Mon. May 12th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements


খোলাবাজার২৪ঃ মঙ্গলবার, ১৫মে, ২০১৮ঃ রবীন্দ্রনাথ থেকে অপরাহ উইনফ্রে, গায়ের কালো রঙের পক্ষে কম তো আর সোচ্চার হলেন না। গানে, কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে শ্যামা মেয়ের সৌন্দর্য-বন্দনাও তো কম হলো না! …দেখেছি তার কালো হরিণ চোখ। তবু এ যুগের মেয়ে আজরাকে এখনো শুনতে হয় তুমি কালো, তুমি খাটো, তুমি সুন্দর না। চোখের পানি আড়াল করে এগিয়ে যেতে হয়, ছড়াতে হয় কালোর আলো।


শাড়ি আজরার প্রিয় পোশাকদৃশ্যটা ভাবুন। একটা  বড় ফ্যাশন শো হবে। তিন মাসের প্রশিক্ষণ  হলো। দূরে দাঁড়িয়ে আয়োজক পক্ষ একটি মেয়েকে দেখিয়ে কোরিওগ্রাফার কৌশিকি নাসের তুপার সঙ্গে আলোচনা করছেন। ও কালো, ও খাটো, ওকে নেওয়া ঠিক হবে কি না? মেয়েটি পুরোটাই বুঝতে পারছেন। অতঃপর তাঁকে রাখা হলো শোতে। অহংবোধে লেগেছিল। ভেবেছিলেন শোটা করবেন না। কিন্তু এগিয়ে যেতে হবে তাই অপমান হজম করেই হেঁটেছিলেন। সেই মেয়েটাই পরবর্তীকালে শীর্ষ মডেলই শুধু হলেন না, হলেন শীর্ষ কোরিওগ্রাফারও। তিনি আজরা মাহমুদ। কিন্তু নিজের জীবনের এই গল্প বলতে গিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। বললেন, ‘আমাকে একটু কাঁদার সময় দিতে হবে, কালো আর খাটো বলে জীবনে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। এমনকি বন্ধুরা নিরুৎসাহিত করত। একজন বিশেষ বন্ধু, সেও আমার পাশে থাকেনি।’  তুপার হাত ধরেই তাঁর এই জগতে আসা। তবে তুপা শুরুতেই তাঁকে মন শক্ত করতে বলেছিলেন। বাস্তবতা বর্ণনা করে বলে দিয়েছিলেন এই এই কারণে তোমাকে বাধা পেতে হবে। তবে তোমাকে প্রস্তুত হতে হবে এবং তোমাকে দিয়েই হবে। আজরা একজন ব্রিটিশ ডিজাইনারের তৈরি খেলার পোশাক শোতে পরেছিলেন। ডিজাইনার বলেছিলেন, গ্রেট থিংস কাম ইন স্মল প্যাকেজেস। কথাটা খুব মনে ধরেছিল আজরার।

২০০৪ থেকে নিয়মিত উপস্থাপনা করেন আজরা

২০০৪ থেকে নিয়মিত উপস্থাপনা করেন আজরা২০০১ সালে ইউ গট দ্য লুক প্রতিযোগিতায় প্রথমে নাম দেননি আজরা। কারণ, নতুন করে আর অপমানিত হতে চাননি। আজরা তত দিনে জেনে গেছেন কালো মেয়েরা আর যা-ই হোক সুন্দর হয় না! কিন্তু একজন বন্ধুর উৎসাহে শেষমেশ নাম দিলেন। প্রতিযোগিতায় জিতেও গেলেন। তবুও থামে না মানুষের কথা। ‘আমি নেতিবাচক উপায়ে জিতেছি প্রতিযোগিতা, এ কথাই শুনেছি বেশি।’ ২০০১ থেকে ২০০৭। সময়টা বেশ সংগ্রাম করতে হয়েছে আজরাকে। তাঁর ভাষায়, ‘ভয়ানক জেদ চেপে গিয়েছিল। প্রচুর পড়তাম। তখন তো সাইবার ক্যাফেতে গিয়ে নেট ব্যবহার করতে হতো। বিভিন্ন শো দেখতাম। শিখতাম। ফাইভ হান্ড্রেড ইয়ার্স অব ফ্যাশন—ব্রিটিশ বইটি আমার চোখ খুলে দেয়। কী করে কথা বলতে হয়, হাঁটতে হয়, স্টাইল…এমনকি ব্যক্তিত্ব ধরে রাখাও শিখতে হয়। আপ্রাণ চেষ্টা করেছি নিজেকে তৈরি করতে। আমি জানতাম, আমার রংটা যেহেতু কালো এবং উচ্চতায় খাটো, তাই আমার লড়াই বেশি কঠিন। দ্বিগুণ পরিশ্রম করতে হবে। আজ যখন অন্য মডেলদের তৈরি করি, সেই শিক্ষা আমার কাজে লাগে। ২০০৭ থেকে ২০১৮ লাক্স চ্যানেল-আই সুপারস্টার প্রতিযোগীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছেন সেই কালো মেয়েটাই! এ লেভেল পাস করে ই-বিজনেস নিয়ে লেখাপড়া করেছেন। আজরার পছন্দের ডিজাইনার রিনা লতিফ। এই তো সেদিন রিনা লতিফের ডিজাইন-জীবনের ৩০ বছর উপলক্ষে ফ্যাশন শোর কোরিওগ্রাফার ছিলেন আজরা। তিনি মনে করেন, এটা তাঁর জীবনের ভালো কাজের একটি। বললেন, ২০০০ সালে রিনা লতিফের শোতে হাঁটতে পেরে ধন্য মনে করেছিলাম। আজ ১৮ বছর পর তাঁর শোর কোরিওগ্রাফার হতে পারার অনুভূতি অন্য রকম। নিজেকে ধরে রাখার নিজস্ব কয়েকটি কৌশল জানালেন। প্রচুর পানি পান করেন, অহেতুক রাত জাগেন না, ডাল-ভাত-ভর্তা পছন্দ, তবে ওজন ৫০ কেজির ওপরে যেতে  দেন না।

ফ্যাশন সচেতন আজরা

আত্মবিশ্বাস নিয়েই এগিয়ে যাওয়ারবীন্দ্রনাথের কৃষ্ণকলিকে গায়ের মানুষ কালো বলেই কেবল দেখেছে, এই দেখাই সমাজের দেখা। কবির চোখে কজনই-বা দেখে? সারা বিশ্বেই কালো রং নিয়ে কষ্টে আছে মানুষ, যা অন্য মানুষের অহেতুক অনর্থক সৃষ্টি। মাইকেল জ্যাকসনকেও তাই গাইতে হয়—ইট ডোন্ট ম্যাটার, ইফ ইউ আর ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট…। কিন্তু গায়ের রং তো জীবনের রং নয়। কাজ, ব্যক্তিত্ব, আত্মবিশ্বাসই সেটা প্রমাণ করে। আজরা মাহমুদ যখন দাপটের সঙ্গে বড় বড় শোয়ের কোরিওগ্রাফি করেন, মডেলদের পরিচালনা করেন, তখন সেই আত্মবিশ্বাসই যেন ফুটে ওঠে। তাই আজরাকে যখন বলি, আলাদিনের চেরাগ পেলে নিজের জন্য কী চাইতেন? গায়ের রংকে তোয়াক্কা না করে ঝটপট উত্তর, ভিসা ছাড়া পৃথিবী ঘুরব, আজীবন সুস্থ থাকব…।

ফ্যাশন সচেতন আজরা