Tue. Apr 22nd, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements


খোলা বাজার ২৪ সোমবার ,০৮ অক্টোবর ২০১৮: ব্যাংকের কাজ কী? ঋণ বিক্রি করে এর মালিকদের জন্য অর্থ উপার্জন করা। লেনদেনে যখন থেকে কাগুজে মুদ্রা চালু হলো তখন থেকে ব্যাংকের ঋণের ব্যবসাও জোরদার হতে লাগল। তখন থেকে মানি বা অর্থ ভিন্ন ভিন্ন রূপ গ্রহণ করেছে। তবু কাগুজে মুদ্রাটা এখনো লেনদেনের মুখ্য বাহন। লেনদেন মেটানোর প্রক্রিয়া বা অর্থের মাধ্যমে আয়-ব্যয়ের ধরনটা পাল্টে এখন তা অনেক দ্রুত হয়ে গেছে। আর লেনদেন বা দেনা-পাওনা মেটানোর কাজটা অতি দ্রুত করার জন্য অনেক লোকই অনেক দিন থেকে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিল। দেনা-পাওনা মেটানোর ক্ষেত্রে ডিজিটাল টেকনোলজি একটা বিপ্লব এনেছে। সামনে অবস্থাটা এমনও হতে পারে, আমরা মানি বা অর্থ বলতে আজকে যে কাগজের কিছু নোটকে বুঝি, এর অবস্থান জিরোতে হতে পারে। অর্থাৎ কাগুজে মুদ্রা বলতে কিছু থাকবে না। মানি বা অর্থ হয়ে পড়বে কতগুলো হিসাবের ডিজিটাল ইউনিটস। আর লেনদেন হয়ে যাবে কিছু ডিজিটাল হাতিয়ার ব্যবহারের মাধ্যমে শুধু ডেবিট-ক্রেডিটের বিষয়। যাক, তবু অর্থ বলতে কিছু একটা থাকবে, সেটা যে রূপেই ঘোষণা করা হোক। কারণ হলো, অর্থ (Money) শুধু লেনদেনের মাধ্যম নয়, এটা সম্পদ ধারণের একটি হাতিয়ার।

মানি বা অর্থের মূল্য আছে বলে এটা Store of Value বা সম্পদ ধারণের বাহন হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। অর্থাৎ ব্যক্তি অন্য সম্পদ যেমন ধারণ করে বা হিসাবের খাতায় লিপিবদ্ধ করে, তেমনি মানি বা অর্থও একটা সম্পদ হিসেবে ব্যক্তি ধারণ করে। এই যে অনেক লোককে বিলিয়নেয়ার বলা হচ্ছে, ওই সব বিলিয়নেয়ারের সব অর্থ কি কাগুজে মুদ্রায় ধারণকৃত? না, তারা অ্যাসেট ক্লাস (Asset class) তালাশ করে, যার মধ্যে রিয়েল এস্টেট, স্টক-বন্ড-সোনা-ইউরো-ডলার বা আস্ত কোনো ব্যবসার পূর্ণ মালিকানাও হতে পারে। ভালো সম্পদের বৈশিষ্ট্য হলো, ওইগুলো সহজে নগদায়নযোগ্য বা এক সম্পদ থেকে অন্য সম্পদে স্থানান্তরযোগ্য। লোকদের সম্পদ পাইয়ে দিতে অনেক ধরনের মধ্যস্থতাকারী কাজ করে। এদের মধ্যে ব্যাংক হলো অন্যতম। অন্য এজেন্টগুলো হলো স্টক ব্রোকার অ্যাকাউন্ট্যান্ট আইনবিদ, ট্যাক্স লইয়ার, কাস্টডিয়ান বা পাহারদার ইত্যাদি। ব্যাংক লেনদেনে গতি আনে। ব্যাংক উদ্বৃত্ত অর্থ এক শ্রেণির লোকদের থেকে কিছু মূল্য দিয়ে সংগ্রহ করে, আর সেই মূল্য থেকে একটু বাড়তি মূল্য নিয়ে অন্যকে সে অর্থ ঋণ দেয়। এই অর্থ বেচাকেনার মূল্যকে বলা হয় সুদ (interest)। ব্যাংক সুদে অর্থ নেয়, আবার সুদে অর্থ ধার দেয়। তবে অনেকের কাছে সুদ বিষয়টি মূল্য হিসেবে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই তারা ব্যাংককে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ব্যবহার করে লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে অর্থের ব্যবহার করতে চায়। এতে তাদের ঝুঁকি বেড়ে যায়। লাভও বেশি হতে পারে, একেবারে কোনো লাভ না-ও আসতে পারে। লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে অর্থ ব্যবহারের মডেলকে দেশে দেশে ইসলামিক ব্যাংকিং বা ইসলামিক ফিন্যান্সিং বলে আখ্যায়িত করা হয়। আসলে লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে ব্যাংকিং করার ধারণাটা যদিও মুসলমানরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে গ্রহণ করেছে, এ ধরনের ব্যাংকিং অন্যরাও করতে পারে। অনেকে বলে, সুদ ভালো নয়। নির্যাতনের আর শোষণের হাতিয়ার। আর আমাদের ধর্মবিশ্বাস বলে, সুদের লেনদেন অর্থ বা আয়কে বাড়ায় না, বরং ঝুঁকি নিয়ে অর্থ রোজগার আমাদের ধর্মবিশ্বাস সমর্থন দেয়। এবং অর্থপ্রবাহের একটা অংশকে দান করতে বলে যদি দান নেওয়ার মতো কেউ থাকে।

