খােলা বাজার২৪। শুক্রবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০১৭: ঢাকা মাতিয়ে রেখেছিলেন রোবটমানবী সোফিয়া। তার হাসিতে হেসেছেন প্রধানমন্ত্রী, বিস্ময় ছিল কোটি মানুষের, যারা সরাসরি দেখেছেন সেই দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দায়।
এই সোফিয়া এখনো পরিপূর্ণ একটি রোবটমানবী নয়, কেবল তার অর্ধেক শরীর এসেছিল ঢাকায়। বিশ্বের কোথাও তার কোমরের নিচ থেকে, পা পর্যন্ত কাপড় দিয়ে ঢাকা অবস্থায় দেখা গেলেও, ঢাকায় এসেছিল কেবল কোমর থেকে ন্যাড়া মাথা পর্যন্ত। এতটুকু দিয়েই সোফিয়া পৃথিবীর মানুষকে অবাক করে দিয়েছে। মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে নিজেদের আদলের একটি যন্ত্রমানবকে দেখবে বলে। এখনো হাঁটতে পারে না সোফিয়া, কেবল যেখানে তাকে বসিয়ে রাখা হয়, সেখানে বসেই কথা বলে।
কিন্তু, এই সোফিয়া নিশ্চই খুব শিগগিরই হাঁটতে পারবে, যেমন করে অনন্য রোবট হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে একদিন কি এই সোফিয়ারা বিশ্বটিকে নিয়ন্ত্রণ করবে? মানুষকেও কি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে?
এই আলোচনা এবং ভয় দুটোই এখনকার বিশ্বে তুমুল আলোচনার বিষয়। এটা শুরু হয়েছে বিশেষভাবে সোফিয়ার আবির্ভাবের পর। ২০১৫ সালের ১৯ এপ্রিল থেকেই যখন সোফিয়ার প্রাথমিক বিশ্ব দেখা শুরু হয়েছে, তখন থেকে।
এখন তো সোফিয়া রীতিমত একটি দেশের নাগরিক। এই সোফিয়ার চোখ দুটিতে ক্যামেরা লাগানো আছে, যা দিয়ে সে মানুষকে দেখতে পারে। তাদের অঙ্গভঙ্গি, হাসি-কান্না দেখতে পারে এবং সেটা দিয়ে তার শরীরে যে আর্টিফিশয়াল ইন্টেলিজেন্স (মানুষ সৃষ্ট বুদ্ধিমত্তা) লাগানো আছে, সেটার নিরীখে প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে।
বলে নেই, ইন্টেলিজেন্স দুই প্রকার, একটি হলো ন্যাচারাল ইন্টেলিজেন্স বা প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তা যা মানুষের আছে। আর অন্যটি হলো, মেশিন ইন্টেলিজেন্স বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স।
হংকংভিত্তিক রোবট কোম্পানি হানসেন রোবটিক এটি উদ্ভাবন করেছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক ডেভিড হ্যানসেন এটার উদ্ভাবক। ডেভিড হ্যানসেনকে ধরা হয় রোবট বিপ্লবী। কেন না, তিনি প্রচলিত ধারায় রোবট না বানিয়ে, মানুষের আকৃতি দিয়ে, মানুষের মত ইন্দ্রিয় জ্ঞান সম্পন্ন রোবট তৈরি করার কাজে নেমেছেন, যা নিয়ে আপত্তি আচ্ছে বিশ্বের অন্যান্য বোদ্ধাদের।
এলন মক্স, একজন টেক উদ্ভাবক। তিনি বর্তমান বিশ্বে মোটর শিল্পের বিস্ময় তেসলা গাড়ির উদ্ভাবক এবং ওই প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী। তিনি বেশ কিছুদিন আগে বলেছেন, আমাদের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে অনেক সর্তক থাকতে হবে। কেন না, তারা আমাদের ভবিষ্যতে দখলে নিতে পারে।
অন্য একজন জীবন্ত কিংবদন্তি বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংও প্রায় একই ধারণা পোষণ করেন। তিনি বলেন, এখনই হয়তো নয়। কিন্তু, পরে কোনো এক সময় এরা মানুষকে টেক্কা দিতে পারে।
