খোলা বাজার২৪ ॥ বৃহস্পতিবার, ২২ অক্টোবর ২০১৫:গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর গুলশানে ইতালীর নাগরিক, ডাচ এনজিও কর্মী তাবেলা সিজার খুন হন সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে উত্তরাঞ্চলের জেলা রংপুর শহরের উপকণ্ঠে কাউনিয়ার মেঠোপথে খুন হন জাপানি নাগরিক কোনিও হোসি। দুই বিদেশির হত্যাকারীরা মোটরসাইকেলযোগে আগমন করে এবং খুন করে একই যানে পালিয়ে যায়। দুই বিদেশি হত্যাকা-ে যে ধরনের পিস্তল ও গুলি ব্যবহার করা হয়েছে তা সাধারণ সন্ত্রাসীদের হাতে থাকার কথা নয় বলে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মত প্রকাশ করেছেন। এই ধরনের অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সাধারণ সন্ত্রাসীরা ব্যবহার করে না, তাহলে করলো কারা? এ নিয়ে দিন দিন রহস্যের জট বেড়ে যাচ্ছে। লক্ষণীয় যে, তাবেলা হত্যাকা- স্থলের পাশে রাস্তার বাতি বন্ধ থাকলেও নিকটের অন্যবাতি জ্বলছিল। হত্যাকা-ের পর বাতি জ্বলে উঠে। বিষয়টি রহস্যজনক বৈকি। অথচ চূড়ান্ত তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশের আগেই ক্ষমতাসীনদের তরফ হতে দোষারোপের খেলা শুরু হয়ে যায়। ।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউইয়র্কে অবস্থানকালে দুই বিদেশি হত্যাকা-ের সাথে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলাম জড়িত বলে অভিযোগ করেছিলেন। গত ১৪ অক্টোবর ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি বাংলাদেশে বিদেশি হত্যাকা-ে লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি ইংগিত করে বলেছেন, যারাই এই খুনে জড়িত, তারা কোনো ছাড় পাবে না। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় গত ৭ অক্টোবর তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেছেন, আমার কাছে নির্ভরযোগ্য তথ্য আছে, সম্প্রতি বাংলাদেশে বিদেশি হত্যাকা-ে বিএনপি-জামায়াত জড়িত থাকার। মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য ও নেতা-পাতি নেতারাও ইতালি ও জাপানি নাগরিক হত্যাকা-ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে একই ধরনের ব্লেম গেম বা দোষারোপের খেলায় মেতে উঠেছেন।এ ধরনের দোষারোপের খেলা যে দুই হত্যাকা-ের তদন্ত কাজকে প্রভাবিত করছে সে আলামত ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শুরুতে পুলিশ ইতালির তাবেলা সিজার হত্যাকা-ের সময় ভিডিও ফুটেজে যে ছবি পাওয়া গেছে তা অস্পষ্ট হওয়ার কারণে খুনীদের শনাক্ত করা যাচ্ছে না বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিল। তারপর হঠাৎ করে পুলিশ প্রশাসনের তরফ হতে বলা হয়, হত্যাকা-ের সাথে সংশ্লিষ্টদের চিহ্নিত করা গেছে। হত্যাকা-ে ব্যবহৃত মোটরসাইকেল শনাক্ত করা হয়েছে। তার আগে রংপুরে ঢাকা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির সদস্যসচিব হাবিব উন নবী সোহেলের ছোট ভাইকে হত্যাকা-ে জড়িত থাকার অভিযোগ এনে জেলে পাঠানো হয়। এরপর এখন পুলিশের বরাত দিয়ে কোনো কোনো সরকারপন্থী গণমাধ্যম বলছে যে, দুই বিদেশি হত্যাকা-ে পেশাদার খুনীদের ব্যবহার করেছেন হাবিবুন নবী সোহেলসহ বিএনপির আরো চার নেতা।