॥ আলী জাকের ॥
খোলা বাজার২৪ ॥ বৃহস্পতিবার, ১৯ নভেম্বর ২০১৫ : রমনা এলাকার গাছপালা যে সুপরিকল্পিত উপায়ে বপন করা হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ওই বিচক্ষণ বনায়নের নিদর্শন এখনও আমাদের মন কেড়ে নেয়। মিন্টো রোড, বেইলী রোড, হেয়ার রোড, পার্ক রোড, ফুলার রোড কিংবা গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাই এই রুচিশীল বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করে। কার্জন হল, সলিমুল্লাহ্ হল, এগুলো ছিল দেখার মতো ইমারত। আমার এখনও মনে আছে, কার্জন হলের সামনে দাঁড়িয়ে সদ্য বিবাহিত তরুণ-তরুণীকে ছবি তুলতেও দেখেছি আমি অনেকদিন
ঢাকা শহরের বন-বনানী একসময় বিখ্যাত ছিল। যতদূর শুনেছি, এই খ্যাতির পত্তন হয়েছিল বৃটিশ আমলে। লন্ডনের প্রখ্যাত কিউ গার্ডেনের প্রতিষ্ঠাতা স্বয়ং রমনা এলাকার বনায়নের দায়িত্বে ছিলেন। রমনা এলাকার গাছপালা যে সুপরিকল্পিত উপায়ে বপন করা হয়েছিল সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ওই বিচক্ষণ বনায়নের নিদর্শন এখনও আমাদের মন কেড়ে নেয়। মিন্টো রোড, বেইলী রোড, হেয়ার রোড, পার্ক রোড, ফুলার রোড কিংবা গোটা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাই এই রুচিশীল বিচক্ষণতার পরিচয় বহন করে। কার্জন হল, সলিমুল্লাহ্ হল, এগুলো ছিল দেখার মতো ইমারত। আমার এখনও মনে আছে, কার্জন হলের সামনে দাঁড়িয়ে সদ্য বিবাহিত তরুণ-তরুণীকে ছবি তুলতেও দেখেছি আমি অনেকদিন। একটি সুদৃশ্য ঐতিহাসিক ইমারতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে অক্ষয় হয়ে থাকাই ছিল উদ্দেশ্য নিশ্চয়। এমনকি গোটা পরিবারের সবাইকে নিয়ে কার্জন হল কিংবা হাইকোর্ট-এর সামনেও ছবি তোলার চল ছিল। অবশ্য বাল্যকালে, আমি যখন ঢাকায় এসেছি ততদিনে বিখ্যাত কোনো ইমারতকে পেছনে রেখে পারিবারিক ছবি তোলার চল এই শহরে স্তিমিত হয়ে এসেছিল। কলকাতায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কিংবা অক্টারলনী মনুমেন্টের (বর্তমানের শহীদ মিনার) সামনে আমাদেরই পরিবার অনেক ছবি তুলেছে কলকাতায় বেড়াতে গিয়ে। ইমারতের সামনে ছবি তোলার কথা বলতে আজকের এই লেখা শুরু করিনি। কথা হচ্ছিল, বৃক্ষ পরিবৃত ঢাকা শহর নিয়ে। একটা সময় ছিল যখন শহরের মানুষ বেড়াতে যেত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। বুদ্ধদেব বসু উল্লেখ করেছেন ঘোড়ার গাড়ীতে করে রমনা পরিভ্রমণের কথা।
আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম তখন দল বেধে হেঁটে বেড়াতাম ওই এলাকায়। কখনও, কখনও, বিশেষ করে শীতকালে, রিকশায় চাদর জড়িয়ে বসে ঘুরতাম। দারুণ লাগত। আমাদের এক সতীর্থ ছিল, প্রতিচ্যীয় পোষাকের প্রতি যার ছিল পক্ষপাতিত্ব। ওর জীবনের পাওয়া প্রথম স্যুটটি পড়ে ও রিকশায় ঘুড়ে বেড়াত অনেক সন্ধ্যোয়। বিভিন্ন বৃক্ষ ঢাকা এভিনিউ অলংকৃত সেই ঢাকা স্বভাবতই বদলে গেছে। এখন ঢাকায় প্রত্যুষ থেকে প্রদোষ অবধি, যেকোনো রাস্তায় তেল পোড়া ধোঁয়া আমাদের বুকের ভেতরে জ্বালা ধরায়। আর ওই ধোঁয়ার আক্রমণে সব শ্যামল সবুজ প্রাণ মূমুর্ষ প্রায়। আমি পরিবেশ সচেতন যেকোনো ঢাকাবাসীকে অনুরোধ করছি, সকাল দশটায় বাংলামটর এলাকায় দাঁড়িয়ে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে। তাহলেই তারা বুঝতে পারবেন, আমার কথার তাৎপর্য। আজকের রমনায় অবলীলায় কুন্ডলী পাকিয়ে ওঠে তেল পোড়া ধোঁয়া। সম্প্রতি ঢাকার রাস্তায় সিএনজি চালিত অটোরিকশা চালু করা হয়েছে এবং পুরোনো অটোরিকশাগুলোকে শহরে চলাচল করবার অনুমতি বাতিল করা হয়েছে। তবে অন্যান্য অনেক ডিজেল চালিত যানবাহনের ধোঁয়া এখনো অপসৃত হয়নিÑ এ বিষয়েও যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার। সারা বিশ্ব আজ এই ধোঁয়ার বিরোধী। বিরোধী এই পরিবেশ দুষণের। তবু কি কোনো লাভ হচ্ছে? আমাদের এই প্রিয় শহরেই একাধিকবার বৃক্ষ নিধন দেখেছি। হেয়ার রোড-মিন্টো, রোডের মাথায় যে সড়ক দ্বীপের ওপরে এখন একটি কুৎসিত দেখতে ফোয়ারা নির্মাণ করা হয়েছে, ওই দ্বীপের ওপরেই ছিল ঢাকার সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক নাগলিঙ্গম বৃক্ষটি। নাগলিঙ্গম ফুল ফোটার সময় ওই গাছের নীচে দিয়ে গেলে এক অসাধারণ সুবাস প্রাণ ভরিয়ে দিত। এই বৃক্ষটি নিধন করা হয় নির্মমভাবে। শাহবাগে নজরুল ইসলাম এভিনিউর শুরু থেকে বাংলামটর পর্যন্ত কৃষ্ণচূড়া আচ্ছাদিত থাকত সড়কটি। গ্রীষ্মকালে ওই কৃষ্ণচূড়া ফুল ফুটে নয়নাভিরাম দৃশ্যে মুগ্ধ হয়ে আমার এক বিদেশি অতিথি বলেছিলেন, ‘It`s like flame greeting the guests to your city’। ওই গাছগুলোও কেটে ফেলা হয়। ইদানিং দেখছি ওই সড়কের মাঝখানে কিছু গাছ সারিবদ্ধভাবে লাগানো হয়েছে। আশা করি, যথাযথ পরিচর্যায় আবার বৃক্ষহীন নজরুল ইসলাম এভিনিউর শ্যামল শোভিত হয়ে উঠবে।
লেখক: কলামিস্ট ও নাট্যজন