Fri. May 9th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন: বাংলাদেশের দ্বিতীয় রেনেসাঁ-ড. আবদুল ওয়াদুদ

৪৩ বছর আগে দেশে ফিরেছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা। সেদিন তিনি আপন আলয়ে ফিরতে দ্বিতীয়বার ভাবেননি। আপনজন চিরতরে হারিয়ে গেছে, সামনে চলার পথ কণ্টকময় হতে পারে, আঁধার নেমে আসতে পারে- তাতে কি! সব ভয়, সংশয়, আশঙ্কা ভুলে- মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে, দেশে এসেছিলেন বঙ্গকন্যা। 

বঙ্গবন্ধু হত্যার পর টানা কয়েক বছর জাতি হতাশায় আকণ্ঠ নিমজ্জিত ছিল। জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা যখন ভূলুণ্ঠিত, ভস্মীভূত, তখন সেখান থেকে ফিনিক্স পাখির মত শেখ হাসিনা বাংলার বুকে নব রেনেসাঁর সূত্রপাত করেন। দিনটি ছিল ১৭ মে ১৯৮১ খ্রিস্টাব্দ, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৩৮৮ বঙ্গাব্দ, রবিবার। রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতায় তখন খুনী মোশতাকের সহচর জেনারেল জিয়া। তার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে জননেত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর রক্তস্নাত মাতৃভূমিতে ফেরার দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবিযদিও ইতিপূর্বেই তিনি ১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় কাউন্সিলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার, বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় ৪ নেতা হত্যার বিচার, স্বৈরতন্ত্রের চির অবসান ঘটিয়ে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভাপতির সুকঠিন দায়িত্বভার গ্রহণ করেন শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর ১৯৭২ সালের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের পর সমসাময়িক রাজনীতিতে এ ধরনের ঘটনা ছিল নজিরবিহীন।

কী হতো তিনি দেশে না ফিরলে?  

বর্তমান বাংলাদেশের উন্নয়ন, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অগ্রগতির কী হতো তা সহজেই অনুমেয় ও এক গবেষণার বিষয়। পঁচাত্তর পরবর্তী জাতির ক্রান্তিলগ্নে, বঙ্গবন্ধুহীন বাংলাদেশে, স্বজন হারিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে ‘একলা চলো নীতির’ সূচনা করেছিলেন তা সত্যিই ছিল ইস্পাত কঠিন।

বেদনার তরী বেয়ে দেশে ফেরা শেখ হাসিনা আজ বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এবং নন্দিত রাষ্ট্রনায়ক। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতার বরপুত্র এবং অভ্যুদ্বয়ের ইতিহাসের মহানায়ক, তেমনি গণতন্ত্রের মানসকন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জননেত্রী শেখ হাসিনাও দীর্ঘকাল গণমানুষের মর্মস্পর্শী নেত্রী এবং মহিমান্বিত রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে কালের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে মহাকালকে স্পর্শ করতে সক্ষম হয়েছেন।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

শেখ হাসিনার ‘সুখ-দুঃখ জগতের বৃহৎ ব্যাপারের সঙ্গে বদ্ধ’, কারণ তিনি বঙ্গবন্ধু-কন্যা। অন্যদিকে বিশ্বকবির ভাবনাসূত্রে বলা যায়, শেখ হাসিনাকে কেবল ব্যক্তিবিশেষ বলে নয়, বরং মহাকালের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গস্বরূপ দেখতে হলে, দূরে দাঁড়াতে হয়, অতীতের বেলাভূমিতে তাকে স্থাপন করতে হয়, তিনি যে সুবিস্তৃত রাজনৈতিক অঙ্গণে প্রায় অর্ধশতাব্দীব্যাপী বাতিঘর হয়ে স্বমহিমায় প্রজ্জ্বলিত, সেই সৌকর্যসহ তাকে অবলোকন, বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ণ করা অপরিহার্য। তিনি মানুষের সামগ্রিক উত্তরণের আকাঙ্খার চিত্রনাট্যের রূপকার। তার মগ্ন চৈতন্য কখনো দুর্মর স্বপ্ন আর সংগ্রামে হয় আন্দোলিত, কখনো নিমজ্জিত হন অতল নৈঃসঙ্গ্য-অর্ণবে, কখনো সিক্ত হন প্রেমসলিলে, আবার কখনো বা সাহসে-দ্রোহে হয়ে ওঠেন রক্তমুখী দুর্বার সৈনিক।

সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ১৯৮১ থেকে ২০২৩ এই ৪৩  বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় শেখ হাসিনা বাংলাদেশের গণমানুষ তথা দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছের মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। অথচ ১৭ মে তাঁর দেশে ফেরা ছিল অতি অনাড়ম্বর। সেদিনে তিনি অসীম শূন্যতা এবং সব হারানোর হাহাকার নিয়ে ফিরেছিলেন বাংলার মায়াবী মৃত্তিকায়। এদেশে তাঁর ঘর নেই, ঘরের আপনজনও কেউ নেই। তাই বাংলাদেশেৱ মানুষই হয়ে উঠল তার পরম সুহৃদ। তিনি ফিরে আসার পূর্বে ৬ বছর স্বৈর-শাসকেরা প্রোপাগান্ডা চালিয়েছিল যে তারাই জনগণের মুক্তিদাতা। কিন্তু সাধারণ মানুষের কন্ঠে ক্ষণে ক্ষণে বেজেছিল বিপ্লবের বিউগল, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের বিচারের দাবী ছিল তাদের ঐকান্তিক প্রত্যাশা।

সামরিক শাসকের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকায় জনগণের সুশাসনের দাবি নিয়ে তিনি রাজনীতির মাঠে এক অকুতোভয় অক্লান্ত কর্মী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি নেতা, কিন্তু তারও অধিক কর্মী। কারণ দলকে ঐক্যবদ্ধ করা, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর শাসনকাল সম্পর্কে অপপ্রচারের সমুচিত জবাব দেওয়া, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করা হয়ে উঠল তার জীবনের চরম ব্রত। দেশে ফেরার প্রতিক্রিয়ার আবেগ আপ্লুত বর্ণনা আছে তাঁর নিজের লেখা গ্রন্থগুলোতে।

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পূর্বে ৫ মে বিশ্বখ্যাত নিউজউইক পত্রিকায় বক্স আইটেমে তাঁর সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, জীবনের ঝুঁকি আছে এটা জেনেও তিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চের সামরিক শাসন জারির দুইদিন পর স্বাধীনতা দিবসে একমাত্র শেখ হাসিনাই সাভার স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলেন, বলেছিলেন, “আমি সামরিক শাসন মানি না, মানবো না, বাংলাদেশে সংসদীয় ধারার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবোই করবো।”

বাংলাদেশের প্রতীক হিসেবে জননেত্রী শেখ হাসিনা জনগণের কাছে আজ নন্দিত। তাঁর প্রত্যাবর্তন আজও শেষ হয়নি।

শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বেই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়েছে বহুল প্রতিক্ষীত সীমান্ত চুক্তি। সমুদ্রসীমা জয়, বিশ্বব্যাংককে চ্যালেঞ্জ করে পদ্মাসেতু নির্মাণ, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশে রূপান্তরের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং শতবর্ষী ডেল্টা প্ল্যান, তার হিরন্ময় সাফল্যের প্রসাধিত প্রভা। সফলভাবে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ফোর্বস ম্যাগাজিন এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম শেখ হাসিনার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।

অমর্ত্য সেন বলেছেন, “শেখ হাসিনার নেতৃত্বই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিবর্তনের মূল কারণ।”