যাক, সুদের ভিত্তিতে ব্যাংকিং বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। এবং সুদ ঋণ করার ক্ষেত্রে মূল্য হিসাবে থেকেই যাবে। তবে ব্যাংকিং ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে। সুদের হারও পরিবর্তন হবে। এই প্রাইজ বা মূল্য এমনও হতে পারে যে শূন্যের কোঠায় চলে আসবে। এমনও হতে পারে, অর্থনীতিতে সুদের ব্যবহার উঠে যাবে। লোকজন ব্যাংকে বা অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে অর্থ রাখে লেনদেনের বা নিরাপত্তাজনিত সুবিধার কারণে। কোনো রকমের সুদ নামের লাভের জন্য নয়। তবে ব্যাংক সেই অর্থ অন্যকে দিতে গেলে একটা মূল্য অবশ্যই আদায় করবে। সেই মূল্যের নাম সুদও হতে পারে আর সার্ভিস চার্জ বলে কিছু হতে পারে। ডিজিটাইজেশনের যুগেও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান বলে কিছু থেকে যাবে, যারা মুদ্রা বেচাকেনা বা ঋণ নেওয়া-দেওয়ার দোকান খুলে বসে থাকবে। অবশ্য এখন যে সনাতনি ব্যাংক দেখছি, এগুলো না-ও থাকতে পারে। তবে ব্যাংক এর অস্তিত্ব ভিন্নভাবে হলেও বজায় রাখবে।

ব্যাংক ব্যবসা ব্যর্থ হয় কেন? কেন ব্যাংক বন্ধ হয়ে যায়? ঠিক অন্য ব্যবসার মতো, অন্য ব্যবসা যে কারণে বন্ধ হয় ব্যাংক ব্যবসাও সেই কারণে বন্ধ হয়ে যায়। অন্য ব্যবসা বন্ধ হয় লাভ না করতে পারলে। একসময় যখন মূলধনে টান পড়ে তখন যেটুকু আছে সেটুকু বেচে মালিক ব্যবসা বন্ধ করে দেয়। একই ব্যবসায় একজন যেমন সফল হয়, অন্যজন সফল হয় না। ব্যাংকের অবস্থাও তাই। এক ব্যাংক সফল হয়, তো অন্য ব্যাংক হয় না। তবে ব্যাংক যেহেতু অন্যদের থেকে অর্থ নিয়ে ব্যাংকিং ব্যবসা করে, সে জন্য ব্যাংক ব্যবসা যথেষ্ট রেগুলেটেড বা তদারকীকৃত। সাধারণ তদারকের উদ্দেশ্যে স্থাপিত কোনো কর্তৃপক্ষ ব্যাংক ব্যবসাকে তদারকি করে। বাংলাদেশে সেই কর্তৃপক্ষ হলো বাংলাদেশ ব্যাংক। আজকাল কোনো প্রাইভেট ব্যাংকই নিজে মুদ্রা ইস্যু করে না। তবে তারা কিছু ঋণপত্র ইস্যু করতে পারে অন্যদের থেকে ঋণ নেওয়ার উদ্দেশ্যে। দেশে দেশে মুদ্রা ইস্যু করার বিষয়টাকে এককভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। ব্যাংক ব্যবসা ফেল করে যখন ব্যাংক ঋণ দিয়ে ঋণ আদায় করতে পারে না। খুব কম ব্যাংকই ফেল করেছে ডিপোজিটরদের উচ্চ সুদ দেওয়ার কারণে বা প্রশাসনিক ব্যয় বেশি বলে। ঋণের ব্যবসা করা একটা ঝুঁকিপূর্ণ পুঁজি। ঋণ আদায় করতে না পারলে ব্যাংকে লালবাতি জ্বলবে। একসময় ব্যাংক শেয়ারবাজার, পণ্যবাজার ও মুদ্রাবাজারে বিনিয়োগ করতে পারত। দেখা গেছে, ওই কাজ করতে গিয়ে অনেক ব্যাংক ফেল করছে। তখন আইন করে ব্যাংকের জন্য ওই সব ব্যবসাকে বন্ধ করে দেওয়া হলো।

