Tue. May 13th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

 

খোলাবাজার২৪.সোমবার,০২ জুলাই, ২০১৮ঃ বিশ্বে চালের বাজারে এখন আলোচিত নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশের একটি সিদ্ধান্তের কারণে বিশ্ববাজারে চালের বড় ধরনের দরপতন হয়েছে। অথচ বাংলাদেশে চালের দাম না কমে উল্টো বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশ আমদানির ওপর ২৮ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেওয়ার তিন সপ্তাহের মধ্যে বিশ্ববাজারে চালের দাম প্রতি টনে ৩৫ ডলার কমে গেছে। এই সময়ে দেশে মোটা চালের দাম ৫ শতাংশ বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। বেড়েছে সরু চালের দামও।

এখন বিশ্ববাজারে প্রতি টন চালের দাম ৪০০ ডলারের নিচে। গত দুই বছরের মধ্যে প্রথম এমন দরপতন হলো। আবার দেশে ধান-চাল এখন প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আছে। লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে বোরো ধান উৎপাদন হয়েছে প্রায় দুই কোটি টন। আমন উৎপাদন হয়েছে প্রায় দেড় কোটি টন। চলতি মাস পর্যন্ত এক বছরে আমদানি করা হয়েছে প্রায় ৪০ লাখ টন চাল। সোয়া তিন কোটি টন চাহিদার বিপরীতে দেশে বছরজুড়ে চাল ছিল প্রায় চার কোটি টন। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ বেশি থাকার পরও দাম না কমে কেন বাড়ছে, তার কোনো সদুত্তর কারও কাছে নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেন, শুল্কমুক্ত সুবিধায় চাল আমদানি বেশি হওয়ায় কৃষক ধানের দাম পাচ্ছিল না। এমন কথা আপনারা পত্রিকায় লিখেছিলেন। কৃষক যাতে ভালো দাম পায়, সে জন্য আমরা আবারো শুল্ক আরোপ করেছি। তাই চালের দাম দু-এক টাকা বাড়তেই পারে। এতে অসুবিধা কী? কৃষক তো ভালো দাম পাচ্ছে।

কৃষক আসলে দাম পাচ্ছেন কি না, তা বোঝার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কৃষিবিষয়ক সংস্থা ইউএসডিএর গত সপ্তাহে প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করা যায়। বিশ্বে চালের উৎপাদন ও বাজার পরিস্থিতি নিয়ে করা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সরকার প্রতি কেজি ধানের সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করেছে ২৪ টাকা। কিন্তু বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি ধান ১৭ টাকা ৫০ পয়সা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২২ টাকা ৫০ পয়সা করে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ বাজারে ধানের দাম কম। আর কৃষকেরা মূলত ধানই বিক্রি করেন।

এ ব্যাপারে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ এম এম শওকত আলী বলেন, দেখতে হবে এই দাম বৃদ্ধির সুফল কৃষক পাচ্ছেন কি না। চালের দাম বাড়লে শহর ও নগরের হতদরিদ্ররা বিপদে পড়ে। তাদের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দেয়। অপুষ্টি বেড়ে যায়।

উদ্বৃত্ত থাকার পরও দেশে কেন চালের দাম বাড়ছে, জানতে চাইলে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাসকিং মিল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এ কে এম লায়েক আলী বলেন, আমদানির শুল্ক আরোপের পর ব্যবসায়ীরা চালের দাম বাড়িয়েছেন। আবার ধানের দামও একটু বেড়েছে। তাই চালের দাম সামান্য বেড়েছে। তবে গত বছর দাম যেভাবে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছিল, সেভাবে আর বাড়বে না বলে তিনি মনে করেন।

সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ২৮ জুনের বাজার দরবিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত এক সপ্তাহে মোটা চালের দাম ৫ শতাংশ বেড়েছে। গত সপ্তাহে মোটা চালের কেজি ছিল ৩৮ থেকে ৪২ টাকা। গত বৃহস্পতিবার তা ৪০ থেকে ৪৪ টাকায় পৌঁছায়। মাঝারি ও সরু চালের দামও ২ থেকে ৩ শতাংশ বেড়েছে।

বিশ্ববাজারে দাম বেড়েছিলও বাংলাদেশের কারণে
চালের দাম পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, গত বছর বন্যায় বোরোতে ফসলহানির ফলে বাংলাদেশকে চাল আমদানি করতে হয়। সরকার চালের আমদানি শুল্ক (২৮ শতাংশ) তুলে দেয়। চার বছর পর বাংলাদেশ চালের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে রপ্তানিকারকেরা চালের দাম বাড়াতে থাকে। প্রতি টন চালের দাম ৪০০ ডলার থেকে বেড়ে ৫০০ ডলারে পৌঁছায়।

বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরা ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও মিয়ানমার থেকে ৪০ লাখ টন চাল আমদানি করেন। এর মধ্যে ভারত থেকে আনা হয় ৩০ লাখ টন। দেশে বোরোর বাম্পার ফলন হওয়ায় ৬ জুন সরকার আবার চালের ওপর ২৮ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করে।

ইউএসডিএর হিসাবে, পরের দুই সপ্তাহে ভারতে চালের রপ্তানিমূল্য ৪৩০ ডলার থেকে কমতে কমতে ৩৯৪ ডলারে নেমে আসে। সবচেয়ে বড় দরপতন হয়েছে থাইল্যান্ডে। দেশটি প্রতি টন চালের দাম প্রায় ৪০ ডলার কমিয়ে দিয়েছে।

বিশ্ববাজার থেকে বাংলাদেশ চাল আমদানি কমিয়ে দেওয়ায় সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় পড়েছে ভারত। দেশটি বছরজুড়ে বাংলাদেশের কাছে এককভাবে প্রায় ৩০ লাখ টন চাল বিক্রি করেছিল। এ অর্থবছরে ভারত বিভিন্ন দেশে ১ কোটি ২০ লাখ টন চাল রপ্তানির পরিকল্পনা করেছে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ইতিমধ্যে ভারত থেকে ৪০ লাখ টন চাল আমদানির ঋণপত্র খুলেছেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তাঁরা ওই চাল আনবেন কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কারণ, দেশে চাহিদার চেয়ে বেশি চাল আছে।

এই পরিস্থিতিতে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল সম্প্রতি চীন সফর করেছে। ৯ জুন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের আলোচনার প্রধান বিষয় ছিল চাল। চীনকে এ বছর ৭০ লাখ টন চাল আমদানি করতে হবে। চীনের এই চাহিদাকে কাজে লাগিয়ে চাল রপ্তানি করতে চায় ভারত।

বাংলাদেশে চালের দাম না কমার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সম্মানিত ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম বলেন, চালের বাজার ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিন ধরে গলদ চলছে। বাজারে সরকারের তদারকি নেই। চালের দাম বাড়লে সোয়া কোটি হতদরিদ্র মানুষ বড় বিপদে পড়বে। ফলে চালের দামে যাতে কোনো কারসাজি না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে সরকারকেই।