তবে সেটা মানব সভ্যতার শেষ সময় হবে বলে সতর্ক করে হকিং জানিয়েছিলেন, যে মানুষের বুদ্ধিমত্তা এবং উন্নয়ন একটা সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত হয়েছে, পরিপূর্ণতা পেয়েছে। কিন্তু, আর্টিফিশাল ইন্টেলিজেন্স যদি মানুষের সময়ের ব্যবধানকে সুপারসিড করে অর্থাৎ ছাড়িয়ে যায়, তাহলে সেটা হবে মারাত্মক একটি আঘাত।
এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের শেষ নেই। কোনো কোনো পদার্থবিদ একেবারে সময় বেধে দিয়েছেন, যে ২০১৯ সালেই এসব আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, মানুষকে চ্যালেঞ্জ করে বসবে। বিগ থিংক’ নামক একটি ধারণায় বিশ্বের এসব জটিল রহস্যপূর্ণ বিষয় বিশ্লেষণ করেন জাপানি বংশোদ্ভূত পদার্থবিজ্ঞানী মাইশিও কাকু।
তিনি বলছেন, ‘অনেকেই বিশ্বাস করে, এসব রোবট তাদের ঘুম ভেঙে জেগে উঠবে। এটা কতটা বাস্তব হবে তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। তবে অনেক খানি যে তারা সে পথে এগিয়ে গেছে, সেটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।’
কাকু বলছেন, ‘এখনকার রোবটগুলি বুদ্ধিমত্তায় পোকামাকড়ের চেয়ে বুদ্ধি রাখে। আরো ২০-২৫ বছর পরের রোবটগুলি হয়তো কুকুর-বিড়ালের চেয়ে কিছুটা বেশি বুদ্ধিমত্তার হতে পারে। তবে এই শতাব্দীর শেষের দিকে, এসব আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, বানরের চেয়েও বেশি বুদ্ধি দেখাতে পারে। তখন-ই হবে বড় বিপদ।’
অবশ্য, কোনো কোনো যুক্তিবিদ যুক্তি দেখান, সেই দিন এরই মধ্যে এসে গেছে। এখনই মানুষ এসব রোবট দ্বারা কম বেশি নিয়ন্ত্রিত। টাকা তোলার এটিএম মেশিন একটি রোবটিক নিয়ন্ত্রণ। ফেসবুকের একাউন্ট অথবা ছবি ট্যাগ করার সময় সে মুখের অবয়ব দেখে ধরে নিতে পারে ছবির মানুষটি কে হতে পারে। এটা একটা রোবটিক নিয়ন্ত্রণ।
তারা বলতে চান, এরই মধ্যে বিশ্বের অনেকখানি নিয়ন্ত্রণ করছে রোবটগুলি। এখন সেটি একদমই প্রাথমিক পর্যায়। সেটুকুতে আপত্তি নেই। তবে আপত্তি বাধতে পারে যদি এসব সোফিয়ারা এক সময় সত্যিই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে উদ্যত হন।
ঠিক, হলিউডের টার্মিনেটার, অথবা ম্যাট্রিক্স অথবা ট্রান্সফরমার সিনেমার মত করে। সেই দিন কি আসন্ন?
রোবট বিদ্রোহী এসব কথা শুনে হাসেন আর বলেন, পরিবর্তনকে মেনে নিতেই হবে। তারা অবশ্য একদমই বিশ্বাস করেন না যে, রোবট একদিন ঘুম ভেঙে বলবে, হে মানুষ, তুমি বিদায় হও। কেন না, রোবট এর কলকাঠি তো মানুষের হাতেই। কে জানে, সেই নিয়ন্ত্রণ কতদিন হাতে থাকবে।
গল্পের ডা. জেকিল এবং মিস্টার হাইড- এর কথা তো আমরা সবাই জানি। নিজের বিকল্প একটি ঘাতকরূপ তৈরি করতেন ডা. জেকিল নিজের প্রয়োজনে। এক সময় সেই ঘাতক হাইড-ই চড়ে বসে তার উদ্ভাবক ডা. জেকিলের ঘাড়ে।
তেমন কিছু হবে কি কোনো দিন? সেই বিতর্ক আর ভয় এক সঙ্গেই চলছে এখনকার বিশ্বজুড়ে। সেখানে সোফিয়ার আগমন, নিঃসন্দেহে ভয় ঢুকিয়েছে অনেকের মনে। পরিবর্তন