॥ তসলিমা নাসরিন ॥
খোলা বাজার২৪ ॥ সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫
মনে আছে এ বছরের জুনে ‘ইতুর কথা’ শুনিয়েছিলাম আপনাদের? ওর ফেসবুক আইডি মৌলবাদীদের রিপোর্টের কারণে ডিজেবল হয়ে গিয়েছিল। সেই মেয়েটি এখন আর দেশে নেই। জীবন বাঁচাতে দেশ থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। বাবা মা আত্মীয় স্বজন ছাড়া অল্প বয়সী একটি মেয়ে কোথায় কীভাবে থাকবে, কোন দেশে? বাবা-মা চান মেয়ে যেখানেই থাকুক, অন্তত বেঁচে থাকুক। ইতু আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতো ছিল না। যা কিছু মেনে নিতে বললেই ইতু মেনে নিতো না, প্রশ্ন করতো। ওই প্রশ্ন করাটাই ওর কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র চলছিল। আত্মগোপন করে ছিল অনেকদিন, তারপর দেশ ছেড়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে আত্মীয়স্বজন ছেড়ে ও চলে গেছে। প্রতিভাবান একটি মেয়ের সামনে এখন এক-জীবন অনিশ্চয়তা। ইতুর কথা আজ না হয় আবার শুনি।
‘প্রায় দু’মাস আগে আমি প্রথম বুঝতে পারি আমাকে ফলো করা হচ্ছে। খুব ভোরে, সকাল সাড়ে ছ’টায় আমি কলেজে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হতাম,নির্দিষ্ট স্থানে আমার কলেজ বাসের জন্য অপেক্ষা করতাম। প্রায় দু’মাস আগে,একদিন আমি লক্ষ্য করলাম একজন লোক বেশ কয়েকদিন ধরে আমি যেখানে বাসের জন্য অপেক্ষা করি,তার পাশে মুখে হাত দিয়ে গৌতম বুদ্ধের ন্যায় মৌন ভাব ধারণ করে দাঁড়িয়ে থাকে এবং আমার দিকে লক্ষ্য রাখে। আমার বাস চলে এলে সেই ব্যক্তি মৌন ভাব ভঙ্গ করে হাঁটতে শুরু করে। সে যেমন আমাকে লক্ষ্য রাখছিল আমিও তার কর্মকা- পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছিলাম।
একদিন দেখি ওই ব্যক্তি একা নয়, তার সাথে আরও দু’জন যারা আমার আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে এবং আমাকে আড়চোখে লক্ষ্য রাখে। আর প্রথম ব্যক্তি হাঁটলে অন্য দু’জনও তার পিছনে পিছনে হাঁটে। এরপর আমার কলেজ রোজার কারণে সময় বদল করলে তাদেরকে আর দেখিনি। রোজার ছুটি শেষ হলে আমি আবার কলেজে যাতায়াত শুরু করি। পরে কলেজে যাতায়তের জন্য অন্য পš’া অবলম্বন করি। এরপর আমার বাসার আশেপাশে কিছু অচেনা লোকের আনাগোনা দেখতে পাই। যেহেতু এসব নিয়ে ভেবে আমি কিছুই করতে পারব না,রাষ্ট্র যেহেতু খুনিদের পক্ষে,কাজেই আমি এসব চিন্তা বাদ দিয়ে আমার কাজে মনোযোগি হই।
নীল হত্যার ঘটনায় যখন আমরা সবাই স্তব্ধ, তখন আমার এক বন্ধু ফোন করে জানায়, তাদের কোচিং ছুটির পর দুজন মোটরসাইকেল আরোহী আমার খোঁজ করছিল,তারা কোচিং-এর কয়েকজন স্টুডেন্টকে জিজ্ঞেস করছিল আমার সম্পর্কে। আমি কোন এলাকায় থাকি,কোন সিম ইউজ করি,আমার ফোন নাম্বার সবই তাদের জানা,শুধু জানা নেই- কোন বিল্ডিং,কত নম্বর ফ্ল্যাট। ওই দুই মোটরবাইক আরোহী নাকি নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছিল,‘ইনশাল্লাহ,এই সপ্তাহ না পারলে এই মাসের মধ্যেই সব দেখাই দিব’।
এসব জানতে পেরে আমার মা-বাবা ভীত হয়ে সেদিন রাতের অন্ধকারে আমাকে এক আত্মীয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। আমার ফোন বন্ধ,নেট অফ,সবকিছু অফ,আমি কোথায় আছি,সেসব আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাও জানতো না। এভাবেই কাটছিল আমার দিন।
এরপর আমার বাবা-মা লক্ষ্য করলো,তাদেরকেও ফলো করা হচ্ছে। ফলো যারা করছিল তারা হয়তো সন্দেহ করছিল,আমি কোথাও লুকিয়ে আছি, কিন্তু কোথায় লুকিয়ে আছি তা বুঝতে পারছিল না। বাসায় আছি কিনা,তা নিশ্চিত করতে দু’জন ছদ্মবেশে একদিন আমার বাসায় বেল বাজায়,আমার পরিবারের সদস্যরা বুঝতে পেরে দারোয়ানকে ফোন করে, দারোয়ান এসে তাদের নামিয়ে নিয়ে যায়। আমার খোঁজ বের করতে তারা আমার পরিবারের সদস্যদের নিয়মিত ফলো করে যাচ্ছিল। তাদের দু’মাসের পরিশ্রম এভাবে প- হয়ে যাবে,তা তারা কিছুতেই মানতে পারছিল না। তাই তারা আমাকে তন্নতন্ন করে খুঁজছিল।
আর এদিকে আমি নিরাপত্তার জন্য একের পর এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছি। ওড়নার আড়ালে মুখ লুকিয়ে চলাফেরা করছিলাম। এর মধ্যে দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য ভিসার কাজ চলছিল। ভিসা পেতেই আর দেরী না করে,ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে জীবন রক্ষার জন্যে দেশ ত্যাগ করি।
‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’ৃআসলেই এমন দেশ আর কোথায় পাবেন? যেখানে ভয়ঙ্কর সব খুনীরা প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায় আর আমার মতো সাধারণ কাউকে মুক্তচিন্তা করার অপরাধে শাস্তি দিতে সকলে মিলে চাপাতিতে শান দেয়!
