Wed. Aug 27th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

খােলাবাজার২৪, শুক্রবার, ১৯র্মাচ ২০২১ঃ বাংলাদেশে প্রথম ম্যাথ ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয় ২০০৫ সালে। তখন মনে করা হতো এদেশের ছেলেমেয়েরা আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় একটি গাণিতিক সমস্যাও সমাধান করতে পারবে না। যদিও ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদ সবসময়ই আমাদের ছেলেমেয়েদের নিয়ে আশাবাদী ছিলেন। প্রতিযোগিতায় স্বর্ণ জেতার স্বপ্নও তারা দেখেছেন সেই শুরু থেকেই।

সময় বদলেছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা আজ অনেক আত্মবিশ্বাসী। পূর্ববর্তী দলের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে নতুন দল এখন ক্যাম্পে আসে। অথচ আগে ওদের মধ্যে এক ধরনের ভয় ছিল আমরা কি পারব? সেই ওরাই এখন দৃঢ়স্বরে বলে— আমরাই পারব। বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়া কিশোর-তরুণদের উৎসাহ-উদ্দীপনাই আমাকে এ-কাজে আরো বেশি আকৃষ্ট ও আশান্বিত করেছে।

আমি বেড়ে উঠেছি যুক্তরাষ্ট্রে। সেই শৈশবেই আমার বাবা আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন এমআইটি একটা সুন্দর জায়গা, তুমি এখানেই পড়বে। এ-ছাড়াও তার অনুপ্র্রেরণায় আমি গণিতের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম। এভাবে প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে নিতেই একসময় গণিতের প্রকৃত আনন্দটা পেলাম। আমার জীবনের একটা বড় অংশ জুড়েই আছে গণিত, যার কল্যাণেই এমআইটি-র মতো বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া আমার জন্যে সহজ হয়েছিল।

২০০৫ সালে আমি এই ভেবে বাংলাদেশে এসেছিলাম যে, এখানে আমি নিভৃতে বসে নিজের গবেষণার কাজগুলো করতে পারব। মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যার আমাকে ছোটবেলা থেকেই চিনতেন। সেই সূত্রেই বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াডের সাথে আমার যুক্ত হওয়া। কারণ যিনি শিক্ষকতা করতে ভালবাসেন, তিনি সবসময় এমন মানুষদের সাথে থাকতে পছন্দ করেন, যারা নতুন কিছু জানতে ও শিখতে আগ্রহী।

শুরুর দিকে গণিত অলিম্পিয়াডকে কেন্দ্র করে আমার প্রচণ্ড ব্যস্ত সময় কাটত। আমি ম্যাথ ক্যাম্পে শিক্ষার্থীদের সাথে থাকতাম, প্রচুর ক্লাস নিতে হতো, অনেক সময় আমার বাসাতেও আসত শিক্ষার্থীরা।

আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নেয়া পুরনো শিক্ষার্থীরাও এখন ক্লাস নিচ্ছে নতুনদের। আমাদের গণিত অলিম্পিয়াডে কোনো সিনিয়র-জুনিয়র বিভেদ নেই। সিনিয়ররা যেমন জুনিয়র দলকে শেখাচ্ছে তেমনি জুনিয়রদের কাছ থেকেও কখনো কখনো শিখছে সিনিয়ররা। ভেদাভেদ শেখার পরিবেশকে নষ্ট করে। আমাদের ম্যাথ ক্যাম্পে শেখার মানসিকতা ও পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে প্রতিযোগীরা এগিয়ে যাচ্ছে।

আন্তর্জাতিক গণিত অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের স্বর্ণপদক জয় আমাদের জন্যে জাতিগতভাবে একটি আনন্দের বিষয়। এখন প্রশ্ন হতে পারে শুধু কি এই আনন্দটুকুই? এ-ছাড়া জাতির কি কোনো লাভ নেই এতে? ধরুন, ব্রাজিল গণিত অলিম্পিয়াডে স্বর্ণপদক জিতে গেল। এতে কি তাদের জিডিপি বেড়েছে? তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেছে? সত্যিই সেটা ঘটেছে। দেশটি এগিয়ে গেছে। কারণ এ ধরনের স্বীকৃতিগুলো জাতিকে আরো উদ্যমী করে তোলে। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা যখন এই কিশোরদের সাফল্য দেখে, তখন তাদের মনেও বিশ্বাস জাগে— আমরাও পারব। তরুণদের এ বিশ্বাসই সমাজের সার্বিক কল্যাণ বয়ে আনে।