ইতোমধ্যে দুই বিদেশির রহস্যজনক খুনের ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিএনপি এবং তার জোটসঙ্গী জামায়াতের নেতা-কর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়েছে। গোটা দেশের বিরোধী নেতা-কর্মীরা আতঙ্কিত এবং গ্রেফতার এড়ানোর জন্য আত্মগোপনে রয়েছেন। এ প্রসঙ্গে গত ১০ অক্টোবর দৈনিক ইনকিলাবে “বিএনপি-জামায়াত নেতা-কর্মীরা আবার ঘরছাড়া” শিরোনামে এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়, ‘গ্রেফতার আতঙ্কে আবার ঘরছাড়া বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীরা। অনেক এলাকার ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারাও রাতে বাড়িতে ঘুমাতে পারছেন না। গত কয়েকদিন ধরে নতুন করে আবার শুরু হয়েছে রাজনৈতিক ধরপাকড়। শুধু গ্রেফতার নয়, অনেককে ধরে নিয়ে পায়ে গুলি করা হচ্ছে। কাউকে কাউকে ডিবি পরিচয়ে গুম করা হচ্ছে। এই ধরপাকড়কে কেন্দ্র করে ২০ দলীয় জোট নেতা-কর্মীদের মধ্যে গ্রেফতার আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশের ভয়ে তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। এমন অভিযোগ করেছেন বিএনপি নেতা-কর্মীরা।’ধারণা করা যায়, মূলধারার রাজনীতির প্রকৃত প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি যখন দেশব্যাপী পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের পর সবার অংশগ্রহণে জাতীয় সংসদের মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে নতুন করে রাজপথের আন্দোলন শুরু করার উদ্যোগ গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তার আগেই দুই বিদেশি হত্যাকা-কে ইস্যু করে বিএনপি ও তার কার্যকর জোটসঙ্গী জামায়াতের ওপর ব্যাপক সরকারি দমন-পীড়ন শুরু হয়েছে। এছাড়া জাতীয় সংসদের মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন বানচালের উদ্দেশ্যে এবং তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনগুলোর অবস্থান শক্ত করার উদ্দেশ্যে তড়িঘড়ি করে পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন শুরুর ঘোষণা দেয়া হয়েছে। স্থানীয় সরকারের এসব নির্বাচনে বিএনপি ও জামায়াতপ্রার্থীরা জয়ী হতে কিংবা সুবিধাজনক অবস্থায় থেকে নির্বাচনী প্রচার কাজ যাতে চালাতে না পারে তার জন্যও এই ব্যাপক ধরপাকড়।এখানে এ প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে, রাজপথে সরকার পতনের আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি যখন সবার অংশগ্রহণে জাতীয় সংসদের মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে সরকারের ওপর প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ সৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে সে প্রেক্ষাপটে দলটি আমাদের উন্নয়নসহযোগী ও প্রভাবশালী দুটি দেশের দুই নাগরিককে হত্যা করার ঝুঁকি নেবে কেন। উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আবারো দাবি করেছে যে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়নি। তবে দুই বিদেশি হত্যাকা-কে কেন্দ্র করে ক্ষমতাসীনদের তরফ হতে বিএনপি ও জামায়াতের ওপর দোষ চাপানোর খেলায় খুব একটা সফলতা এসেছে বলে মনে হয় না। বরং বিপরীতটিই ঘটার সম্ভাবনা বেশি বলে মনে হয়। কোনো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত না করেই বিএনপি ও জামায়াতের ওপর দুই বিদেশি হত্যার দায়ভার চাপানোকে বাংলাদেশে নিযুক্ত পশ্চিমা বিশ্ব ও জাপানের রাষ্ট্রদূতরা সুনজরে দেখছেন না।