খোলা বাজার২৪,শনিবার,২৩ জানুয়ারি ২০১৬: মেধা ক্লাস সেভেনে পড়ে। পড়ার সময় ও না পড়ে মোবাইলে কী যেন টিপাটিপি করে সারাক্ষণ। কেউ তার রুমে এলে বুঝে ফেলার আগেই খুব কৌশলে মোবাইলটাও সরিয়ে ফেলতে পারে সে। সবার ধারণা এই মোবাইল ব্যবহারের কারণে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছে সে। তাই তার বাবা তাকে পড়াশোনার সময় মোবাইলটা সুইচ অফ করে রাখার নির্দেশ দিলেন। মেধা নিয়মটি মাথা পেতে নিলো। নিয়ম চালু হওয়ার কিছুদিন বাদেই মেধার বাবা এক সন্ধ্যাবেলায় তাকে কল দিলেন এবং মোবাইল বন্ধ পেয়ে তিনি খুবই খুশি। কিন্তু এদিকে মেধার পড়াশোনার কোনো উন্নতি হলো না। কারণ মেধা মোবাইল অফ-লাইন মুডে রেখে গেম খেলেছে, টিপাটিপি করেছে। এরপর পড়াশোনার জন্য মেধাকে তারা দূরে হোস্টেলে রেখে ভাল স্কুলে ভর্তি করায়। তখন মাঝে মাঝেই তাকে পড়াশোনার সময় ফেসবুকে অনলাইনে দেখা যেত। তার বাবা তাকে পড়াশোনার সময় ফেসবুক ব্যবহার করতে নিষেধ করলেন। এবারও সে কোনো দ্বিধা ছাড়াই নিয়মটি মাথা পেতে নিলো। তখন থেকে সে চ্যাট অফ করে ফেসবুক ব্যবহার করতো। তাই তাকে অন-লাইন দেখাতো না এবং তার বাবা তাকে ফেসবুকে না দেখে আবারো খুশি। কিন্তু এতেও পূর্বের ন্যায় কোনো পরিবর্তন না আসলে তার বাবার চিন্তার আর কোনো সীমা থাকে না। মেধা আর মেধার বাবার মতো মধুর সমস্যায় পড়েছি আমরা। তা আর তেমন কিছু নিয়ে না। এই আমাদের ৫ টি মৌলিক অধিকারের মধ্যে সর্বশেষটি- ‘শিক্ষা’ নিয়ে। ‘মধুর’ শব্দটির মধ্যে যে কতো তিক্ততা প্রকাশ করেছি তার কিছুমাত্র হয়তোবা পাঠকরা উপলব্ধি করেছেন।
১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক প্রথম সরকারিভাবে শিক্ষানীতি ঘোষণা করেন। যার মাধ্যমে বাংলা তথা ভারতবর্ষের শিক্ষার্থীদের প্রথম পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান শেখার সুযোগ হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত অনেক শিক্ষানীতি/শিক্ষা কমিশন/কমিটি হয়েছে। স্বাধীনতার পর হয়েছে মোট ৭টি- ১. বাংলাদেশ শিক্ষা কমিশন (ড. কুদরত-ই খুদা) রিপোর্ট-১৯৭৪, ২. অন্তর্বর্তীকালীন শিক্ষানীতি (কাজী জাফর-আব্দুল বাতেন প্রণীত)-১৯৭৯, ৩. মজিদ খান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট-১৯৮৩, ৪. মফিজ উদ্দিন শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট-১৯৮৭, ৫. জাতীয় শিক্ষানীতি-২০০০, ৬. জাতীয় শিক্ষা কমিশন (মনিরুজ্জামান মিয়া) প্রতিবেদন-২০০৩, ৭. জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০। সর্বশেষ ২০১০ সালে জাতীয় শিক্ষানীতি করার ৫ বছর পর আজ কতটুকু উন্নত হয়েছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা? প্রশ্নটি হয়তোবা অনেকের, আবার হতে পারে প্রশ্নটি নিয়ে হয়তোবা কেউ ভাবছেনই না। আমাদের ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ এর ‘প্রথম অধ্যায় শিক্ষার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য’ এর ১ম পৃষ্ঠার ১০ নম্বর পয়েন্টে বলা হয়েছে মুখস্থ বিদ্যার পরিবর্তে বিকশিত চিন্তাশক্তি, কল্পনাশক্তি এবং অনুসন্ধিৎসু মননের অধিকারী হয়ে শিক্ষার্থীরা যাতে প্রতি স্তরে মানসম্পন্ন প্রান্তিক যোগ্যতা অর্জন করতে পারে তা নিশ্চিত করা।সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতির প্রবর্তন নিঃসন্দেহে এই পয়েন্টটির জন্য যথার্থ। কিন্তু সৃজনশীলতা কোথায়? মুখে-মুখে, কাগজে-কলমে নাকি কাজে? অবশ্যই কাজে। তবে সেই কাজটা শিক্ষা গ্রহণের কাজে হচ্ছে না, হচ্ছে শিক্ষা ব্যবসার কাজে। লাখ লাখ টাকা দিয়ে ফাঁস হচ্ছে প্রশ্ন যা আগে কখনও হয়নি। প্রশ্ন ফাঁসের সাথে যুক্ত ব্যক্তিরা কম করে হলেও প্রধান ব্যক্তিটি অবশ্যই সরকারি চাকরিজীবী। তাহলে প্রশ্ন ফাঁসের দোষটা কাকে দেব? সৃজনশীলতার আরো ব্যবহার হচ্ছে কোচিং সেন্টার ও গাইড বইগুলোতে। অসংখ্যবার সরকার এগুলো বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিলেও কেন এখনও হচ্ছে না? এটার মধ্যেও সৃজনশীলতা ঢুকেছে। আমি আইন এতো ভাল বুঝি না। তবে যতটুকু বুঝি তা দিয়েই বিষয়টি পরিষ্কার করা সম্ভব। ‘শিক্ষা আইন ২০১৩’ এর ৫১ নম্বর ধারার ১ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে- “গাইড বই, নোট বই, প্রাইভেট টিউশন ও কোচিং বন্ধে সরকার যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করিবে। গাইড বই, নোট বই তৈরি এবং সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।” কিন্তু ‘শিক্ষা আইন ২০১৪’ এ তা পরিবর্তিত করে বলা হয়েছে- “গাইড বই, নোট বই তৈরি এবং এর সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) কর্তৃক পাণ্ডুলিপির অনুমোদন করাইয়া কোন প্রকাশক অতিরিক্ত হিসেবে সহায়ক শিক্ষার উপকরণ বা পুস্তক প্রকাশ করিতে পারিবে।
বাহ,কত চমৎকার সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়েছেন তারা, সৃজনশীলতা দেখিয়ে আইনটাকে পরিবর্তন করেছেন কতো সুনিপুণভাবে! সৃজনশীলতা শিক্ষার্থীদের দেখানোর সুযোগ না দিয়ে সৃজনশীলতা দেখাচ্ছে তারা। তাহলে কীভাবে আর উন্নতি আশা করা যায়? মুখস্থ নির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে এসে আমরা চেয়েছিলাম সৃজনশীল শিক্ষাব্যবস্থা। মেধার মতো তারাও আমাদের কথা রেখেছে। কিন্তু সমাধা হয়নি মূল সমস্যার। চেয়েছিলাম অপ্রাসঙ্গিক বিষয়বস্তু বাদ দিয়ে সৃজনশীল বোর্ড বই। তারা কিছু জিনিস বাদ দিয়ে ও কিছু সৃজনশীল জিনিস ঢুকিয়ে অল্প কিছু কাগজ ফটোকপি করে বাইন্ড করে ধরিয়ে দিয়েছে বই হিসেবে। বিশেষ করে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগের বইগুলো। পৃষ্ঠা সংখ্যা বেঁধে দিয়ে লিখতে বলা হয়েছিল বই লেখকদের। কিংকর্তব্যবিমূঢ় লেখকদের মানতেও হয়েছে সে নিয়ম। তাই আজ এই বইগুলোর তাফসীর হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরনো বইগুলো। আর তাফসীর না পড়ে তো অন্ধ হাফেজের মতো বিজ্ঞান পড়া যায় না। কোনো শিক্ষার্থী যদি তা করতেও যায় তখনই বিজ্ঞানটা হয়ে যায় তার কাছে চিরতার নির্যাসের মতো তিক্ত। তাহলে লাভটা কোথায়? এমনকি আজ নতুন কোন কিছু যদি তাদের বলা হয়, সেটাও তারা করবে। কিন্তু কোন ফল পাওয়া যাবে না। আমরা সবাই মেধার বাবার মত নিরুপায়। শিক্ষাব্যবস্থার এই সমস্যাগুলোর সমাধান কখনই সম্ভব না যদি না তারা এর সমাধান করতে চায়। আমরা চাই দেশের জন্য একটা সুন্দর শিক্ষানীতি। এখন শুধু সেই সময়ের অপেক্ষা যখন শিক্ষাব্যবস্থার সাথে জড়িত সকলের বিবেকের উদয় ঘটবে, জান-প্রাণ দিয়ে সবাই চেষ্টা করবে সেই সুন্দর শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন করার জন্য। বাংলাদেশে যে পরিমাণ প্রতিভা, তাতে চোখ বন্ধ করে বলা যায় সেদিন থেকে বাংলাদেশকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না।