গার্ডিয়ান পত্রিকায় রোহিঙ্গা ইস্যুতে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যে মহানুভবতার পরিচয় দিয়েছেন তা বিরল। এমডিজি ও এসডিজি অর্জনে জাতিসংঘ পুরস্কার পেয়েছে বাংলাদেশ। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচী (ইউএনইপি) লিডারশিপ ক্যাটাগরিতে ২০১৫ সালে শেখ হাসিনাকে তাদের সর্বোচ্চ পুরস্কার, চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ পুরস্কারে ভূষিত করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবিকরোনাকালীন দূর্যোগেও অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ৪৫ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ, মেট্রোরেল, পায়রা সমুদ্র বন্দর, কর্ণফুলী টানেল, পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রভৃতি তার সাফল্যের মুকুটকে করেছে আরো সমৃদ্ধ এবং সুষমামন্ডিত।

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হোসে ম্যানুয়েল সন্তোষ শেখ হাসিনাকে ‘বিশ্ব মানবতার বিবেক’ এবং আরেক নোবেল জয়ী কৈলাস সত্যার্থী তাকে ‘বিশ্ব মানবতার আলোকবর্তিকা হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তুরস্কের প্রেসিডন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান তাকে অভিহিত করেন বিরল মানবতাবাদী নেতা হিসেবে। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের বিচার, জাতীয় ৪ নেতা এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করার মত ঘটনা প্রবাহ শেখ হাসিনাকে ইতিহাসের মণিকোঠায় গৌরবমন্ডিত আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।

শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর রক্তের উত্তরাধিকার এবং আদর্শের সুযোগ্য অনুসারী। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে  আজ গোটা বিশ্বে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল। তার গতিশীল নেতৃত্বে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে। ৪৩ বছর পূর্বে দেশে ফিরে এমন বাংলাদেশের স্বপ্নের মশাল প্রজ্জ্বলিত করেছিলেন শেখ হাসিনা- যেখানে স্বাধীনতা এখন ভয় শূন্য, চিত্ত এখন মুক্ত। বাংলাদেশের গায়ে তলাবিহীন ঝুড়ির তকমা লাগানো দেশগুলিই এখন ঢাকঢোল পিটিয়ে বলছে- “বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের বিস্ময়, সব দেশের কাছেই অনুকরণীয় এক রোল মডেল”।

শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন পরবর্তী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় স্বৈরশাসক এরশাদের পতন হয়, বিএনপি জামায়াতের মুখোশ উন্মোচিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রূদ্ধদ্বার হয় উন্মোচিত। নানা চড়াই-উৎড়াই ও ষড়যন্ত্রের কন্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথ অতিক্রম করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দরবারে স্বমহিমায় মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো অমিত সম্ভাবনার উদীয়মান এক অর্থনীতি। বঙ্গবন্ধু কন্যার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সবচেয়ে বড় সার্থকতা এখানেই।

প্রতিশ্রুতি পালন এবং অভীষ্ঠ লক্ষ্য অর্জনে তিনি সর্বদা নিবেদিতপ্রাণ। শেখ হাসিনার অন্তর্লোকে সর্বদাই ধ্বনিত হয় এক নৈর্ব্যক্তিক আর্তনাদ, কান পাতলেই শোনা যায় বাঙালির জন্য তীব্র নীরব অশ্রুপাতধ্বনি। পার্থিব নিরাসক্তিতে তিনি অনায়াসে প্রবেশ করেন সাধারণ মানুষের মনোলোকে এবং সেখান থেকে তুলে আনেন মানুষের অসহনীয় যন্ত্রণাপাথর। এই নৈর্ব্যক্তিকতা এবং সপ্রাণ সারল্যই তাকে কালোত্তীর্ণ মহিমায় মহিমান্বিত করেছে গণমানুষের শ্রদ্ধার সৌধে।

লেখক: ড.আব্দুল ওয়াদুদ, ফিকামলি তত্ত্বের জনক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, প্রেসিডিয়াম সদস্য- বঙ্গবন্ধু পরিষদ।