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর নাগরিকদের বাংলাদেশে চলাফেরার ওপর বারংবার রেড অ্যালার্ট জারির ঘটনায় শেখ হাসিনার সরকার বেশ বিব্রত, উদ্বিগ্ন এবং ক্ষুব্ধ। বাংলাদেশ ভ্রমণে বিদেশিদের সতর্ক বার্তাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে তার মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্যরা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও বাড়াবাড়ি হিসেবে দেখছেন। বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্সিয়া স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাটের দুই বিদেশি হত্যাকা-ের আগে সরকারকে সতর্ক করার বার্তা প্রদানের দাবিতে বেজায় চটেছেন ক্ষমতাসীনরা। বিদেশিদের বাংলাদেশ ভ্রমণে সতর্কতা জারির নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে জাতীয় অর্থনীতিতে। বিভিন্ন এনজিও এবং অর্থনৈতিক সেক্টরে কর্মরত বিদেশিদের অনেকেই ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করেছেন।শুধু তাই নয়, বিদেশি বায়ারদের বাংলাদেশ সফর বাতিল, বাংলাদেশ থেকে চলে যাওয়া এবং সফর সংক্ষিপ্ত করা ইত্যাদি ঘটনার বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশে রফতানি খাতগুলো বিশেষ করে গার্মেন্ট সেক্টরে ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, ২৫০০ কোটি ডলারের গার্মেন্ট খাত ভয়াবহ সঙ্কটের মধ্যে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি নতুন করে রেড অ্যালার্ট জারি করছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, নিউজিল্যান্ডসহ আরো বেশ কিছু দেশ। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, পশ্চিমা দেশগুলোর নাগরিকদের ওপর আরো সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা শেষ হয়ে যায়নি। এতে করে এ বিষয়টি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের ওপর এখনও আস্থাহীনতা রয়ে গেছে পশ্চিমা বিশ্বের বেশিরভাগ কূটনীকিদের।এ ধরনের আস্থাহীনতা বৃদ্ধি পেলে একটি দেশ কার্যত আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একপর্যায়ে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত হয়। তাছাড়া এতে করে বিদেশি বিনিয়োগও কমে যায় এবং যা একটা দেশের জন্য অর্থনৈতিক বিপর্যয় বয়ে আনতে পারে। অন্যদিকে বাংলাদেশের বিকাশমান পর্যটন শিল্পও বর্তমান পরিস্থিতিতে মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। বাংলাদেশে দুই বিদেশি হত্যার পর জাপান, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপের শত শত পর্যটক বাংলাদেশ ভ্রমণ বাতিল করেছেন। বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর গড়ে পাঁচ থেকে ছয় লাখ বিদেশি পর্যটক বাংলাদেশ ভ্রমণে আসে। ক্ষমতাসীনরা এযাবত প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি ও জামায়াতকে দমন-নির্যাতনের অজুহাত এবং পশ্চিমা বিশ্বের সহানুভূতি ও সমর্থন আদায়ের হীন উদ্দেশ্যে জঙ্গিবাদের যে প্রচারণা চালাতো তাদের এই ধরনের অপরিণামদর্শিতা ও অতিক্ষমতালিপ্সা আজ রাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য কাল হয়ে উঠেছে।এরপরও শেখ হাসিনার সরকার দুই বিদেশি হত্যাকা-ের ব্যাপারে গোয়েন্দাসংস্থাগুলোর ব্যর্থতার কথা একবারও স্বীকার না করে দায়ভার চাপিয়ে ও আরো দমন-নির্যাতন করে বিরোধী দলগুলোকে কোণঠাসা ও নিশ্চিহ্ন করার অশুভ খেলায় মেতে উঠেছে। এতে বাংলাদেশের প্রকৃত দুশমনদেরও আড়াল করা হচ্ছে। ভারতের মাওবাদিদের অনলাইন মুখপত্র লালসংবাদের এক তথ্যে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে বিশ্ব সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে এবং অর্থনৈতিক মেরুদ- ভেঙে দিয়ে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার হীন লক্ষ্যে দুই বিদেশিকে হত্যা করেছে ভারতীয় গোয়েন্দাসংস্থা ‘র’। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করার সাহস রাখে কিনা জানি না।
Copyright Daily Inqilab