॥ রবিশঙ্কর মৈত্রী ॥
খোলা বাজার২৪ ॥ সোমবার, ২ নভেম্বর ২০১৫ : ফ্রান্সের ছোট্ট একটি শৈল শহর আলেস। আলেসের প্রায় মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে লো গারদোঁ নদ। নদীর দুপাড় দিয়েই দুই লেনের সড়ক, শহর থেকে বেরিয়ে গেছে আল্পস আর সিভেন পর্বতমালার দিকে। আলেস শহরের প্রায় সবখান দিয়েই আছে ছোটো-বড়ো অনেক সড়ক। এ শহর ছোট্ট হলেও দৈর্ঘ্যে প্রায় বিশ কিলোমিটার। আলেসের মূল কেন্দ্র তিন কিমি প্রশস্ত। থিয়েটার সিনেমা মিউজিয়াম স্কুল-কলেজ থেকে শুরু করে সবই আছে আলেসে। কিন্তু এখানে মানুষ খুবই কম। মাত্র পনের হাজার। আমাদের সংসারের চারজন বাঙালি ছাড়া অন্য কোনো এশিয়ানও খুঁজে পাওয়া যাবে না এই শহরে। আলেস সিটিতে বেশ কটি টাউন সার্ভিস বাস চলাচল করে। আমরা আর কজন শিশু আর কজন বৃদ্ধ বৃদ্ধাই বাসের নিয়মিত যাত্রী। এই শহরের প্রায় সবারই গাড়ি আছে, তবু বাস চলে ঘড়ির কাঁটা মেনে। অনেক সময় আমিই একমাত্র বাসযাত্রী। আমি একাই সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরছিলাম; মাঝপথের এক স্ট্যান্ড থেকে একজন বৃদ্ধ উঠলেন দুই নাম্বার বাসের বিলানিয়া লা হয়াল ডিরেকশনে। ফাঁকা বাসে বৃদ্ধ মঁসিয়ো আমার পাশেই বসলেন। ফরাসিরা সাধারণত অপরিচিত কারো সঙ্গে কম কথা বলেন। কিন্তু মঁসিয়ো বৃদ্ধ আমাকে অনেক কথা বললেন। কেউ একটু ধীরে ধীরে বললে ফরাসি ভাষা আমি এখন বুঝতে পারি। বৃদ্ধ স্বাভাবিক গতিতে বলছিলেন বলে তার কথার সবটুকু আমি বুঝতে পারলাম না। তিনি তার পাড়ায় নেমে যাবার আগে অয়োভা বলে বিদায় নিলেন। আমি চললেম একা। বৃদ্ধলোকটি আমাকে যা বলে গেলেন তার সারমর্ম হল: ‘তুমি এই শহরে নতুন বলে বেশি চাপ নিও না। তুমি একা বাসে ঘুরছ, নিজের গাড়ি নেই, এই হীনমন্যতার চাপ নিও না। তুমি এই দেশের নাগরিক নও বলে কোনো সংকোচ কোরো না। তোমার কাল কী হবে সেই ভাবনার চাপও নিও না। সামনের দিনগুলোতে তোমাকে ভালো থাকতেই হবে, এই ভাবনা তাড়নার চাপ নিও না। তুমি ভালো থাকো। চাপমুক্ত থাকো।’ অযাচিতভাবে ফরাসি বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমাকে দারুণ শুনিয়ে গেলেন। সত্যিই তো, আমার চোখ আমার মুখ, আমার বাসে বসে থাকা, এই সবকিছুতেই আমার শরীরে একটা চাপের ছাপ আছে নিশ্চয়ই। তবু আমার চাপটা খুব সামান্য। কারো বেঁধে দেওয়া সময়ের তাড়াখাওয়া দৌড়ঝাঁপ চাপ তো আমার নেই। না-থাকাটাই চাপ। পরশ্রীকাতর হয়ে আমরা আবিষ্কার করি; আমার এটা-ওটা সেটা নেই। না-থাকাটাই যেন অপমান অসম্মানের। ফলে তাড়িত ফাঁড়িত হয়ে আমাদের বুকের ভেতরে উষ্ণতা তৈরি হয়। বুকের ভেতরে গরম বাতাস বেড়ে গেলে হার্ট কি স্বাভাবিক থাকে? হার্টবিট এমন বেড়ে যায় যেন ভূমিকম্প। ভূমিকম্প তো এক-দুমিনিটেই থেমে যায়; কিন্তু উ”চমাত্রার হƒদয়কম্পন সহজে থামতে চায় না, যেন ঝড় ওঠে। সমুদ্রের কোনো অঞ্চলের বাতাস যদি হঠাৎ গরম হয়ে যায় তখন সেই গরম বাতাস আর্দ্র হয়ে উপরের দিকে উঠে যায়। ফলে সেই অঞ্চল বাতাসহীন হয়ে পড়ে। আর ওই বাতাসহীন শূন্য অঞ্চলে তখন অন্য অঞ্চল থেকে শীতল বাতাস ছুটে আসে। ফলে যা হবার তাই হয়, বাতাসের ঘূর্ণি থেকেই সৃষ্টি হয় ঘূর্ণিঝড়। সেই ঘূর্ণিঝড় সমুদ্র থেকে ধেয়ে ছুটে এসে কামনা বাসনার উর্বর সবুজে আছড়ে না-পড়া পর্যন্ত নিস্তার নেই। চাপে পড়া মানে মৃত্যুকে আগাম আহ্বান করা। জš§গ্রহণ করেই তো আমরা বাঁচার চাপে পড়ে যাই। যে-করেই হোক বাঁচতে হবে। অর্থ মান যশ সম্পদ সম্পত্তি ক্ষমতা সব নিয়ে, বিশাল বড়ো বোঝার চাপের নিচে মরে মরেও বাঁচতে চাই। জীবন তো কদিনের। ছোট্ট এই জীবনের ঘাড়ে ভারী বোঝা চাপিয়ে দিয়ে কেন বলদের মতোই বাঁচতে হবে? যদি শুদ্ধ সুন্দর নির্মল আনন্দময় জীবন চাই, তবে আমি রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অনৈতিক কোনো চাপ নেব না। আধুনিক সভ্য এই পৃথিবীতে শোকের আয়ু মরেই গেছে যদি, তবে আমি কোন অচেনা আগামীর জন্যে আজকের রাতটা নিদ্রাহীনতায় কাটিয়ে দেব? আমি তো একশো মিটার দৌড়ের ট্রাকে পা রাখিনি; তবে কেন আমি পড়িমরি ঘোড়ার মতো ছুটে ক্লান্ত ধ্বস্ত হব! আমি জ্ঞান মেপে বুঝিয়ে দিয়ে সঠিক কর্মই যদি না পাব, তবে কেন আমি মরে মরে মুখস্থ পড়ায় জীবনপাত করব? এ জীবন, একবার ভ্রমণের জীবন। ভ্রমণে বেরিয়ে আমি সব দেখে দেখে চোখের সুখ মনের সুখ মেটাব। স্থান নাম ইতিহাস মুখস্থ করার চাপ নিয়ে আমার ভ্রমণের সুখ কেনো নষ্ট করব? লেখক : আবৃত্তিকার ও প্রবাসি সাংবাদিক