॥ মোফাজ্জল শাম্স ॥
খোলা বাজার২৪ ॥ সোমবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৫
মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দু’টি। একটি ঈদ-উল-ফিতর অপরটি ঈদ-উল-আযহা বা কোরবানির ঈদ। ঈদ অর্থ খুশি, আনন্দ। এখানে ঈদ-উল-আযহা সম্পর্কে আলোকপাত করা হবে।
শৈশব পেরিয়ে এসেছি আজ প্রায় পঞ্চাশ বছর হলো। কিন্তু সে সময়কার ঈদের স্মৃতি জ্বল জ্বল করছে মনের আঙিনায়। আমার জন্ম অজপাড়া গাঁয়ে। পায়ে হাঁটার পথ আর দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ আর শস্য ক্ষেত ছিল আমাদের চার পাশে। পাকা রাস্তার দেখা মিলতো বাড়ি হতে পঁচিশ কিলো হাঁটার পর। গ্রামে জীবন যাত্রার মান ছিল সাদামাটা। সে সময় হজ্বে যেতে হলে প্রথমে লঞ্চে নারায়নগঞ্জ, সেখান হতে বাসে ঢাকা। বিরতি নিয়ে বাসে চট্রগ্রাম। জাহাজে চড়ে জেদ্দা হয়ে মক্কা-মদীনা। কয়েক মাস লেগে যেত হজ্ব সম্পাদন করে দেশে ফিরতে।
সে সময় অধিকাংশ গ্রামের মানুষের পেশা ছিল কৃষি। স্বচ্ছল পরিবারের লোকেরাই কোরবানী দিত। আর কোরবানীর জন্য পালের হৃষ্টপুষ্ট গরু এবং খাসী। রোজার ঈদের পর হতেই যত্ন সহকারে পালন করা হতো। কখনো কখনো ঈদের মাস খানেক পূর্ব হতেই পশু হাট থেকে কেনা হতো কোরবানীর গরু, খাসী। এ সব হাট বসতো সপ্তাহে একবার বহু দূরে। পায়ে হেঁটে রাখালসহ হাটে গিয়ে কেনা হতো গরু। গরু কেনার আগে দেখা হত এতে কোন খুঁত আছে কিনা? দাঁত দেখা হতো। শিং ভাঙা কিনা ? স্বাভাবিকভাবে পশুটি হাটতে পারে কিনা ? না খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটে? লেজ কান ঠিক আছে কিনা ইত্যাদি। দেখা হতো। শিং, গলায়, মাথায় রঙিন মালা পড়িয়ে গরু নিয়ে আসা হতো। গরু কেনার পর হতে ঈদের পূর্বদিন পর্যন্ত বড়দের সাথে সাথে বাড়ির শিশু-কিশোররা মাঠ থেকে ঘাস, লতাপাতা জোগাড় করে পশুকে খাওয়াত। বাড়ির পাশের হালটে নিয়ে ও পেট না ভরা পর্যন্ত পশু চড়ানো হত।
জেলহজ্ব মাসের চাঁদ দেখার ১০ দিন পর ঈদ হতো। প্রতীক্ষার পর প্রতীক্ষা। দশ দিন যেন শেষ হতেই চায়না।
ঈদের দিন হাতে তৈরী শেমাই, গুড়ের ক্ষির রান্না হতো। এ শেমাই তৈরী করা হতো ময়দা থেকে। দুধ, গুড় আর নারকেল সমন্বয়ে ক্ষির রান্না হতো। শেমাই রান্না করা হতো গরুর খাঁটি দুধ ও মিশ্রী দিয়ে। কিসমিস ও থাকতো। পিঠে ভাজা হতো। গুড়ের শিরা তৈরী করে পিঠার মধ্যে দেয়া হতো। রোজার ঈদে প্রাপ্ত জামা পরিষ্কার করে রোদে শুকানো হত। ভাজ করে বালিশের নিচে ন্যাপথালিন দিয়ে রেখে দিলে সকালে পরিপাটি দেখাতো এসব কাপড়। এগুলো পড়ে ঈদগাহে যেতাম। বাজার থেকে কাগজের রঙিন টুপি ও পটকা কিনে আনতাম। এখন ঈদ মানেই নতুন জামা জুতা। আমরা শৈশবে তা পেতামনা। ঈদের জামাতে যাবার আগে ও কোরবানীর সময় পটকা ফুটানো হত।
ঈদগাহে যাবার আগে পুকুরে নিয়ে কোরবানীর পশুকে গোসল করানো হত। খাসীকে পানিতে নামানো ছিল কঠিন কাজ। চার পা দিয়ে মাটি আঁকড়ে ধরে রাখতো। জোর করে টেনে হিচড়ে পানিতে নামানো হতো। সেকি আনন্দ।
ঈদের জামাতের পর দ্রুত বাড়ি ফিরে খেয়ে নিতাম। মসজিদের হুজুর গ্রামের এক প্রান্ত থেকে পশু জবাই শুরু করতো। হাতে থাকতো সান দেয়া ধারালো ছুরি। পশুর গলায় রঙিন দড়ি ধরে জবাইর মাঠে নিয়ে যাওয়া হতো। একই মাঠে অনেকগুলো পশু কোরবানি দেয়া হতো। হুজুরের সাদা জামা রক্তে ভিজে লাল হয়ে যেতো। নিজেরাই বড়দের সাথে গরুর চামড়া ছাড়ানো ও মাংস বানাতে সহায়তা করতাম। এখনকার মত গরু বানানোর কশাই পাওয়া যেতনা।
কোরবানীর ঈদের দিন আমাদের সবচেয়ে আনন্দ হতো ঢোল বাজানো। এ ঢোল ভাংগা মাটির কলসির মুখে পশুর ভূড়ির সাথে আটকে থাকা পাতলা পর্দা দিয়ে বানানো হতো। পর্দা কলসীর ঢাকনার মুখে সেটে দিয়ে রোদে শুকান হতো। এরপর পাঠকাঠি দিয়ে সমবয়সী বন্ধুদের নিয়ে এক সাথে ঢোল বাজাতাম আর হাটতাম।
মাংস বানানোর পর তা ভাগ করা হতো। যারা কোরবানী দিতে পারতনা তাদের মধ্যে মাংস বিতরণ করা হতো।
মহান আল্লাহ তায়ালা সারা বিশ্বের মুসলমানদেরকে একদিন যেন নিমন্ত্রণ করেন। তিনি চান বছরে অন্ততঃ একদিন সকল মুসলমান, গরীব মিসকিন তৃপ্তি সহকারে সুস্বাদু ও উপাদেয় তরকারী খেয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। মাংস হচ্ছে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ট, সুস্বাদু ও উপাদেয় খাদ্য। কোরবানীর ওছিলায় মহান আল্লহ গরিব দুঃখী সকলকেই বছরে একদিন তৃপ্তি সহকারে খাওয়ার সুযোগ করেছেন। একমাত্র ইসলাম ধর্মেই রয়েছে সার্বজনিন এ নিমন্ত্রণ। সত্যিই মহান আল্লাহর দরবারে সকলেরই শুকরিয়া জানানো উচিত।