আনিসুল হক : খোলা বাজার২৪, মঙ্গলবার, ৮ মার্চ ২০১৬ : বাংলাদেশ বিশ্বকাপকে তার প্রাণ ফিরিয়ে দিয়েছে—২০১১ বিশ্বকাপের সময় ক্রিকইনফো লিখেছিল। এটা তারা লিখেছিল বাংলাদেশের দর্শকদের প্রাণের উচ্ছ্বাস দেখে। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে গৌরবের জায়গা এই দেশের দর্শক। এই দেশের দর্শকেরা বিশ্বসেরা।
বাংলাদেশকে টেস্ট মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর পর, তখন অন্যতম বিবেচনা ছিল এই দেশের কোটি কোটি ক্রিকেটভক্ত দর্শক, সমর্থক। পৃথিবীর বিভিন্ন গণমাধ্যমে এবং টেলিভিশনের ভাষ্যকারদের ভাষ্যে সব সময়েই উঠে এসেছে এ দেশের দর্শকদের প্রশংসা। তাঁরা বিস্মিত, এরা জিতলেও বাংলাদেশ, হারলেও বাংলাদেশ। দল হারতে শুরু করে দিলে বোতল ছুড়ে মেরে খেলা পণ্ড করে না। একটা খেলায় দল হারলে পরের ম্যাচে আরও ভালোবাসা নিয়ে দলের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ভারত-বাংলাদেশ খেলা হচ্ছে, গত এশিয়া কাপে, শচীন টেন্ডুলকার তাঁর শততম সেঞ্চুরি করছেন, বাংলাদেশের দর্শকেরা দাঁড়িয়ে করতালি দিয়ে অভিবাদন জানাল বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যানকে। এর নামই তো খেলোয়াড়সুলভ মনোভাব। ওই খেলায় বাংলাদেশ জয়লাভ করেছিল।
বাংলাদেশ আজ ধারাবাহিকভাবে ভালো করছে। ওডিআইতে বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়েছে, কোয়ার্টার ফাইনালে গেছে, পরে নিজেদের মাটিতে পাকিস্তান-জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ করেছে, আগেই দুবার বাংলাওয়াশ হয়েছে নিউজিল্যান্ড। বাংলাদেশ সিরিজে হারিয়েছে ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে। এই সাফল্যের পেছনে অনেকের অবদান আছে, কৃতিত্ব আছে খেলোয়াড়দের, টিম ব্যবস্থাপকদের, খুবই প্রাণসঞ্চারী ভূমিকা পালন করেছেন অধিনায়ক মাশরাফি, কোচ হাথুরুসিং, বিশেষ করে বোলিং কোচ হিথ স্ট্রিক। কিন্তু সবার আগে কৃতিত্ব পাবেন দর্শকেরা।
আজ সকালের কাগজে একটা ছবি দেখে মনটা খারাপ হলো। টিকিট কিনতে গিয়ে হাঙ্গামায় পড়ে পুলিশের লাঠির নিচে পড়েছেন একজন। ভাই আমার, বন্ধু আমার, সন্তান আমার, আপনার জন্য আমার মন খারাপ লাগছে। কিন্তু আমি জানি, আপনিই আজ সন্ধ্যায় টিভির সামনে বসবেন মনে কোনো ব্যথা না রেখে, দুহাত তুলে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করবেন, আপনার সঙ্গে থাকবে আরও ১৬ কোটি হৃদয়, হে সর্বশক্তিমান, লাল-সবুজকে জিতিয়ে দাও। আমরা সবাই বাংলাদেশকে ভালোবাসি, বাংলাদেশের জয় চাই, ক্রিকেটে, এবং জীবনের সর্বক্ষেত্রে। আমাদের হৃদয়ে বাংলাদেশ। ভাই আমার, আপনার জয় হোক, আপনাদের জয় হোক। আজকে আমরা, বাংলাদেশের দর্শকেরা, আরেকবার প্রমাণ করব, আমরাই চ্যাম্পিয়ন।
সেটা করব খেলোয়াড়সুলভ আচরণের মধ্য দিয়ে। সারা দেশে। ফল যা-ই হোক, আমরা তা সুন্দরভাবে উদযাপন করব। খেলা মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতি স্থাপনের জন্য। খেলা নির্মল আনন্দের জন্য। এটা আমরা ভুলব না। বিশেষ করে বলব, ইনশা আল্লাহ যদি আমরা জয়লাভ করি, আমাদের উদযাপন যেন চ্যাম্পিয়নের মতো হয়। আমরা যেন উচ্ছৃঙ্খল না হই।
আমাদের আনন্দ যেন কারও দুঃখের কারণ না হয়। সাতই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের যেন বদনাম না হয়।’ সাতই মার্চের আগের দিন সেই কথাটাই আমাদের বারবার করে মনে করতে হবে। আমাদের যেন বদনাম না হয়। আমরা সুন্দর খেলা চাই। ক্রিকেটে একই দিনে দুটো দল জয়লাভ করতে পারবে না। খেলার ফল আমাদের হাতে নেই। কিন্তু ক্রিকেট-খেলুড়ে জাতি হিসেবে আমরা যে চ্যাম্পিয়ন, সেটা প্রমাণের চাবিকাঠি আমাদের হাতে। আমরা তা প্রমাণ করব। আমরা সুন্দর আচরণ করব। সমর্থক হিসেবে, আর স্বাগতিক হিসেবে। ফল যা-ই হোক, আমরা আমাদের টিমের পাশে ছিলাম, আছি, থাকব। বাংলাদেশের জয় হোক। জয় হোক বাংলাদেশের দর্শকদের। আজকে জয়লাভ করলে আমরা সবাই সেই জয় সুন্দরভাবে উদযাপন করে দেখিয়ে দেব, বাংলাদেশ সুন্দর মানুষের সুন্দর দেশ। আর ফল যদি আশানুরূপ নাও হয়, তাহলেও আমরা হব সুন্দরতর। পৃথিবী সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখবে, দেখো, কী অপরূপ এই বাংলাদেশ, কী অপরূপ তার মানুষেরা। তারা খেলাকে খেলা হিসেবে নিতে জানে, আর ক্রিকেটারদের সঙ্গে ১৬ কোটি হৃদয় পারে আনন্দ-বেদনা সমানভাবে ভাগ করে নিতে।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের জন্য রইল শুভকামনা। বাংলাদেশের ক্রীড়ামোদী দর্শকদের জন্য রইল অভিবাদন। আমরাই তো বাংলাদেশ। আমি সুন্দর, তো বাংলাদেশ সুন্দর।