খােলা বাজার২৪। সোমবার, ২৩ অক্টোবর ২০১৭: খুলনায় পাট খাতে সোনালী ব্যাংকের দেওয়া ঋণের প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা আদায় নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এরপরও ঋণ দেওয়া হচ্ছে। এ অঞ্চলে রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকটির ছয়টি শাখায় ১১২ জন গ্রাহকের কাছে পাওনা আছে এক হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা। এই গ্রাহকদের মধ্যে ১০৮ জনই ঋণখেলাপির তালিকায়। তাঁদের কাছে পাওনা আছে এক হাজার ২০০ কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঋণখেলাপির সবচেয়ে ভয়াবহ চিত্র প্লেজ ঋণের (গুদামজাত পাটের বিপরীতে দেওয়া ঋণ) ক্ষেত্রে। দেড় হাজার কোটি টাকা ঋণের মধ্যে প্লেজ ঋণই হচ্ছে ৮৭০ কোটি টাকা। ঋণগ্রহীতারা শুধুমাত্র কাগজে-কলমে গুদামে পাট দেখিয়েছেন, কিন্তু বাস্তবে নেই। গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংকের যৌথ তদন্তে এসব চিত্র উঠে এসেছে। তবে প্লেজ ঋণে ভয়াবহ বিপর্যয়ের ফলে তিন বছর ধরে পাট খাতে ঋণ দেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। ঋণ নেওয়ার পর ব্যাংকমুখোই হননি এসব গ্রাহক। যার ফলে তা খেলাপিতে চলে গেছে।
সোনালী ব্যাংকের খুলনা অঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোশারেফ হোসেন জানান, ঋণখেলাপির অভিযোগে ১০৮ জন গ্রাহককে ব্যাংক থেকে লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়েছে। যার মেয়াদ শেষ হয়েছে গত আগস্ট মাসে। ব্যাংকের বিধি মোতাবেক সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা ছিল। কিন্তু ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের লিখিত সার্কুলারে কোনো প্রকার অর্থ পরিশোধ ছাড়াই ওই সব গ্রাহককে দুই বছর সময় দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে আগের টাকা ব্লক হিসাবে তাঁদের আবার নতুন করে প্রয়োজনীয় জামানত নিয়ে ঋণ দিতে বলা হয়েছে।
কয়েকজন পাট ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাদেশ জুট অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএ) চেয়ারম্যান শেখ সৈয়দ আলী চলতি বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারি অর্থমন্ত্রীর কাছে একটি চিঠি দেন। চিঠিতে কাঁচা পাট রপ্তানিকারকদের সব বকেয়া এবং দেনা একটি সুদবিহীন ব্লক হিসাবে স্থানান্তর করে ১০ শতাংশ সহায়ক জামানতের ভিত্তিতে ২৫ বছরে ঋণ পরিশোধের সুযোগ চাওয়া হয়। সেই আবেদনের সুবাদে তাঁরা সরকারের উচ্চপর্যায়ে সাক্ষাৎ করেন।
আরো জানা যায়, রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে গত ২৬ আগস্ট সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের মহাব্যবস্থাপক মো. খায়রুল কবীর, উপমহাব্যবস্থাপক গোলাম নবী মল্লিক স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশ জারি করা হয়। এতে ঋণখেলাপিদের কোনো প্রকার ডাউন পেমেন্ট (প্রথম কিস্তিতে যে অর্থ পরিশোধ করা হয়) ছাড়াই দুই বছর সময় দেওয়া হয়। দুই বছর পর থেকে গ্রাহকরা কিস্তিতে ঋণ পরিশোধ করবেন। একই সঙ্গে এসব ঋণখেলাপি নতুন ঋণ নেওয়ার সুযোগ পাবেন। এই আদেশের কারণে খুলনার সোনালী ব্যাংকের নেওয়া সব পদক্ষেপ স্থগিত হয়ে যায়।
সোনালী ব্যাংকের খুলনা অঞ্চলের মহাব্যবস্থাপকের অফিস সূত্রে জানা যায়, ব্যাংকের খুলনা করপোরেট শাখা থেকে পাট খাতে ৫২ ব্যবসায়ীকে দেওয়া ঋণের পরিমাণ ৩৮৩ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এই গ্রাহকদের সবাই ঋণখেলাপি। দৌলতপুর করপোরেট শাখায় ১৯ গ্রাহকের কাছে ঋণের পরিমাণ ৬৬৯ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১৬ জন ঋণখেলাপির তালিকায়। তাদের কাছে পাওনা ৪৩৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। দৌলতপুর কলেজ রোড শাখায় ২০ গ্রাহকের কাছে পাওনা ৩২২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। একই চিত্র খুলনার খালিশপুর এবং স্যার ইকবাল রোড শাখার।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খুলনা অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে পাট রপ্তানিকারক হিসেবে রয়েছে দৌলতপুরের আকুঞ্জি ব্রাদার্স ও প্রগতি জুট। সব মিলিয়ে তাদের ঋণের পরিমাণ যথাক্রমে ১০ ও ১২ কোটি টাকা মাত্র। অথচ ২০০৫-২০০৬ সালের পর যাঁরা ব্যবসায় এসেছেন, ব্যবসায় এসেছেন তাঁদের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯০ থেকে শতকোটি টাকা।
প্রগতি জুটের মালিক সাইফুল ইসলাম পিয়াস বলেন, ২০১০ সালের দিকে ব্যাংক কর্মকর্তারা আর্থিক সুবিধা নিয়ে প্রায় সব পাট রপ্তানিকারকের ঋণ দ্বিগুণ করে দেন। আবার এসব পাট ব্যবসায়ী ব্যাংকে যা জামানাত হিসেবে দিয়েছেন, তার মধ্যে এফডিআর (স্থায়ী আমানত) বাদে অন্য সব জামানতই ভুয়া। যে কারণে গত দুই বছরে নিলাম আহ্বান করা হলেও এসব জামানত বিক্রি হয়নি।
২০০৫-২০০৬ সালে পাটের ব্যাপারী থেকে রপ্তানিকারক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন চুয়াডাঙ্গার ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম। তিনি ও তাঁর ছেলের নামে সব মিলিয়ে ঋণের পরিমাণ প্রায় ৯৫ কোটি টাকা।
সোনালী ব্যাংকের দৌলতপুর কলেজ রোড শাখার দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সিরাজুল ইসলাম রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন সময় ঋণ নেন। এখনো প্রতিনিয়ত তিনি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দিয়ে নানা সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। বিগত ১০ বছরে তিনি এই ৯০ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। তাঁর নিজের ও ছেলের নামে তিনটি হিসাব রয়েছে, যা জাল-জালিয়াতি ও প্রতারণার মাধ্যমে একবার উত্তোলন করে আর জমা দেওয়া হয়নি। ২০০৫ সালে চুয়াডাঙ্গার জ্যোতি বিস্কুট প্রতিষ্ঠানের অংশীদার ছিলেন সিরাজুল। ওই প্রতিষ্ঠানের আরেক অংশীদার সেন্টু আগারওয়ালা হত্যা মামলার আসামি তিনি।
ঋণখেলাপের জন্য সোনালী ব্যাংক দৌলতপুর কলেজ শাখার পক্ষ থেকে গত ১৮ জুলাই ১৫ দিন সময় বেঁধে দিয়ে সিরাজুলকে লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, চলতি বছর গত ৩১ জুন পর্যন্ত এই হিসাবে তাঁর কাছে পাওনা ৪৭ কোটি ৫৯ লাখ ৬৬ হাজার ২৪৩ টাকা। একইভাবে সিরাজুল ইসলামের ছেলে সাজেদুর রহমানকে দেওয়া নোটিশে একই সময় পর্যন্ত তাঁর কাছে ২৩ কোটি ৫৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬৫৮ টাকা, সিরাজুল ইসলামের মালিকানাধীন মেসার্স এসআর জুট ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের কাছে ২৩ কোটি ৫৭ লাখ ৮৩ হাজার ৬৫৮ টাকা পাওনা আছে বলে জানানো হয়। একই শাখায় সিরাজুল ইসলামের নামে আরো ১০ কোটি টাকা ঋণ আছে।
শুধু সিরাজুল ইসলামই নয়, খুলনার ইস্টার্ন ট্রেডার্সের মালিক সঞ্জিব কুমার দাসের কাছে ৯৫ কোটি টাকা, এ কে জুটের মালিক অশোক কুমার দাসের কাছে ৮৬ কোটি টাকা, রেজা জুটের মালিকের ৪৫ কোটি টাকা, মোল্লা ব্রাদার্সের কাছে ৬২ কোটি টাকা পাওনা আছে সোনালী ব্যাংকের।
এ ব্যাপারে জানতে সোনালী ব্যাংকের দৌলতপুর শাখার ব্যবস্থাপক ও মুখ্য কর্মকর্তা জাকির হোসেন খান বলেন, সিরাজুল ইসলাম ও তাঁর ছেলেসহ তাঁদের তিনটি প্রতিষ্ঠানের কাছে প্রায় শতকোটি টাকা পাওনা আছে। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলাম বলেন, খেলাপি ঋণ নিয়ে সংসদ সদস্য মুন্নুজান সুফিয়ানকে নিয়ে অর্থমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীসহ বিভিন্ন মহলে বৈঠক হয়েছে। তাঁরা ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছেন। এখন আর কোনো সমস্যা নেই। তাঁদের হিসাব আর ঋণখেলাপির আওতায় থাকবে না।
সোনালী ব্যাংকের খুলনা জোনের জেনারেল ম্যানেজার মোশারেফ হোসেন বলেন, সরকার ঋণখেলাপিদের আবার সুযোগ দেওয়ায় দুই বছরের মধ্যে তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।