তবে উন্নত দেশের ছেলেমেয়েদের প্রশিক্ষণের জন্যে রয়েছে নানা সুযোগ-সুবিধা আর আধুনিক অবকাঠামো। অন্যদিকে আমাদের শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শুধু মেধা ও চেষ্টার জোরেই ভালো করছে। গাছ তো প্রাকৃতিকভাবেই বেড়ে ওঠে, কিন্তু পরিপূর্ণ বিকাশের জন্যে প্রয়োজন একটু পানি ও সার দেয়া। তেমনি আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্যেও চাই সঠিক পথ-নির্দেশনা, যথাযথ পরিচর্যা ও সুস্থ পরিবেশ। আর এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করার দায়িত্ব আমাদেরই।

আরেকটি বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে অভিভাবকদের। তা হলো আপনার সন্তানের বন্ধু কে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এ যুগে মা-বাবা কী বলছেন, তার চেয়েও শিশু-কিশোরদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তার বন্ধুরা কী বলছে। গণিত ভয় পায় বা শেখার আগ্রহ নেই, এমন বন্ধুর সাথে মিশলে আপনার সন্তানও তেমনটাই হবে। আবার আপনার ছেলেমেয়ে যদি এমন কারো সাথে বন্ধুত্ব করে, যে গণিত ভালবাসে তাহলে আপনার সন্তানেরও গণিতের ভয় দূর হবে। তাই আপনি তাকে স্কুলের গণিত ক্লাব বা এরকম ভালো কিছু কাজে উদ্বুদ্ধ করুন।

ভালো ছেলেমেয়েদের সাথে মিশলে আপনার সন্তান স্বাভাবিকভাবেই ভালো থাকবে। আবার তার বন্ধু যদি ভিডিও গেম খেলে, তাহলে সে-ও সেদিকেই যাবে। ভিডিও গেম কিন্তু ভীষণ আসক্তিকর। তাই অভিভাবকদের বলতে চাই, সন্তানের বন্ধুমহল সম্পর্কে সচেতন হোন।

শিক্ষার্থীকে যোগ্য করে তোলার জন্যে ভালো ক্লাসরুম-কম্পিউটারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষকের আন্তরিকতা। এ-ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ অনেক বড় ভূমিকা পালন করতে পারেন। যদি তারা শিক্ষকদের আন্তরিক হওয়ার ওপর জোর দেন, তবে একজন সাধারণ শিক্ষকও ভালো মানের শিক্ষকে রূপান্তরিত হবেন। আর একজন ভালো শিক্ষক হয়ে উঠবেন অসাধারণ।

গণিত অলিম্পিয়াডের উদ্দেশ্য শুধু স্বর্ণপদক জেতা নয়; বরং মানুষকে গণিত ও প্রযুক্তিজ্ঞানে আগ্রহী করে তোলা। দেশের ১০ জন শিক্ষার্থী আন্তর্জাতিকভাবে ভালো ফলাফল করার অর্থ হচ্ছে এদেশে এমন আরো হাজার মানুষ আছে, যারা ভালো করার সামর্থ্য রাখে। গণিত অলিম্পিয়াডের লক্ষ্য হচ্ছে এমন কিছু মানুষ গড়া, যারা আগামী ২০ বছরে দেশের সমৃদ্ধিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখবে।

১৬ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। আমরা এদের মধ্য থেকে ছয় জনের একটি দল কেন গঠন করতে পারব না যারা গণিত অলিম্পিয়াডে প্রথম হতে পারে? একজন মানুষ বা একটি জাতি তখনই পারে, যখন তাদের সামনে থাকে সুস্পষ্ট লক্ষ্য ও প্রত্যাশা। আর শিক্ষা ও পরিশ্রম দ্বারা যে-কোনো মানুষের পক্ষে যে-কোনো প্রত্যাশাই পূরণ করা সম্ভব।
লেখক : বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কোচ