এমাজউদ্দীন আহমদ
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতারা ভালো মানুষের যেকোনো মানদ-ে উতরে যাবেন। তাঁরা শিক্ষিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুশিক্ষিতও বটে। অর্থনীতি সম্পর্কে সজ্ঞাত। রাজনীতির হাজারো প্রকরণ সম্পর্কে, তা জাতীয় হোক আর আন্তর্জাতিক হোক, তাঁরা সবিশেষ অবগত। সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গেও তাঁদের রয়েছে ঘনিষ্ঠ পরিচয়। মা-বাবা হিসেবে তাঁরা আদর্শস্থানীয়। সন্তানের প্রতি তাঁদের মায়া-মমতা-যতেœর কোনো কমতি নেই। ভাইবোন হিসেবেও তাঁরা অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ, যতœবান। আত্মীয়স্বজনের প্রতি তাঁদের যতœ-আত্তি সবার দৃষ্টি কাড়ে। যে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁরা সংশ্লিষ্ট, সেই দলের আদর্শের প্রতি না হলেও দলীয় নেতৃত্বের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রশ্নাতীত। তাঁরা ভালো ভালো কথা বলেন। জনগণকে উদ্দেশ করে যখন তাঁরা বক্তব্য দেন, তখন কারো সাধ্য নেই যে তা উপেক্ষা করে চলে যায়। চমৎকার ভাবভঙ্গির মাধ্যমে সবাইকে আকর্ষণ করেন। দীর্ঘক্ষণ সবাইকে সম্মোহিত রাখেন। যেখানে যান, নেতার মতো রাজসিক ভঙ্গিতেই সবার সামনে উপস্থিত হন। চলে যাওয়ার সময় স্থান ত্যাগ করেন অত্যন্ত আকর্ষণীয় ভঙ্গিতে। তাঁদের পোশাক-পরিচ্ছদে, আচার-আচরণে, কথাবার্তায় এক ধরনের আভিজাত্যের প্রকাশ সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সহজ কথায়, আমাদের রাজনৈতিক দলের নেতারা ভালো। বেশ ভালো।
কিন্তু এমন ভালো মানুষরা দেশের রাজনীতিকে কোন স্তরে নামিয়ে এনেছেন? কেন দেশের রাজনীতির এমন করুণ অবস্থা? কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ না রেখে কয়েকটি কথা বলতে চাই এ সম্পর্কে। প্রতিপক্ষের প্রতি তাঁরা এত রূঢ় কেন? কেন এত কর্কশ? এমন নির্মম? প্রতিপক্ষকে প্রতিপক্ষ হিসেবে না দেখে কেন দেখেন শত্রু হিসেবে? প্রতি পদে ঘায়েল করে সবার সামনে মাটির সঙ্গে তাঁদের মিশিয়ে দিতে চান? ব্যক্তিগত পর্যায়ে এমন ভালো মানুষগুলো সমষ্টিগত পর্যায়ে কেন এমন নির্মম হয়ে পড়েন? ব্যক্তি হিসেবে যাঁরা সব সময় সুরুচির মোড়কে আচ্ছাদিত, সমষ্টির মধ্যে এসে রুচিবোধ সম্পর্কে তাঁরা উদাসীন হন কিভাবে?
জীবনের শেষ প্রান্তে এমনি সব প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে খুব শ্রান্ত হয়ে পড়ি। পীড়িত বোধ করি। মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে প্রাণ পাওয়া আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশের রাজনীতি সুস্থ, স্বাভাবিক, কল্যাণমুখী, সৃজনশীল হয়ে উঠেছে, তা যেন দেখে যেতে পারি—এ প্রত্যাশা সার্বক্ষণিক। সবাই জানে। জানেন আমাদের রাজনীতিকরাও। এই পথে যে আমরা অনেক দূর অগ্রসর হয়েছি, তা আমরা সবাই জানি। আর খানিকটা পথ চললে, বিশেষ করে বন্ধুর ও দুর্গম পথের আরো খানিকটা ধীরপদে শান্তভাবে অগ্রসর হলেই চোখে পড়বে সুস্থ রাজনীতির মসৃণ রাজপথের কিনারা।
এ ক্ষেত্রে রাজনীতিকদের ভূমিকাই মুখ্য। এই কঠিন কাজটি তাঁদেরই সম্পন্ন করতে হবে। বুদ্ধিজীবীদের ভাবনা-চিন্তা কিছুটা গ্রহণযোগ্য হলেও পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালনের যোগ্যতা তাঁদের নেই। যে দলীয় কোন্দলে রাজনীতি হারিয়েছে তাঁর চিৎশক্তি, সেই কোন্দলে বুদ্ধিজীবীরাও সংশ্লিষ্ট। সামগ্রিক চিত্র তাঁদের চোখে এখন আর দৃশ্যমান হচ্ছে বলে মনে হয় না। যে সিভিল সোসাইটির ওপর আন্তর্জাতিক মহল এত আস্থাশীল, তা-ও ক্রমে ক্রমে প্রান্তিক হয়ে পড়ছে। বিদেশনির্ভর হয়ে, বিদেশি অর্থ, বিজাতীয় তত্ত্ব, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের নিষ্প্রাণ পন (চধহি) রূপে ব্যবহূত হওয়ার মানসিকতা অর্জন করে তাঁদের অনেকেই বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন। কেউ কেউ দেশের