॥ রবিশঙ্কর মৈত্রী ॥
খোলা বাজার২৪ ॥ বুধবার, ১৪ অক্টোবর ২০১৫
বাংলাভাষায় দারুণ একটি উপসর্গ- অতি। অতি উপসর্গযোগে গঠিত অনেকগুলো শব্দ পাওয়া যায়।
যেমন- অতিকথন, অতিকায়, অতিঘরন্তি, অতিচড়া, অতিদর্প, অতিভক্তি, অতিরঞ্জন, অতিরিক্ত ইত্যাদি। আমরা বাঙালি। আমরা অতি উপসর্গটিকে অতিরিক্ত ভালোবাসি। এই অতি নিয়ে আজ আমার কী গতি হল সেই কথাটিই বলি। জানি না, আমিও অতিকথন দুষ্ট হয়ে যাব কিনা।
আমরা থাকি দক্ষিণ ফ্রান্সের সিভেন পর্বতমালার অন্যতম সাংস্কৃতিক শহর আলেসে। আলেসের একশো কিমির মধ্যে ছোটো বড়ো প্রচুর নগরগ্রাম আছে। ফরাসি দেশের গ্রাম যে ঠিক বাংলাদেশের গ্রামের মতো নয় সে-কথা বিলকুল সবাই জানি, মানি। এদেশের গ্রাম মানে শহরের চেয়ে কম লোকবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকা। প্রতিটি গ্রামেই নগরজীবনের সকল সুবিধা বিরাজিত; অতএব এইসব গ্রামের সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের গ্রামকে মেলানো যায় না।
ফরাসি দেশের নগরগ্রামগুলোতে হরহামেশাই নানান রকম গানবাজনার অনুষ্ঠান হয়। আমরাও বেশ আনন্দ পাই। শোনা গেল, আলেসের কাছের একটি গ্রামে উ”চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর বসবে। দারুণ আসর। এই আসরের মধ্যমণি ফরাসি এস্রাজ বাদক আলেক্স। আলেক্স শান্তিনিকেতন থেকে এস্রাজ শিখেছেন। লেখাপড়া করেছেন ভারতীয় সঙ্গীত বিষয়ে। বেশ ভালো বাংলা বলতে পারেন। আলেক্স তার সঙ্গে তবলা সঙ্গত করার জন্য সুদূর কোলকাতা থেকে মোটামুটি বিখ্যাত একজন শিল্পীকে উড়িয়ে এনেছেন। সুতরাং দারুণ একটা অনুষ্ঠান হবে।
ফরাসি সঙ্গীতপিপাসুরা নির্ধারিত দিনের আগেই ই-টিকেট করে আসন সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন। রবিবারের সন্ধ্যায় সঙ্গীতগৃহ দর্শক কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। বেশ জম্পেশ অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেল। এস্রাজে তবলায় বেশ একটা মাখামাখি ভাব হয়ে গেল। কিন্তু না, একটি দুটি রাগারাগির পরই তবলা এস্রাজের উপর দিয়ে রীতিমতো ঝড় বইয়ে দিতে শুরু করল। এস্রাজ এমনিতে নিরীহ সুরেলা সংবেদনশীল যন্ত্র, ওর উপরে তবলার তেরেকেটে মেরেকেটে ধা ধা করে উঠলে কাহাতক আর সহ্য করা যায়। ফরাসি দর্শকরা তবলার ঝড়কে প্রথমত বুঝতে পারছেন কি পারছেন না ভাব থেকে মুক্ত হয়ে একসময় বিরক্ত হতে লাগলেন। অনুষ্ঠানটি দারুণ জমে উঠতে উঠতে প্রায় ঝড়বিধ্বস্ত হয়ে থেমে গেল। তবু অনুষ্ঠান শেষে কলকাতার বাঙালি তবলা বাদককে ফরাসি দর্শকরা ম্যাক্সি বোকু দিতে ভুল করলেন না।
আমার ফরাসি বন্ধুনীর কাছে অনুষ্ঠান-প্রতিক্রিয়া জানতে চেয়ে বড্ড ধরা খেয়ে গেলাম। তিনি বললেন, থ্রেবো। খুব ভালো। পরক্ষণেই বললেন- কিন্তু বেশি ভালো ভালো না। পশ্চিম বাংলার তবলা বাদক খুব ভালো। কিন্তু উনি অতিরিক্ত ভালো, অতিচালাকা। আমাদের ফরাসি এস্রাজ বাদকের জন্য উনি ভালো না। উনি ওভার প্লে করেছেন। ওনাকে অতিমাত্রায় জাহির করতে গিয়ে এস্রাজকে দমিয়ে দিয়েছেন। এটাকে সঙ্গত বলা চলে না।
বন্ধুনী অধ্যাপিকা ফরমিক সিলভির সামনে থেকে পালানোর পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। যেঁচে গিয়ে রামধরাটি খাইলাম। একজন বাঙালি শিল্পীর অতিমাত্রা নিয়ে আমি যারপরনাই কুণ্ঠিত হয়ে গেলাম। এই হচ্ছে আমাদের দোষ; বাঙালির দোষ। বাঙালি হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ ক্রিশ্চিয়ান যাই হোন না কেনো; বাঙালি বাংলাদেশি, পশ্চিমবঙ্গি, আসামি, ত্রিপুরী, বিশ্ববাসী- যেখানেই থাকুন না কেনো- তাবৎ বাঙালির সবচেয়ে বড়োদোষ- অতিদোষ। বাঙালির মাত্রাজ্ঞান আজো হল না। কদিন আগে ফরাসি দেশের রাজধানী প্যারিসের বাংলাদেশি বাঙালিখ্যাত এলাকা সেনদেনিতে ঢাকার এক যুবক নিহত হয়েছেন। বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াত খেতে খেতে অতি কথায় কথায় ঝগড়া, তারপর হঠাৎ ছুরিঝড়। তারপর সব শেষ।
আমরা অতিভোজন করি, অতিকথন করি, অতিনত হই, অতিউ”চ ভাব দেখাই, অতিকরুণ মুখে থাকি, অতিভক্তি করি। আমরা অতিপোক্ত, অতিপক্ব, অতিপ্রজ, অতিপ্রসক্ত, অতিপ্রাকৃত, অতিবর্তিত, অতিবাদী, অতিব্যাপ্ত, অতিমানব, অতিরম্য। আমরা নিজেদেরকে অতীব অতিবুদ্ধিমান মনে করি; আসলে আমরা অতিমিত আহারে কথনে স্বপনে অতিসার রোগাক্রান্ত জরাজীর্ণ এক জাতিতে পরিণত হয়েছি। আমাদের আপাদমস্তক দেহমন থেকে অতি উপসর্গকে স্বর্গে পাঠাতে না পারলে, চিরকাল স্বনির্মিত নরকেই অতিবৃদ্ধ হয়ে নাচন কুদন করেই মরব।
বিনীত দ্রষ্টব্য : সাধারণ ধ্যানধানে অতি উপসর্গযোগে গঠিত সকল শব্দের অর্থ যদি কেউ খুঁজে না পান; কিছু মনে করবেন না, অতিস্বেদাক্ত না-হয়ে অভিধানাশ্রিত হবেন। পাণ্ডিত্য ফলিয়ে নিজের লেখাকে পণ্ড করার কোনো মানে হয় না। তবু যদি আমার এই অতিসামান্য রচনায় কিঞ্চিত পণ্ডায়ন ঘটে থাকে সে-জন্য আনত ক্ষমাপ্রার্থী।
লেখক: আবৃত্তিকার ও প্রবাসী সাংবাদিক