খোলা বাজার২৪, বুধবার, ১৩ জানুয়ারি ২০১৬: ডেভিড বোউয়ি সংগীতশিল্পী হিসেবে সুপরিচিত হলেও, অনেকেরই হয়তো অজানা যে অনলাইনে মিউজিক নিয়ে আসার ব্যাপারে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছিলেন এই ব্রিটিশ শিল্পী। ডটকম বাবল নামের বিপ্লবের শুরুর দিকেই ১৯৯৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এই সংগীতশিল্পী লঞ্চ করেছিলেন নিজস্ব ওয়েবসাইট বোউয়িনেট।
যে সময় ছিল না ইন্সটাগ্রাম, ইউটিউব, টুইটার, এমনকি মাইস্পেস এবং অধিকাংশ শিল্পীই অনলাইনে তেমন কিছুই শেয়ার করতে চাইতেন না বোউয়ি সেই আমলেই ইন্টারনেট প্লাটফর্মের মাধ্যমে তার ভক্তদের উপহার দিতে শুরু করেছিলেন নিজের বিভিন্ন ‘এক্সক্লুসিভ’ গান এবং কখনও কখনও ভক্তদেরকে তার সঙ্গে কথা বলারও সুযোগ করে দিতেন তিনি।
ওই সময়টিতে যারা বোউয়ি-এর অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করেছেন, তাদের একজন ক্রেইগ কার্টিনংটন বোউয়িনেট প্রসঙ্গে বলেন, “আমার দেখা অন্যতম সফল একটি প্লাটফর্ম হল বোউয়িনেট যা ভক্তদের কাছে সবার আগে পৌঁছে গিয়েছিল এবং পরবর্তীতে আমি বিষয়টির আর পুনরাবৃত্তি দেখিনি। তার একট আলাদা ভঙ্গি ছিল, সেটি হচ্ছে তিনি যদি কোনো কিছু করেন, তবে তা ঠিকভাবেই করবেন।”
বোউয়িনেট যে শুধু ভক্তদের জন্য ছিল তা নয়, এটি সে সময় রীতিমতো এওএল, ক্লারানেট এবং অন্যান্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে সম্পূর্ণ ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল বোউয়িনেট।
মাসিক ফি-এর বিনিময়ে বোউয়িনেট সদস্যদের @ফধারফনড়রিব.পড়স নামের ইমেইল অ্যাড্রেস দেওয়া হত এবং ওই ইমেইল অ্যাড্রেসের সাহায্যে বোউয়ি ভক্তরা ইন্টারনেটে তার এক্সক্লুসিভ অডিও রেকর্ডিং, মিউজিক ভিডিও এবং চ্যাট-এ অংশ নিতে পারতেন। ভক্তদের সঙ্গে সেসব চ্যাটিংয়ে স্বয়ং বোউয়ি অংশ নিতেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।
এ প্রসঙ্গে কারিংটন জানান, “তিনি কখনও আগাম কোনো কিছু জানাতেন না, হুট করে চ্যাটবোর্ডে আসতেন এবং আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন, অনেক সময় তিনি সাক্ষাৎকারের জন্য অতিথিও নিয়ে আসতেন। তিনি নিজেকে সবসময় ‘সেইলর’ নামে পরিচয় দিতেন।” এসব কর্মকাণ্ড বাদেও তিনি নিজের ছবি এবং পেইন্টিং আপলোড করতেন, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে নিজের ব্যক্তিগত ডায়েরির পাতা থেকেও চিহ্নিত অংশ প্রকাশ করতেন। বোউয়ি-এর সেসব কাজ প্রসঙ্গে রেবেল রেবেল-এর ক্রিস ও’ল্যারি মন্তব্য করেছেন, “বিষয়টি ওই যুগের তুলনায় অনেক এগিয়ে ছিল। সে সময় অন্যান্য রকস্টাররা নিজস্ব ওয়েবপেইজে খুব বেশি হলে নিজের একটি ছবি আর কিছু টেক্সট লিখে রাখতেন।” এ প্রসঙ্গে ও’ল্যারি আরও জানান, “শিল্পীদের অনলাইন কমিউনিটি তৈরির ব্যাপারে বোউয়ি প্রথম পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং তা যথেষ্ট সফলও হয়েছিল।”
