড়ায়। কিন্তু কেউ কাউকে চড়-থাপ্পড় মেরেছে, এটা দেখা যায় না। চড় মারা অপমান করার সামিল।
তাই ধাক্কাধাক্কির সময়েও কেউই হাত ব্যবহার করে না। নিজেদের রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্যই সেনা সদস্যরা এটা করে থাকেন।
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অশোক মেহতা বলছিলেন, “১৯৭৫ সালে শেষবার ভারত আর চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যে গুলি চলেছিল। সেই ঘটনায় কোন পক্ষেরই কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, কিন্তু সেটার পুনরাবৃত্তি হয় নি। নিয়মিত সমঝোতা আর আলোচনার মাধ্যমেই লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের সমস্যাগুলোকে দুই দেশই ব্যাক বার্ণারে ঠেলে দিয়েছে।”
১৯৯৩ সালে নরসিমহা রাও যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সেই সময়ে মেইন্টেন্যান্স অফ পিস এন্ড ট্র্যাঙ্কুয়েলিটি চুক্তিটি সাক্ষরিত হয়েছিল।
১৯৯৬ সালে আস্থা বর্ধক ব্যবস্থাপত্রে সই করে দুই দেশ। ২০০৩ আর ২০০৫ সালেও চুক্তি হয়েছে। আর ২০১৩ সালে সই হওয়া বর্ডার ডিফেন্স কোঅপারেশন এগ্রিমেন্টই এ বিষয়ে সর্বশেষ চুক্তি।
মেজর জেনারেল মেহতার কথায়, “সীমান্তের যে অংশগুলো অমীমাংসিত, সেখানে দুই দেশই শান্তি বজায় রাখে আর নির্দিষ্ট চুক্তি থাকার ফলে কোথাও গুলি চলে না। দুই দেশই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আগেই যে সীমান্ত সমস্যাগুলো নিয়ে তখনই ভাবা যেতে পারে যখন আমাদের মধ্যে অর্থনৈতিক আর নাগরিক সম্পর্কগুলো পাকাপোক্ত হয়ে উঠবে।”
পাকিস্তানের সাথে এমন কোনো সমঝোতা নেই ভারতের
ভারত পাকিস্তান সীমান্ত নিয়ে মেহতা বলছেন, “১৯৪৯ এর করাচি চুক্তি অনুযায়ী সিজ ফায়ার লাইন বা অস্ত্র বিরতি রেখা নির্ধারিত হয়েছিল।
১৯৬৫-র যুদ্ধে ওই রেখায় কোনো বদল ঘটেনি। কিন্তু ৭১-এর যুদ্ধে ভারতের কাছে যখন প্রায় ৯০ হাজার পাকিস্তানী সেনা যুদ্ধবন্দী হয়ে গিয়েছিল, সিজফায়ার লাইনটিকে সেই সময়েই এল-ও-সি, অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ রেখা বলে ধরে নেওয়া হয়। আর এই এল-ও-সি তে অস্ত্র বিরতির ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে কোনো চুক্তি নেই।”
পারভেজ মোশারফ যখন প্রেসিডেন্ট আর সেনাপ্রধান ছিলেন, সেই সময়ে, ২০০৩ সালে নভেম্বরে পাকিস্তানের পক্ষ থেকেই একটা সমঝোতা পত্র এসেছিল।
সেখানে প্রস্তাব ছিল যে এল-ও-সিতে অস্ত্র বিরতি হওয়া উচিত। যতদিন মোশারাফ প্রেসিডেন্ট ছিলেন, ততদিন ওই অস্ত্র বিরতি চালু ছিল।
বলা যায়, প্রায় ৮০ শতাংশ সফল হয়েছিল ওই সমঝোতা। কিন্তু ২০০৮ সালে মোশারাফ চলে যাওয়ার পর থেকে ওই সমঝোতা পত্রের গুরুত্ব কমতে থাকে।
“এখন যা পরিস্থিতি, তাতে লাইন অফ কন্ট্রোল হয়ে গেছে লাইন অফ নো কন্ট্রোল। কোনো অস্ত্র বিরতিই আর নেই সেখানে,” বলছিলেন মেজর জেনারেল মেহতা।
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনার প্রসঙ্গে শৈবাল দাসগুপ্তর মন্তব্য, “নওয়াজ শরিফ আর নরেন্দ্র মোদি সমস্ত সমস্যা নিয়েই ভাবনাচিন্তা করেছেন। কিন্তু ভারত আর পাকিস্তান – দুই দেশেই এমন কিছু শক্তি আছে, বিশেষ করে টেলিভিশন রেটিং পয়েন্টসের পেছনে দৌড়নো কিছু গণমাধ্যম, যারা আসলে খড়ের গাদায় আগুন লাগানোর কাজটা সমানে করে চলে। শান্তি বজায় থাকার সম্ভাবনাগুলোও ধীরে ধীরে কমে আসে এর ফলে। অবস্থা এখন এমনই, পাকিস্তান আমাদের জন্য একটা অবসেশন হয়ে গেছে, আর পাকিস্তানীদের কাছে কাশ্মীর।