Sun. Apr 20th, 2025
Logo Signature
Agrani Bank
Rupali Bank
Advertisements

॥ ভেরা হোসেন ॥
16খোলা বাজার২৪ ॥ মঙ্গলবার, ১৩ অক্টোবর ২০১৫: গৃহস্থালীর গঠন, নারী-পুরুষ সদস্যদের পেশায় যুক্ততা, গৃহে অবস্থানের সময়, সন্তানের উপস্থিতি, গৃহস্থালিতে মূল দম্পতি ছাড়াও অন্যান্য সদস্য যেমন দম্পতিদের মা-বাবা, ভাইবোনের উপস্থিতি বা গৃহশ্রমিকের উপস্থিতি এবং সদস্যদের ব্যক্তিগত জীবন প্রক্রিয়া ও দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে গৃহস্থালীর গৃহ শ্রমের ধরনে পার্থক্য দেখা দিলেও বাজার করা, রান্না করা, রান্নার যোগার করা, ঘর ঝাড়ু দেয়া, মোছা, ধোয়া, কাপড় ধোয়া, বা”চার উপসি’তিতে বা”চার লালন-পালন, স্কুলে আনানেয়া, গৃহস্থালির সদস্যদের অসুখে দেখাশোনা করা, মেহমানদারি, ফোন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল দেয়া, যন্ত্রপাতি মেরামত এ ধরনের বহুবিধ গৃহশ্রম মধ্যবিত্ত গৃহস্থালিগুলোতে সম্পন্ন হতে দেখা যায় যা বর্তমান পুঁজিবাদী আধুনিক সমাজের অন্তর্ভুক্ত, মধ্যবিত্তশ্রেণীর প্রাত্যহিক জীবন যাপনের সাথে জড়িত। তবে এই গৃহশ্রম সংগঠনে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর লিঙ্গীয় ও শ্রেণী মতাদর্শ আধিপত্যশীল। কোনটি নারীর কাজ এবং কোনটি পুরুষের কাজ এসবই নির্ধারিত হয় এই মতাদর্শ দিয়ে।
স্বামী-স্ত্রী সমান রোজগার করলেও দেখা যায় রান্না হতে শুরু করে টেবিলে খাবার পরিবেশন পর্যন্ত সকল কাজই গৃহকর্ত্রীকে করতে হচ্ছে। চাকরিজীবী নারীদের গৃহস্থালিতে গৃহশ্রমিকের উপস্থিতি প্রায় অপরিহার্য এবং গৃহস্থালির মেয়ে বা অন্যান্য নারী সদস্যরা ঘরের কাজগুলো করে। চাকরিজীবী গৃহকর্ত্রীরা অফিসে বা কর্মস’লে যাওয়ার জন্য খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে গৃহশ্রমিকের সাথে সাথে রুটি, ডিম, সব্জি ইত্যাদি তৈরি করেন। এসময়ে অন্যান্য সদস্যরা ঘুমিয়ে থাকেন। দু একজন গৃহকর্তা সকালে উঠে চা করে খান বা বা”চাদের স্কুলে পৌঁছে দেন। বাঙালি মধ্যবিত্ত গৃহস্থালীগুলোতে গৃহকর্ত্রী ব্যতিক্রমভাবে সংসার খরচের পুরোটা বহন করলেও স্ত্রীর ঘরকন্নার স্থানের কোনো পরিবর্তন হয় না।
প্রযুক্তি নারীর শ্রমের প্রক্রিয়াকে পরিবর্তন করেছে এবং সময়কে কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে নারী পুরুষের গার্হস্থ্য শ্রমবিভাজনের ধরনে কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। গৃহবধু শিউলী রহমানের কেস হতে বিষয়টি বোঝা যায়। শিউলী রহমান মালয়শিয়া হতে আসার সময়ে ওয়াশিং মেশিন, টোষ্টার, ইত্যাদি নিয়ে এসেছেন যা তার প্রতিদিনকার কাজকে সহজ করে দিয়েছে। তিনি এখন মেয়ের পড়া আরও বেশি সময় দিতে পারেন। গৃহকর্ত্রী বললেন, ‘আধুনিক প্রযুক্তির যুগে ঘরের কাজ অনেক সহজ হয়ে এসেছে। এখন সারাদিন রান্নাঘরে পড়ে থাকতে হয় না। প্রেশার কুকারে ভাত ডাল রান্না করতে দু মিনিট লাগে।’ গৃহকর্তা বাজার ও কেনাকাটার কাজ ছাড়া ঘরের অন্য কোনো কাজ করেন না। শিউলী বললেন, মালয়শিয়া থাকার সময়ে মতিয়ুর তাকে নানা কাজে সাহায্য করত কিন্তু ঢাকায় আসার পরে তা আর করছে না। তবে স্বামী জয়দেবপুর হতে জার্নি করে বাড়ি ফেরে সে জন্য স্বামীর গৃহকর্মে অংশগ্রহণ না করাকে শিউলী রহমান স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করেছেন। যা মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর শ্রমবিভাজনের লিঙ্গীয় মতাদর্শকে স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয়ার প্রবণতাকে প্রকাশ করে।
মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সন্তান পালন মায়ের কাজ। সন্তান পালনকে নারীর তথা মায়ের স্বাভাবিক কাজ হিসেবে ধরে নেয়া হয়। কিছু গৃহস্থালিতে নবজাতক সন্তান পালার ক্ষেত্রে এবং স্কুল পড়ুয়া সন্তানদের কিছু কাজে গৃহকর্তাদের অংশ নিতে দেখা গেলেও সন্তানের মূল দায়িত্ব মায়ের। বাবারা সন্তানের জন্য সর্বদাই ব্যতিব্যস্ত এবং আয় রোজগারে ব্যস্ত থাকে কিন্তু সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব মূলত মায়ের উপরেই বর্তায়।
পরিবারগুলোতে স্বামীর পেশাগত উন্নতি, ক্রিয়াকলাপের সাথেও স্ত্রীর গার্হস্থ্য শ্রমবৃদ্ধির সম্পর্ক দেখা যায়। যেখানে স্বামী চাকরির সুবাদে কলিগ বসদের বাড়িতে আপ্যায়ন করে, দাওয়াত করে নিজের পেশাগত অবস্থানকে মজবুত করছে সে ক্ষেত্রে দেখা যায় স্ত্রীকে স্বামীর কলিগদের জন্য সারাদিন রান্না করতে হয়। কষ্ট হলেও, ইচ্ছে না করলেও হাসিমুখে কথা বলতে হয়, যা আদর্শ স্ত্রীর কর্তব্য পরায়ন এবং স্বামীর প্রতি ন্যায়নিষ্ঠতা প্রদর্শনকারী প্রবণতাকে প্রকাশ করে।
লেখক: গবেষক ও কবি