অসুস্থ রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সমগ্র ব্যবস্থাকে সেই পুরনো আধিপত্যবাদীদের হাতের নাগালে পৌঁছে দিতে উদ্যত। দেশের ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা এখনো অপরিণত বুর্জোয়ার মতো নিজেদের বাক্সগুলো ভর্তি করা ছাড়া অন্য কোনো উন্নত দিশা দিতে পারছেন না; যদিও সচেষ্ট। মনমানসিকতার দিক থেকে এখনো তাঁরা নিয়ন্ত্রিত হতেই যেন চান। নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হননি। সংবাদপত্র শুধু সহায়ক ভূমিকা পালনে সহায়তা করার উপযোগী। তাই দেশে সুস্থ-সাবলীল, নির্মল ও সৃষ্টিশীল রাজনীতির পথ রচনা করতে হবে রাজনীতিকদেরই। তাঁরা সঙ্গে পেতে পারেন এ দেশের সর্বংসহা উর্বর মাটির মতো বাংলাদেশের সংগ্রামী বিরাট জনসমষ্টিকে। অতীতেও দেখা গেছে, সাধারণ মানুষরা সব সময় থেকেছেন সুষ্ঠু ও সুস্থ রাজনীতির পক্ষে। এ জন্য তাঁরা সংগ্রাম করেছেন। অবস্থান নিয়েছেন সামনের পঙিক্ততে। নিগৃহীত হয়েছেন, কিন্তু পথ ছাড়েননি। সুষ্ঠু রাজনীতির জন্য তাই সাধারণ মানুষের প্রতি আস্থা স্থাপন করেই পথচলা শুরু করতে হবে।
বাংলাদেশের রাজনীতিকে সহজ, সরল, সুস্থ ও কল্যাণমুখী করতে হলে কোন কোন পর্যায়ে কী কী করণীয় এবং কী কী বর্জনীয় তার ফিরিস্তি দীর্ঘ। তার বিবরণ দেওয়া এর উদ্দেশ্য নয়। ইচ্ছা করলেই যে অনতিবিলম্বে আমাদের রাজনীতিকরা দেশের রাজনীতিকে দুদিনেই সুস্থ করে ফেলতে পারবেন, তা-ও নয়। পাশ্চাত্যে দীর্ঘদিনের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যা অর্জিত হয়েছে, মাত্র কয়েক বছরে বাংলাদেশে তা বাস্তবায়িত হবে—এ প্রত্যাশা সঠিক নয়। তবে সঠিক পথে চলা শুরু করা যে সম্ভব ও জরুরি তা অনুধাবন করতেই হবে এবং এখন থেকেই। সর্বপ্রথম আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের সমাজব্যাপী আইনের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে কৃতসংকল্প হতে হবে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁরা আইন প্রণয়ন করুন। আইনে প্রয়োজনবোধে পরিবর্তন আনুন। আইনকে পরিমার্জন করুন। আইনের বিভিন্ন দিকের বিশ্লেষণ সম্পর্কে একমত হোন।
তারপর আইন বাস্তবায়নের জন্য দৃঢ়সংকল্প হোন। এ ক্ষেত্রে কোনো শর্ত আরোপ না করে, আইনকে এক ইঞ্চি না বাঁকিয়ে, আইন বাস্তবায়নকারীদের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রেখে, কঠোরভাবে আইনের বাস্তবায়নে সংকল্পবদ্ধ হলে উন্নত সমাজের সদর রাস্তায় পা ফেলা সম্ভব। যার যা প্রাপ্য, তা যেন আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত হয় এবং যার যা প্রাপ্য নয়, তা আইনের মাধ্যমে বন্ধ করার প্রক্রিয়া সমাজে একবার চালু হলে সমাজ শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, আস্থাশীলতার ক্ষেত্রে হাজার যোজন এগিয়ে যাবে। এ জন্য আইনের অভিভাবক যে বিচারক এবং বিচারালয়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। তাঁদের নিরপেক্ষতা যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি দ্বারা বিঘিœত না হয় তা-ও নিশ্চিত করতে হবে। কোনো সভ্য সমাজের অন্যতম প্রধান শর্ত হলো বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং ওই সমাজে আইনের রাজত্ব। এটি সব সময় স্মরণে রাখতে হবে।
রাজনীতিকে কল্যাণমুখী করার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সুষ্ঠু ও সঠিক প্রয়োগ। যে সমাজে রাজনীতিকরা এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন, তাঁরা প্রায় সব ক্ষেত্রেই সাফল্য লাভ করেছেন। গণতান্ত্রিক সমাজে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার (ঝঃধঃব চড়বিৎ) অধিকারী হয় সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দল। যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হলো না, সেই দল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করে না বটে; কিন্তু সেই ক্ষমতা যেন সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করা হয় তার অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে চারদিক আগলে রাখে। গণতান্ত্রিক বিশ্বে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা জনগণের ক্ষমতা। জনকল্যাণেই তা প্রযোজ্য, শুধু জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারাই। সংক্ষেপে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে এক পবিত্র আমানত। এই আমানতের সদ্ব্যবহার যিনি বা যাঁরা করলেন, তাঁরাই বিপদে পড়তে পারেন, কিন্তু চূড়ান্ত পর্যায়ে তাঁরাই হন বিজয়ী। গণতন্ত্রের ইতিহাসে এমন নেতাদের কাহিনী লেখা রয়েছে স্বর্ণাক্ষরে। নির্বাচনে কখনো তাঁরা পরাজিত হননি।
নির্বাচন কোনো তীব্র স্রোতস্বিনী অতিক্রম করার মতো নয় যে যাঁরা হেরে গেলেন তাঁরা স্রোতে ভেসে গেলেন আর বিজয়ীরাই শুধু তীরে উঠলেন। নির্বাচন হলো এক পাহাড়ের চূড়ায় আরোহণের মতো কঠিন কাজ। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে, সব দিকে চোখ রেখে, বিবেক পরিচ্ছন্ন রেখে, যাঁদের আমানত এই ক্ষমতা, তাঁদের স্বার্থের দিকে লক্ষ রেখে, এর সদ্ব্যবহার করাই বিজয়ীদের কাজ। যাঁদের স্বার্থে এই ক্ষমতার প্রয়োগ ঘটছে, তাঁরাও পাহাড়ের নিচ থেকে সর্বক্ষণ তাকিয়ে থাকেন এই ক্ষমতা প্রয়োগকারীদের দিকে। দৃষ্টি রাখেন কখন, কিভাবে, কার জন্য, কোন প্রক্রিয়ায়, কতটুকু স্বচ্ছ ও পরিচ্ছন্নভাবে জনগণের এই আমানত ব্যবহূত হচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিকরা যদি অন্তত এ দুটি পদক্ষেপ গ্রহণে আগ্রহী হন, তাহলে অন্তহীন সম্ভাবনার এই দেশে হাজার বছর ধরে যেসব বঞ্চিত মানুষ বঞ্চনা-নির্যাতন-পীড়নের মধ্যেও আশার ছোট্ট প্রদীপটি সযতেœ লুকিয়ে রেখেছেন মনের মণিকোঠায়, তা আবারও জ্বলে উঠবে নিজস্ব মহিমায়। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যে জনগণের ক্ষমতা, তা-ও উল্লিখিত রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরে প্রাণ পাওয়া স্বাধীন বাংলাদেশের রক্তের আখরে লিখিত সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে। আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সবাই তা জানেন। কিন্তু এ পর্যন্তই। কোনো পর্যায়ে এ অনুচ্ছেদের বাস্তবায়ন ঘটেনি। এখন থেকে যদি ব্যক্তিগত, দলীয় বা সংকীর্ণ কোনো স্বার্থে এর প্রয়োগ না ঘটিয়ে শুধু জনকল্যাণে এর বাস্তবায়ন ঘটানো সম্ভব হয়, তাহলে রাজনীতির ক্ষেত্রে সবার অলক্ষ্যে আরো একটা বিপ্লব ঘটে যাবে। এই ছোট্ট দেশটিতে বিরাট জনসমষ্টি এখনো বিরাট বোঝা হয়ে ওঠেনি। উন্নত জীবনের সব সংগ্রামে জনসাধারণ সব সময় অগ্রপথিকের ভূমিকায় থেকেছেন। যেসব রাজনীতিক জনসাধারণকে পাশে নিয়ে, আইনের প্রাধান্যের বন্ধনে সবার আশা-আকাক্সক্ষাকে ধারণ করেন, যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার মালিক সাধারণ মানুষ, সেই সাধারণ মানুষের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে অগ্রসর হবেন, তাঁদের বিজয়রথ অপ্রতিরোধ্য। এই প্রক্রিয়া পরিণত হতে হয়তো সময় লাগবে; কিন্তু সূচনার সময় এটি। একবার সূচনা হয়ে গেলে, হোক পথ আঁকাবাঁকা, হোক তা সমস্যাসংকুল, গন্তব্য চোখে পড়বে। বিজয়স্তম্ভ তখন আর খুব বেশি দূর মনে হবে না। তাই বলি, দেশের ভালো মানুষ রাজনীতিকরা শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ে ভালো মানুষরূপে পরিচিতি নিয়েই কি কাল কাটাবেন? সামষ্টিক পর্যায়ে কি ভালো মানুষরূপে নিজেদের স্বাক্ষর রাখার উদ্যোগে অংশগ্রহণ করবেন না? মনে রাখা প্রয়োজন, ব্যক্তিগত বুদ্ধি বা বিচক্ষণতা উত্তম। কিন্তু সর্বাপেক্ষা উত্তম হলো সমষ্টিগত প্রজ্ঞা। এই পর্যায়ে উন্নীত হয়েই কোনো জনপদের জনসমষ্টি উন্নত সভ্যতার দ্বার উদ্ঘাটন করে থাকে।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশ : কালেরকণ্ঠ