বাংলাদেশেও ব্যাংক ইচ্ছা করলে শেয়ারবাজার, পণ্যবাজার, স্বর্ণবাজার, মুদ্রাবাজারে ডিপোজিটরদের অর্থকে পাঠাতে পারে না, আইন বা রেগুলেশন জারি করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে ঋণের ব্যবসাটা ব্যাংকের জন্য একেবারে খোলা। বাংলাদেশ ব্যাংক জনস্বার্থে ঋণের ধরন ও গুণ পরীক্ষা করে মাত্র। কিন্তু ব্যাংক বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফেল করে যারা ব্যাংক চালায় তাদের ব্যর্থতার কারণে অথবা তাদের অসততার কারণে। ঋণ দেওয়ার ব্যবসা করতে গিয়ে যদি ব্যাংকের কর্মকর্তারা প্রতিটি ডিলে নিজের জন্য কিছু উপকার খোঁজেন, তাহলে সেই ঋণ তো মন্দ ঋণ হবেই। মন্দ ঋণ আর কোনো দিনই ব্যাংকে ফেরত আসে না। মামলা করে করে যতটা আদায় করা যায় ততটাই পাওয়া যায়। একটা ব্যাংকের পোর্টফোলিও যদি মন্দ ঋণে ভর্তি থাকে, তাহলে সেই ব্যাংকে লালবাতি জ্বলবে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি যেন আলাদা। এখানে সরকার সহজে কোনো ব্যাংককে লালবাতি জ্বলতে দেয় না। দৌড়ে আসে ওই ব্যর্থ ব্যাংককে নতুন করে মূলধন দিয়ে তার ঘাটতি পূরণ করার জন্য। ব্যাংক ব্যবসার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চিত্রটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে সত্ভাবে ব্যবসা করতে গিয়ে কোনো ব্যাংক ব্যর্থ হয়নি। ব্যাংক ব্যর্থ হয়েছে ম্যানেজমেন্ট ব্যাংককে লুট করতে দিয়েছে বলে। কোনো কোনো ব্যাংক যে লুট হচ্ছে সে ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমে বিস্তর প্রতিবেদন হয়েছে। কিন্তু ওই সব লুটপাট থামানোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকও কিছু করেনি, সরকারও কিছু করেনি। যখন ব্যাংকে নীরবতা নেমে এসেছে তখন সরকার বলল, আরে এই কী করে হলো, জনস্বার্থে তো ব্যাংককে বসে যেতে দিতে পারি না। শুরু হলো নতুন করে মূলধন জোগানো। কখনো সরাসরি বাজেটারি প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে, কখনো অন্য সরকারি ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করে লুট হয়ে যাওয়া ব্যাংকে নতুন করে কথিত মূলধনের জোগান দেওয়া হলো। এতে অনেক বাদ-প্রতিবাদ হয়েছে; কিন্তু সরকার অর্থ জোগানোর ওই অনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে সরে আসেনি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হলো কারা? সেই জনগণই, যাদের স্বার্থ রক্ষা করার জন্য সরকার শপথ নিয়েছে!

যা হোক, কোনো ব্যাংকই আপনা-আপনি ব্যর্থ হতে পারে না। ব্যর্থ হয় তখনই যখন টপ ম্যানেজমেন্ট আকণ্ঠ দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়। টপ ম্যানেজমেন্ট যদি নিজ ব্যাংককে লুট হতে দেয়, তাহলে সেই ব্যাংক কেউ রক্ষা করতে পারবে না। সাধারণ নিয়মে বাংলাদেশে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। যারা ব্যাংক লুট করছে বা যারা তা করতে দিচ্ছে, তাদের জবাবদিহির মধ্যে আনা হয়নি বলেই ব্যাংকের মাধ্যমে সম্পদ চুরি করার দৌড়টা আরো গতি পেয়েছে। বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাতে জ্ঞানের ঘাটতি আছে, এটা বলব না। তবে সততার অবশ্যই ঘাটতি আছে। ব্যাংককে কেন মানুষ বিশ্বাস করে? সততা ও দক্ষতা দেখলে মানুষ সেই ব্যাংককে বিশ্বাস করবে। বিশ্বাসী ব্যাংকে লোকে অল্প সুদেও অর্থ ডিপোজিট রাখে। আমরা জানি না, জনগণের অর্থ দিয়ে আর কত দিন সরকার লুটেরাদের লুটকে পরোক্ষভাবে অর্থায়ন করে যাবে!

লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়