বোউয়ি নিজ সেবার মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম ‘সাইবার-সং’-ও তৈরি করেছিলেন। ১৯৯৯ সালে তিনি ভক্তদের জন্য একটি প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন। ভক্তদেরকে গোন লেখায় সহযোগিতা করার জন্য ‘লিরিকস’ পাঠানোর আহবান জানানো হয়েছিল ওই প্রতিযোগিতায় এবং সে সময় ৮০ হাজার ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এতে অংশ নিয়েছিলেন। ভক্তদের পাঠানো সব লিরিক বোউয়ি নিজে পড়েছিলেন এবং পরবর্তীতে ২০ বছর বয়সী মার্কিন এক তরুণের লিরিক পছন্দ হয়েছিল তার। লিরিকটির বিষয়বস্তু ছিল ‘ইন্টারনেটে ভার্চুয়াল লাইফ’। এ ছাড়াও ভক্তদের জন্য নতুন নতুন ধরনের বিষয় নিয়ে আসতেন বোউয়ি। এর মধ্যে ছিল ৩৬০-ডিগ্রি ইন্টরাঅ্যাকটিভ ওয়েবকাস্ট প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির সাহায্যে ভক্তদের তিনি গানের ট্র্যাক রেকর্ড দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।
ওই সময়েই নিজ সাইটে তিনি ‘বোউয়ি ওয়ার্ল্ডের’ মাধ্যমে থ্রিডি চ্যাট-এর পরিবেশ তৈরি করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে ক্যারিংটন জানান, ওই চ্যাটে অংশ নিতে ভক্তদের একটি অবতার তৈরি করে নিতে হত, তারপর ইন্টারনেটে বোউয়ি-এর থ্রি ডাইমেনশনাল শহরে ঘুরে বেড়াতে পারতেন ভক্তরা। এমনকি চাইলে নিজ অবতার থামিয়ে অন্য ভক্তের সঙ্গে আলাপে অংশ নেওয়ার সুযোগও রাখা হয়েছিল।
ইন্টারনেটে প্রথম গান রিলিজের মাইলফলকও বোউয়ি’র দখলে। তিনিই প্রথম ‘ইন্টারনেট-অনলি’ সিঙ্গল রিলিজ করেছিলেন এবং তিন লাখেরও বেশি মানুষ তা সে সময় ডাউনলোড করেন। “ডাউনলোড করতে কয়েক মিনিটের প্রয়োজন পড়ত কিন্তু সে সময় বিষয়টি ছিল ইন্টারনেটে সম্পূর্ণ নতুন” এ প্রসঙ্গে এমন মন্তব্যই করেছেন ক্যারিংটন।
১৯৯৯ সালে বোউয়ি ‘নেটএইড চ্যারিটি কনসার্ট’-এ অংশ নিয়েছিলেন এবং সেটি ইন্টারনেটে স্ট্রিম করা হয়েছিল। ওই সময় বিশ লাখেরও বেশি মানুষ কনসার্টটি স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে দেখেছিলেন। কিন্তু হুট করেই সাত থেকে আট বছর আগে আস্তে আস্তে কমে আসতে শুরু করে বোউয়িনেট-এর আপডেট। সাইটটিতে লগইন করা যেত, কিন্তু তেমন কোনো আপডেট পাওয়া যেত না। ২০০৪ সালে একটি অনলাইন প্রতিযোগিতায় স্পন্সর করেছিলেন বোউয়ি এবং সাইটের আপডেটের মতো তার অনলাইন উপস্থিতিও ধীরে ধীরে কমে আসতে থাকে।
অবশেষে ২০০৬ সালে বোউয়ি-এর আইএসপি ব্যবসা অনেকটাই নিরবেই বন্ধ হয়ে যায়। আর সে সঙ্গে হারিয়ে যায় বোউয়িনেট-এ সিংহভাগ কনটেন্ট। ছয় বছর পর ২০১২ সালে বোউয়ি-এর ফেইসবুক পেইজ থেকে নিশ্চিত করা হয়, বোউয়িনেট আবার ফিরছে। ২০১৩ সালে পুনরায় লঞ্চ করা হয় ডেভিডবোউয়ি ডটকম।
বোউয়ি-এর ওই হঠাৎ অনুপস্থিতি প্রসঙ্গে রেবেল রেবেল-এর ও’ল্যারি জানিয়েছেন, স্বাস্থ্যগত কারণেই ২০০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে ইন্টারনেট জগত থেকে সড়ে আসেন তিনি। এ প্রসঙ্গে ও’ল্যারি আরও বলেন, “তিনি এখন নিজ ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ব্যস্ত এবং ওই ব্যক্তি আর হতে চান না যিনি সবসময় সবার জন্য ইন্টারনেটে উপস্থিত রয়েছেন। যখন আবার ফিরে এসেছেন, তখন তার কাজের প্রযোজনেই ফিরে এসেছেন, ইন্টারনেটের সঙ্গে নিজেকে জড়ানোর জন্য ফিরে আসেননি। তবে তিনি যা করেছেন তা ছিল অপূর্ব এবং এটি তার ঐতিহ্যের একটি অংশ হিসেবেই সবসময় বিবেচিত হবে।