প্রভাষ আমিন : শফিক রেহমানকে ধন্যবাদ। পাশ্চাত্যে অনেকদিন ধরে চলে আসা ভ্যালেন্টাইন ডে’কে বাংলাদেশে ‘বিশ্ব ভালোবাসা দিবস’ হিসেবে প্রচলন করায়। এই দিবস সংস্কৃতির সঙ্গে যতটা না আবেগের যোগ, তার চেয়েও বেশি বাণিজ্যের সম্পর্ক। ভালোবাসা দিবসে বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি টাকার কার্ড, ফুল, গিফট কেনা বেচা হয়। বাংলাদেশের যশোরের গদখালীর পাইকারি বাজারে একদিনে দুই কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছে। শফিক রেহমান ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবসের প্রচলন করেন। কিন্তু তার আগে কি আমরা ভালোবাসিনি? ১৪ ফেব্র“য়ারি ভালোবাসা দিবস মানে কিন্তু এই নয় যে শুধু এই দিনেই ভালোবাসতে হবে। প্রিয়জনকে ভালোবাসতে হবে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে। তারপরও আমি ‘ভালোবাসা দিবস’ পালনের বিরোধী নই। ভালোবাসা দিবসে একটু আদিখ্যেতা করতে আমার ভালোই লাগে। কিন্তু ভালোবাসা দিবস নিয়ে আমার একটা দুঃখবোধ আছে। ৯৩ সালে ‘ভালোবাসা দিবস’ এসে ভাসিয়ে নিয়েছে আমাদের এক গৌরবকে। ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ১৪ ফেব্র“য়ারি পালিত হতো স্বৈরাচার প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে।
১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন সেনাপ্রধান এরশাদ। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে টুকটাক প্রতিবাদ হলেও প্রথম বড় প্রতিরোধ হয় ১৯৮৩ সালের মধ্য ফেব্র“য়ারিতে। মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল এবং সামরিক শাসনের প্রতিবাদে ১৯৮৩ সালের ১৪ ফেব্র“য়ারি সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি দেয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের বিশাল মিছিল সচিবালয়ের দিকে রওয়ানা হয়। শিক্ষা ভবনের সামনে গেলে পুলিশ গুলি চালায়। তাতে শহীদ হন জাফর, জয়নাল, দিপালী সাহাসহ আরো অনেকে। অনেকের মরদেহ গায়েব করে দেয় পুলিশ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে চলে পুলিশের তাণ্ডব। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। এরশাদ সরকার নিষ্ঠুরভাবে দমন করে সে বিক্ষোভ। তবে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সে প্রতিরোধ ছাত্র-জনতাকে সাহস জুগিয়েছে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলনে, যা শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছে ১৯৯০ সালে।
নতুন প্রজš§ আজ ভুলে গেছে পূর্বসুরীদের সেই গৌরব। তারা আজ ভালোবাসায় মশগুল। কিন্তু গোটা আশির দশকজুড়েই এই দেশ ছিল উত্তাল। মহৎ সেই আন্দোলন গৌরবান্বিত করেছে আমাদের যৌবন। তখনকার একজন ছাত্রনেতা আক্ষেপ করে বললেন, তখন আমাদের ভালোবাসা ছিল আন্দোলন।
আজ সেই স্বৈরাচার এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। জাতীয় পার্টি আজ ক্ষমতার অংশীদার। তবু আমরা যেন ভুলে না যাই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের সেই দিনটিকে। আমরা যেন ভালোবাসি আমাদের গৌরবকেও।
লেখক : কলামিস্ট ও সিনিয়র সাংবাদিক