নভেরা হোসেন
খোলা বাজার২৪, মঙ্গলবার, ১৫ মার্চ ২০১৬ : আশির দশকে ধানমন্ডির কাকলি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়তাম। তখন ক্লাস থ্রি কি ফোর, ফাইনাল পরীক্ষা চলছে। বিভিন্ন ক্লাসের ছেলেমেয়েরা এক সাথে বসে পরীক্ষা দিচ্ছি। শিক্ষক নাম কল করছেন। নভেরা নামটি ডাকতেই দাঁড়িয়ে বললাম প্রেজেন্ট প্লিজ। আমার পেছনে বেশ গোলগাল ফর্সা একটি মেয়ে সেও বলল প্রেজেন্ট। এই নামের গন্ডগোল থেকে জানতে পারলাম ঐ মেয়েটির নামও নভেরা আর তার বাবা একজন কবি।
তখনও কবি শব্দের তেমন কোনো অর্থ আমার মাথায় ঢোকেনি। এরপর আমার ক্লাসে পেয়ে গেলাম নভেরার ভাই ইয়াসির আরাফাত রাহুলকে। রাহুলের সাথে সুন্দর বন্ধুত্ব হল। এরা দুজনেই কবি রফিক আজাদের ছেলেমেয়ে। পড়ে জানতে পারলাম উঁচু ক্লাসের লোপা আপাও কবির মেয়ে। নাইন টেনে উঠে যখন বই মেলায় যেতাম টিএসসির দুইপাশে উঁচু ভলিউমে কবিতার ক্যাসেট বাজতে শুনতাম। সেখানেই শুনি ‘ভাত দে হারামজাদা, না হলে মানচিত্র খাবোঃভালবাসা পেলেঃ’ আরও কিছু অসাধারণ কবিতা। ক্যাসেট কিনে এনে দিনরাত শুনতে লাগলাম রফিক আজাদসহ আরও কয়েকজনের কবিতা। সেই থেকে এই প্রতিভাবান কবির সাথে পরিচয়, তারপর ধীরে ধীরে কবিতা প্রেমের সাথে সাথে সমসাময়িক শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, শহীদ কাদরীসহ রফিক আজাদের কবিতার সাথেও সখ্যতা গড়ে উঠল।
খুব বেশি কমিউনিকেটিভ বলেই হয়তো তিনি আলাদাভাবে মনে দাগ কেটেছেন।
টাঙ্গাইলের জাহিদগঞ্জে এই গুণী কবির জš§ হয় ১৯৪১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি। টাঙ্গাইল, নেত্রকোণা থেকে স্কুল কলেজের পাঠ চুকিয়ে কবি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে। সেখান থেকে øাতক ও øাতকোত্তর সমাপ্ত করেন। তারপর কবির দীর্ঘ কর্মময় জীবন সেই সাথে কবিতার পৃথিবীতে সন্তরণ। কাগমারী এম এম আলী কলেজের শিক্ষকতা দিয়ে শুরু করে শেষ করলেন নেত্রকোণার বিরিশিরিতে অবস্থিত উপজাতীয় কালচারাল একাডেমিতে পরিচালকের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে।
মাঝে ১৯৭২-১৯৮৪ পর্যন্ত সময়ে বাংলা একাডেমির উত্তরাধিকার পত্রিকার নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন, এরপর রোববার পত্রিকায় ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের পদে কিছুদিন ছিলেন। এছাড়াও বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের সাথেও কিছুদিন যুক্ত ছিলেন। এতো গেল কবির পেশাগত জীবন কিন্তু কবিতার শুরু শৈশবে এবং দিনে দিনে তার কবিতা পৌঁছে গেছে সত্যিকারের কবিতার পৃথিবীতে। রফিক আজাদ এমন এক কবি যিনি একই সাথে দ্রষ্টা এবং স্রষ্টা। জীবনকে তিনি দেখেছেন নিজস্ব এক ভঙ্গিমায়, ভালবেসেছেন গভীর অনুপম এক আনন্দ ও বেদনাবোধ থেকে। ভালবেসেছেন প্রকৃতিকে, মিশে গেছেন তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
উন্নয়নের প্রয়োজনে না বুঝেই মানুষ সাড়াশি দিয়ে টেনে-হিঁচড়ে ছিবড়ে বানিয়ে ফেলেছে এ বসুন্ধরাকে। কবি তাতে আহত হন, ব্যথিত হন। কবির মনে প্রশ্ন জাগায় সোনালি কাঁকড়ার দাঁড়া, যাকে ঘিরে সময় বয়ে চলেছে। মানুষের লোভ আর বাসনার বলি হয় প্রকৃতি আর সেখানে সোনালি কাঁকড়ার দাঁড়া খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সভ্যতার উল্টোপিঠে। কবির চুনিয়া এক ছোট গ্রাম, যে এই প্রাণঘাতি মারনাস্ত্রের বিরুদ্ধে একখণ্ড জ্বলজ্বলে তারা হয়ে জ্বলছে। তথাকথিত সভ্যতার হিংস্রতা ছোঁয়নি চুনিয়াকে, সেখানকার মানুষদের। এখান থেকেই হতে পারে নতুন যাত্রা, এই হচ্ছে কবির অভিপ্রায়। অন্তরঙ্গে সবুজ সংসার, আগাছার কাহিনী, নবীন কাঠুরের উক্তি এইসব সম্ভাষণের আড়ালে কবি জেগে ওঠেন কুয়াশার ধূম্রজাল ভেদ করে।
তিনি এমন এক শক্তিমান কবি যিনি ভালবাসার বহুমাত্রিকতায় বিশ্বাসী, তিনি জানেন সব ফুরিয়ে গেলেও জানালায় জেগে থাকবে একটি তাজা ভোর, একটি কাকাতুয়া। মাধবীর গোপন ভালবাসায় তিনি আয়ু পুঁতে রাখেন আর এক পলকের অবহেলায় তিনি হয়ে ওঠেন বাক্সময়। নীরবতা হ্যাঁ একমাত্র নীরবতার মাঝে তিনি খুঁজে পেতেন প্রচণ্ড মুখরতা।