খোলা বাজার২৪ ॥বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর ২০১৫: গত কিছুদিন কয়েকটি নাম্বার থেকে ফোন আসলে খুব বিব্রত হচ্ছিলাম। ইনবক্সে মেসেজ আসলে উত্তর দিতে কষ্ট হচ্ছিল। ‘দেখছি, কথা বলেছি, চেষ্টা করেছি, দেখা যাকৃ’ ইত্যাদি কথা বলছিলাম, লিখছিলাম। আশ্বস্ত করার মতো কোনও জবাব দিতে পারছিলাম না। বলছি অদম্য বাংলাদেশের কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবকের কথা।
যাদের সঙ্গে কাজ করতেন, তাদের পুলিশ ধরে নিয়ে যাওয়ার পর নানা জায়গায় ছুটছিল তারা। বন্ধুর সূত্র ধরে আমাদের কাছে এসেছিল এই কিশোর-তরুণ স্বেচ্ছাসেবকরা।
আরিফ-জাকিয়ারা শিশু পাচারকারী, এর পক্ষে পুলিশের কোনও যুক্তি ছিল না, ছিল না তথ্য-প্রমাণও। মজার স্কুলের এই স্বেচ্ছাসেবকরা থানায় সেই যুক্তি-তথ্য-প্রমাণ সবই দিয়েছিল। পুলিশ চেয়েছিল টাকা, যা তারা দেয়নি, দিতে পারেনি। ফলে দুই দিনের রিমান্ডসহ এক মাসের অধিক সময় কারাগারে কাটল তাদের।
পুলিশ অভিযোগে লিখেছিল তাদের কাছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতির কাগজ পাওয়া যায়নি। ‘মজার স্কুল’ পরিচালনার জন্যে পুলিশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতিপত্র খুঁজছিল। হ্যাঁ, তাদের কাছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমতিপত্র ছিল না। আইনে এর শাস্তি কী?
পুলিশ তাদের সতর্ক করতে পারত। ‘মজার স্কুল’ বন্ধ করে দিতে পারত, সিলগালা করে দিতে পারত এক রুমের ছোট্ট মজার স্কুল। কিন্তু পুলিশ তা করেনি। পুলিশ শিশুপাচারের মামলা করেছিল আরিফ-জাকিয়াদের বিরুদ্ধে। স্কুলের অনুমতি না থাকার সঙ্গে শিশু পাচারের সম্পর্ক কী? কোনও সম্পর্ক নেই, তারপরও পুলিশ মামলা করেছিল।
অবশেষে তাদের জামিন হয়েছে? কিভাবে জামিন হলো? জামিনের ক্রাইটেরিয়া কী?
সরকারের উ”চপর্যায়ের কয়েকজন বিষয়টা জানলেন, বিষয়টি দেখার আশ্বাস দিলেন। সত্যি সত্যি তারা দেখলেন এবং জামিন হলো। তথ্য-প্রমাণ যুক্তিতে তাদের জামিন হলো না? বিস্ময়কর বাস্তবতা!
সবাই জানলেন, মৌখিকভাবে আমাদেরসহ আরও অনেকের সঙ্গে সহমত পোষণ করলেন যে, এরা সম্পূর্ণ নির্দোষ। এরা শুধু ভালো নয়, মহান কাজ করছেন। তাদের জামিনের জন্যে শেষ পর্যন্ত সরকারের উ”চপর্যায়কে এগিয়ে আসতে হলো। ধন্যবাদ সরকারের সংশ্লিষ্ট এই ব্যক্তিবর্গকে যে, তারা এগিয়ে এসেছিলেন। তা না হলে কতদিন বা কত বছর এদের জেলে থাকতে হতো কে জানে!
২.
কতজনের জন্যে এভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি হয় বা হবে? ফজলু মিয়ার জন্যে তো কেউ লেখালেখি করেননি। টকশোতে কথা বলেননি। জানা-ই যায়নি ফজলু মিয়ার কথা। ফলে তাকে জেলে কাটাতে হলো ২০টি বছর, গোটা একটা যৌবন।
কোনও গণমাধ্যম তার সংবাদ প্রকাশ করেনি বা করতে পারেনি। গণমাধ্যম আরিফ-জাকিয়াদের সংবাদও প্রকাশ করেনি শুরুতে। উল্টো পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী তাদের শিশু পাচারকারী হিসেবে সংবাদ প্রচার করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সো”চার না হলে, কী ঘটতে পারত এসব কিশোর-কিশোরীর ভাগ্যে? এক্ষেত্রে অসাধারণ সাহসী-দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে ‘একাত্তর টেলিভিশন’। একাধিক দিন অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা করেছে। একরাতে প্রায় পুরো একটি অনুষ্ঠান করেছে এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। যারা একাত্তরের সমালোচনা করি, তারা যেন এই বিষয়টিও মনে রাখি।
প্রশ্ন হলো কয়টি ঘটনা টকশোতে আলোচনা হয় বা হবে? সারা দেশে পুলিশ কর্তৃক এমন ঘটনা অহরহ ঘটছে। গণমাধ্যমে সেই খবর আসছে না, আসছে না সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। জানতে পারছি না আমাদের মতো ক্ষমতাহীন সাধারণেরা। জানতে পারছেন না সরকারের উ”চপর্যায়ের মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন অল্প কিছু মানুষও। কী ঘটছে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতারকৃতদের জীবনে? জঙ্গি পরিচয়ে গ্রেফতার বাণিজ্য তো থামানোর কোনও উদ্যোগ নেই। আসল জঙ্গির খবর নেই, নিরীহ মানুষদের বানানো হচ্ছে জঙ্গি। এই অবস্থার অবসান হবে কিভাবে? আদৌ অবসান হবে?
অবসান হতে পারে তখনই যদি প্রতিষ্ঠা করা যায় আইনের শাসন। যারা আরিফ-জাকিয়াদের জামিনে ভূমিকা রাখলেন, পুলিশ যে হঠাৎ করে এত ভালো রিপোর্ট দিয়ে বলল, এরা শিশু পাচারকারী নয়, সেই মানবিক ব্যক্তিরা কি রামপুরা থানার পুলিশকে জবাবদিহিতার আওতায় আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবেন? জানতে চাইবেন কেন পুলিশ নিরীহ কিশোর-কিশোরীদের এভাবে নির্যাতন করল? মানবপাচারকারী বানাতে চাইল? এভাবে কি ভাববেন সরকারের উ”চ পর্যায়ের মানবিক ব্যক্তিত্বরা? এভাবে কি ভাববে রাষ্ট্র পরিচালনাকারীরা?
৩.
বলছিলাম আইনের শাসনের কথা। আরিফ-জাকিয়াদের জামিনে যারা ভূমিকা রাখলেন, তারা কি এইচবিএম ইকবালের ভাতিজার জঘন্য অপকর্মের শাস্তিতে ভূমিকা রাখবেন?
ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া দুর্ঘটনা ঘটিয়ে গরিব মানুষদের আহত করার পরও পুলিশ কোনও মামলা করল না। তাকে গ্রেফতার করল না। মোটর সাইকেলে করে বাড়ি পৌঁছে দিল। জানতে চাওয়া হবে কেন পুলিশ এমন আচরণ করল? কিসের বিনিময়ে পুলিশ এমন আচরণ করল?
কার অপরাধে বা গাফিলতিতে ফজলু মিয়ার পুরো জীবনটা নষ্ট করে দেওয়া হলো?
সন্ধান করা হবে সেই অপরাধীদের? সারা দেশের কারাগারে কত-শত ফজলু মিয়ার জীবন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, উদ্যোগ নেওয়া হবে তা জানার? জানি, যে প্রশ্নগুলো করছি তার কোনও কিছুই করা হবে না। আরিফ-জাকিয়াদের জামিনে ভূমিকা রাখা যাদের কাছে প্রশ্ন করছি, এসব তাদের কাজও নয়। এসব কাজের জন্যে লোক আছে। জনগণের অর্থে বেতন দেওয়া লোক আছে। তারা এসব করেন না, করেন উল্টোটা। তারা আরিফ-জাকিয়া-ফজলু মিয়াদের পক্ষে দাঁড়ান না, তারা পক্ষে দাঁড়ান ইকবালের ভাতিজা ফারিজদের। ফারিজদের পক্ষে দাঁড়ালে নগদ লাভ আছে। পুরো রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনাটাই এভাবে চলছে। এই রাষ্ট্র প্রকাশ্যে গুলি করা ইকবালকে বিচারের আওতায় আনেনি। ইকবালের ভাতিজা জানে, তার চাচা আছে। চাপা-হত্যা যাই করুক তার কিছু হবে না।
এই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন করা না গেলে কাজের কাজ কিছু হবে না। আরিফ-জাকিয়াদের মুক্তিতে ভূমিকা রাখা অনেক দাবিদার ইতিমধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে। সত্যিকারের ভূমিকা যে দু’একজন রেখেছেন, তাদের আমরা সাধুবাদ জানাব, ধন্যবাদ জানাব। কিন্তু এটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হয়েই থাকবে যদি না রাষ্ট্রের হাত থেকে, পুলিশের হাত থেকে নিরপরাধ মানুষদের বাঁচানো যায়।
জবাবদিহিতা এবং আইনের শাসনের কোনও বিকল্প নেই। যা আমাদের সমাজে প্রায় নেই বললেই চলে। বাংলাট্রিবিউন
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক