খোলা বাজার২৪, শুক্রবার, ২৫ মার্চ ২০১৬ : পুরোনো ঢাকার বাসিন্দা হায়দার আলী। সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় মাথায় আঘাত পেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হলে চিকিৎসকরা মাথায় অস্ত্রোপচার করেন। বুধবার হাসপাতাল থেকে রিলিজ নেওয়ার সময় সর্বশেষ অবস্থা জানতে চিকিৎসকদের পরামর্শে সিটি স্ক্যান করিয়ে বাসায় ফিরেন।
তবে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে হায়দার আলীর মাথায় প্রচণ্ড ব্যথা। রাতে তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে আজিমপুর কবরস্থান সংলগ্ন এক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যান। চিকিৎসক তার নাড়ি টিপে দেখেন, প্রেসার মাপেন। কোথায় ব্যথা, ব্যথাটা কোন দিক থেকে কোন দিকে অনুভূত হয় ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করে রোগীর মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলেন, একটি সিটি স্ক্যান করেন, ধানমন্ডির একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারের নাম উল্লেখ করে সেখান থেকে করিয়ে নিতে আসতে বললেন। খরচের কথা জানতে চাইলেই জানালেন চার হাজার টাকা। মাত্র দুদিন আগেই তো সিটি স্ক্যান করালাম, এর মধ্যে কি এমন হলো যে আবার করাতে হবে এমন প্রশ্নে বিব্রত হলেন ওই চিকিৎসক। আমতা আমতা করে ‘করলে ভাল হতো’ বলে খচখচ করে ওষুধ লিখে সাতদিন পর দেখা করতে বললেন।
হায়দার আলীর মেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা রোগীরা কমিশন বাণিজ্যের কাছেও জিম্মি হয়ে গেছি। মাত্র দু’দিন আগে যে সিটি স্ক্যান করিয়েছি সেই তারিখটি তিনি না দেখে শুধুমাত্র মোটা অঙ্কের কমিশনের লোভে অহেতুক সিটি স্ক্যান করাতে বললেন। এগুলো দেখার কী কেউ নেই?
শুধু হায়দার আলী নন, তার মতো হাজার হাজার হায়দার আলী প্রতিদিন এক শ্রেণির অসৎ দুর্নীতিবাজ চিকিৎসকের খপ্পরে পড়ে অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে বাধ্য হচ্ছেন। রাজধানীসহ সারাদেশে ব্যাঙ্গের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে হাজার হাজার প্যাথলজিক্যাল ল্যাবরেটরি ও ডায়াগনষ্টিক সেন্টার। অভিযোগ রয়েছে হাতেগোনা কয়েক প্রতিষ্ঠান ছাড়া অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান মোটা অঙ্কের কমিশন (শতকরা ৩০ভাগ থেকে ৫০ভাগ) গোপন চুক্তিতে চিকিৎসকদের দিয়ে সুচিকিৎসার নামে বিভিন্ন ক্লিনিক্যাল ও প্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাচ্ছেন।
বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানি গোপন চুক্তিতে দামি অ্যান্টিবায়োটিকসহ অপ্রয়োজনীয় ওষুধ লিখাচ্ছেন। চিকিৎসকভেদে মাসিক নগদ টাকা, ফ্ল্যাট, গাড়ি, টিভি, ফ্রিজ, মোবাইল ও আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন উপহার সামগ্রী দিচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিকরা কমিশন দেয়ার কথা স্বীকার করে বলেন, কমিশন না দিলে চিকিৎসকরা রোগী পাঠান না। এখন তারা কমিশন পাওয়াকে অধিকার মনে করেন। তবে অনেক চিকিৎসক ব্যতিক্রমও রয়েছেন। তারা রোগী পাঠিয়ে কমিশনের যে টাকা তাকে দেয়ার কথা সেটা রোগীকে ছাড় দেয়ার অনুরোধ জানান।
রাজধানীর মগবাজারের এক ডায়াগনষ্টিক সেন্টারের মালিক বলেন, কমিশন বাণিজ্য বন্ধ হলে রোগীরা অনেক কম খরচে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ পাবেন।
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশীদ ই মাহবুব বলেন, সঠিক রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা প্রয়োজন হলেও নীতি নৈতিকতা বিবর্জিত এক শ্রেণির চিকিৎসক অযথায় তা করিয়ে থাকেন। এগুলো দেখভালের দায়িত্ব স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার। কিন্তু তারা কতটুকু খতিয়ে দেখেন তা প্রশ্ন সাপেক্ষ।
ভুক্তভোগী এক রোগীর অভিভাবক জানান, সম্প্রতি তিনি এক ডাক্তারের কাছে গেলে প্রেসক্রিপশনে একটি নির্দিষ্ট কোম্পানীর ওষুধ লিখে দেন। তিনি ফার্মেসিতে ওই কোম্পানীর ওষুধ না পেয়ে অন্য কোম্পানির ওষুধ কিনে ওই চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, নিজের ইচ্ছেমতো ওষুধ কিনে খেলে ডাক্তারের কাছে কেন এসেছেন। তবে চিকিৎসক কেন এমন কথা বললেন তা তার বোধগম্য হয়নি বলে তিনি মন্তব্য করেন।