‘সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি’ৃআমার দেশ নিশ্চয়ই জঙ্গিবাদের রাণী। অপরাধীদের জন্য নিরাপদ ভূমি। দেশের কথা ভাবতে গেলেই বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে। দেশে থাকাকালীন দেশ যে কী জিনিস তা অনেকেই বোঝে না, দেশের বাইরে বাস করতে বাধ্য হলেই বোঝে। পরদেশে বসে দেশকে মনে হয় খুব আপন, অনেক স্বপ্ন আর ভালোবাসার স্পর্শ।
দেশে আমি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ালেখা করছিলাম। আগামী বছর ইন্টার পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সব কিছু কেমন ওলট-পালট হয়ে গেল। নতুন দেশে আমাকে আমার লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রথমেই তাদের ভাষা আয়ত্ত করতে হবে। শুনেছি, এখানে ১২ ক্লাসে নতুন স্টুডেন্ট ভর্তি নেয় না। কাজেই আমাকে ১১ ক্লাসে ভর্তি হতে হবে। বছরের মাঝামাঝি সময় কোথাও ভর্তি নেবে না, কাজেই আমাকে আরও এক বছর অপেক্ষা করতে হবে। এতে আমি প্রায় দুই বছর পিছিয়ে গেলাম। এখানে স্থায়ী বাসের কাগজপত্র হতেও সময় নিবে। বয়স আমার ১৭। বাবা মা ছাড়া আগে কখনও এভাবে একা থাকতে হয় নি, এতসব জটিল কাজগুলো এখন আমাকে একাই করতে হবে।
সম্পূর্ণ অজানা-অচেনা পথে আমি হাঁটতে বাধ্য হচ্ছি। পথটা খুব কঠিন। ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন সংস্কৃতি এসবে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া খুব সোজা নয়। কৈশোর-জীবনটা আমি খুব উপভোগ করতাম, বন্ধুবান্ধব, আড্ডা, দুষ্টুমি। ফেলে আসা জীবনটা আমাকে প্রতিমুহুর্তে কাঁদায়। ‘হতাশা’ শব্দটার সাথে আমি আগে পরিচিত ছিলাম না, এখন ‘হতাশা’র সাথেই আমার বসবাস। এরমধ্যেই জীবনের হুমকি পেয়ে অনেক ব্লগার বন্ধুই দেশ ছেড়েছে। তাদের সবারই একই সমস্যা, ‘কিছু ভাল লাগে না’। এই হতাশাটুকু কাটিয়ে নতুনভাবে জীবন গুছিয়ে নেওয়া, নতুন জীবনকে উপভোগ করা সবার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না।
এই নতুন দেশে আমার জীবনে কোনও হুমকি নেই, এটি আধুনিক সভ্য সমাজ, ঠিক যেমনটি আমি চেয়েছিলাম। এই দেশের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা আছে বটে কিন্তু ভালোবাসা নেই, এই দেশ নিয়ে আমি স্বপ্ন দেখিনি। তাই আধুনিক দেশটা ঘুরে দেখতে আমার আগ্রহ হয় না। মনে হয় এসব তো আমার নয়, নিজেকে বিদেশী মনে হয়, বাইরের লোক বলে মনে হয়।
দেশের কথা ভাবতে গেলেই বুকের ভিতরটা কেমন যেন করে। দেশে থাকাকালীন দেশ যে কী জিনিস তা অনেকেই বোঝে না, দেশের বাইরে বাস করতে বাধ্য হলেই বোঝে। পরদেশে বসে দেশকে মনে হয় খুব আপন, অনেক স্বপ্ন আর ভালোবাসার স্পর্শ।
নিজের দেশ ছেড়ে, আপন মানুষদের ছেড়ে আমাকে এভাবে অনিশ্চিত এক জীবন যাপন করতে হচ্ছে, কিন্তু কি দোষ ছিল আমার? আমি বাক স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি, সমানাধিকারের কথা বলি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করি – এসবই কি আমার অপরাধ? আমার মতো অন্যান্য অনেক ব্লগার বন্ধুরাই হুমকি পেয়ে দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। আমরা যারা দেশকে ভালোবাসি আমাদেরই দেশে নিরাপত্তা মেলে না, কুপিয়ে হত্যা করা হয়, যার কোনও বিচার হয় না। বাংলাদেশটা তবে কাদের দখলে চলে যাচ্ছে?’
আমরা জানি কাদের দখলে চলে যাচ্ছে দেশ। আমরা শুধু জানি না ছোট্ট মেয়ে ইতু আদৌ কোনওদিন ফিরতে পারবে কি না তার দেশে, যে দেশটিকে সে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে।